ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেটসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। বানের জলে ভেসে গেছে গ্রামীণ সব সড়ক ও বাড়িঘর। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। ভেসে গেছে গোয়ালঘরের গরু এবং পুকুর ও খামারের মাছ। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। গত বুধবার আখাউড়ায় মারা গেছেন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য- অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের কিছুই বাকি নেই। সব হারিয়ে এখন পথের ফকির অনেকে; বরং কোথাও এর চেয়ে করুণ অবস্থা। ঠাঁই নেওয়ার মতো জায়গাটুকুও অবশিষ্ট নেই।
এই দুর্যোগ-দুর্বিপাকে আমাদের বসে থাকার সুযোগ নেই। মনে করুন এই বিপদ রবের পক্ষ থেকে পরীক্ষা। মানুষ হওয়ার পরীক্ষা। কিংবা কৃতকর্মের ফল। এই জীবনে কম পাপ তো করিনি। হয়তো নদী ভরাট, খাল দখলের শাস্তি এই বন্যা। তাই অধৈর্য না হয়ে ধৈর্য ধরি। আল্লাহতায়ালার কাছে তওবা করি। তাঁর কাছে সাহায্য চাই এবং বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াই। সহযোগিতার হাত বাড়াই। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, যে অর্থ তোমরা উপার্জন করেছ এবং যা কিছু আমি জমিন থেকে তোমাদের জন্য বের করে দিয়েছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করো...।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬৭)
মানুষের বিপদে দাঁড়ানো ইসলামের শিক্ষা। যে নবির উম্মত পরিচয়ে গর্ব করি, সেই নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শই হলো মানবসেবা। অন্যের উপকার করে তিনি আনন্দিত হতেন। অন্যের বেদনায় ব্যথিত হতেন। কারও চোখে পানি দেখলে নিজের চোখকে ধরে রাখতে পারতেন না। এমন দরদি নবির উম্মত হয়ে আমরা কি দরদি না হয়ে পারি? নিরীহ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের প্রয়োজনীয় খাবার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। তাদের সহযোগিতা করা ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ সেই ব্যক্তি, যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী।’ (সহিহুল জামে, হাদিস: ৩২৮৯)
আজ যদি তাদের পাশে না দাঁড়াই। সাহায্যের হাত না বাড়াই। তাহলে আমাদের মানুষ জন্মই বৃথা। অনেক মানুষ অর্ধাহারে, অনাহারে আছেন। তাদের অভুক্ত রেখে আমরা কীভাবে আহার করতে পারি? পরিধেয় বস্ত্রের অভাবে অনেকেরই ইজ্জত রক্ষা হচ্ছে না। তাদের ইজ্জত হেফাজতের দায়িত্ব আমাদেরও। আমাদের ভাইদের এই ঘোর বিপদে ফেলে রাখতে পারি না। যদি এখনই কিছু না করি, তাহলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। পানিবাহিত রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে মহামারির রূপ নিতে পারে। আমরা যদি প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা করি, তাহলে আল্লাহর রহমতে অনেকগুলো মানুষ বেঁচে যাবে। আমরা পাব উত্তম প্রতিদান। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে মুমিন কোনো মুমিনের ক্ষুধা নিবারণ করবে, আল্লাহতায়ালা তাকে কেয়ামতের দিন জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। যে মুমিন কোনো মুমিনের তৃষ্ণা দূর করেছে, আল্লাহতায়ালা তাকে কেয়ামতের দিন মোহরাঙ্কিত জান্নাতি সুধা থেকে পান করাবেন। যে মুমিন কোনো মুমিনকে বস্ত্র দান করবে, আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতের উন্নতমানের সবুজ কাপড় পরাবেন।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৩৮৬)
বন্যাদুর্গতদের সাহায্যের ক্ষেত্রে এককভাবে না গিয়ে দলবদ্ধভাবে যাবেন। প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্য নেবেন। দুর্গত এলাকায় গিয়ে প্রথমে উদ্ধার কাজ করতে হবে। উদ্ধারকাজের জন্য রেসকিউ টিম গঠন করতে হবে। অস্থায়ী মেডিকেল বা মেডিকেল টিম গঠনের বিকল্প নেই। বিশুদ্ধ পানি, ওরস্যালাইন, পানি বিশুদ্ধ করার মেডিসিন ও প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম এবং পর্যাপ্ত ওষুধপাতির ব্যবস্থা করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন মেটাবেন। একইভাবে যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের বিপদ দূর করবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিনে তার বিপদ দূর করে দেবেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৯৩)
বন্যাদুর্গতদের মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের প্রতি বিশেষ খেয়াল ও যত্ন নেওয়া দরকার। তেমনি বিষাক্ত সাপ, পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকেও সতর্ক থাকতে হবে। এই বিপদের দিনে সব দ্বন্দ্ব ভুলে, দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই সবার বন্ধু, ভাই ভাই। তাই আসুন, আজ এই দুঃসময়ে মানুষকে সাহায্য করি। আল্লাহও আমাদের সাহায্য করবেন। মনে রাখবেন, ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।’ (মুসলিম, হাদিস: ২৩১৯)
লেখক : খতিব, কসবা জামে মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া