ঈমানের পরে ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল নামাজ। এর মাধ্যমে বান্দার সঙ্গে তার রবের বিশেষ সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। নামাজের আগে কিছু কাজ করতে হবে। মানতে হবে কিছু নিয়ম। এখানে সেসব কাজ ও নিয়ম নিয়ে আলোচনা করা হলো—
১. আজান দেওয়া
আজান আরবি শব্দ। এর অর্থ ডাকা বা আহ্বান জানানো। বিশেষ কিছু শব্দের মাধ্যমে নামাজের জন্য আহ্বান জানানোকে পরিভাষায় আজান বলা হয়। নামাজের জন্য আজান দেওয়া ইসলামি বিধানমতে সুন্নতে মুয়াক্কাদা।
২. পবিত্রতা অর্জন
শরীর, পরিধেয় পোশাক, নামাজের জায়গা বা যার ওপর নামাজ আদায় করা হবে, তা পবিত্র হতে হবে। আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন শৌচাগারে ঢুকতেন তখন আমি ও আমার মতো এক যুবক পানির লোটা ও একটি ছোট বর্শা নিয়ে যেতাম। অতঃপর তিনি পানি দিয়ে ইসতেনজা করতেন।’ (বুখারি, হাদিস: ১৫২)
৩. অজু করা
পবিত্রতা অর্জন করার পর সুন্নতসম্মত পদ্ধতিতে অজু করে নিতে হবে।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নামাজ আদায়ের ইচ্ছা করবে, তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ও দুই হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করো। তোমাদের মাথা মাসেহ করো এবং পদযুগল গোড়ালি পর্যন্ত ধৌত করো। আর যদি তোমরা অপবিত্র থাকো, তা হলে ভালোভাবে পবিত্র হও।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পবিত্রতা ছাড়া কোনো নামাজ কবুল হয় না। খিয়ানতের সম্পদ দিয়ে সদকা কবুল হয় না।’ (বুখারি, হাদিস: ৪২৩)
৪. নামাজের ওয়াক্ত বা সময় হওয়া
প্রত্যেক নামাজের নির্ধারিত ওয়াক্ত বা সময় হলে নামাজ আদায় করতে হবে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই নামাজ নির্ধারিত সময়ে আদায় করার জন্য মুমিনদের ওপর ফরজ করা হয়েছে।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১০৩)
৫. সতর ঢাকা
নামাজের জন্য পুরুষের নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত এবং নারীর মুখমণ্ডল, হাতের কব্জি ও পায়ের গোড়ালি ছাড়া পূর্ণ শরীর ঢাকাকে সতর বলা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘উরু (পুরুষের) সতরের অন্তর্ভুক্ত।’ (বুখারি, ১/৫৩)। তিনি আরও বলেছেন, ‘কাপড় যদি বড় হয় তা হলে গোটা শরীর আবৃত করো। আর কাপড় যদি ছোট হয়, তা হলে লুঙ্গির মতো পরিধান করো।’ (বুখারি, ১/৫২)
৬. মাথা ঢেকে রাখা
রাসুলুল্লাহ (সা.) টুপি মাথায় দিয়ে নামাজ আদায় করেছেন—সে মর্মে সহিহ কোনো বর্ণনা না পাওয়া গেলেও তিনি যে নামাজে পাগড়ি পড়েছেন, সেটা নিশ্চিত। জাবের ইবনে আমর ইবনে হুরায়েস (রা.) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে পাগড়ি ও মোজার ওপর মাসেহ করতে দেখেছি।’ (বুখারি, হাদিস: ২০৫)। সুতরাং পাগড়ি পরে নামাজ আদায় করা সুন্নত। আর খালি মাথায় নামাজ পড়ার তুলনায় নামাজে মাথা ঢেকে রাখা উত্তম।
৭. টাখনুর ওপর কাপড় তোলা
পুরুষের জন্য সর্বদা টাখনুর ওপর কাপড় পরা আবশ্যক। তদুপরি নামাজের সময় টাখনুর ওপর কাপড় তোলার বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি নামাজের মধ্যে টাখনুর নিচে কাপড় পরে, সে নামাজের মধ্যে আছে নাকি হারামের মধ্যে আছে—তাতে আল্লাহর কিছু আসে-যায় না।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৬৩৭)
৮. কিবলামুখী হওয়া
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘এবং তোমরা যেখানেই থাকো, সেদিকে (মসজিদুল হারাম) মুখ ফিরাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৪৪)
৯. বিনয়ের সঙ্গে নামাজে দাঁড়ানো
সক্ষম ব্যক্তিকে অবশ্যই দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতে হবে। দাঁড়ানোর সক্ষমতা না থাকলে বসে আর বসার সক্ষমতা না থাকলে শুয়েও নামাজ পড়ার অনুমতি রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করো। যদি তাতে অপারগতা থাকে তা হলে বসে এবং তাতেও যদি অপারগতা থাকে তা হলে শুয়ে নামাজ আদায় করো।’ (বুখারি, ১/১৫০)
১০. জামাতে নামাজ আদায় করা
পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা ওয়াজিব। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কেরআনে এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করো এবং জাকাত দাও। আর রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৪৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়া একাকী নামাজ পড়ার চেয়ে ২৭ গুণ বেশি মর্যাদার।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪৫)
১১. ইমাম নির্বাচন করা
জামাতে নামাজ আদায় করার জন্য ইমাম নির্বাচন করতে হবে এবং ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করতে হবে। ইমাম নির্বাচন নিয়েও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দিকনির্দেশনা রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক দলের মধ্য থেকে (নামাজের জন্য) ইমাম তিনি হবেন, যিনি কোরআনের জ্ঞানে সবার চেয়ে অগ্রগণ্য। এ বিষয়ে যদি সবাই সমান হন, তা হলে যিনি সুন্নাহর জ্ঞানে অগ্রগণ্য তিনি ইমাম হবেন। এ বিষয়ে যদি সবাই সমান হন, তা হলে যিনি আগে হিজরতকারী তিনি ইমান হবেন। এ বিষয়ে যদি সবাই সমান হন, তা হলে যিনি আগে ইসলাম গ্রহণকারী তিনি ইমাম হবেন। কেউ যেন কারও কর্তৃত্বের স্থানে তার ইমাম না হয় এবং কেউ যেন কারও গৃহে তার সম্মানের স্থানে অনুমতি ছাড়া না বসে।’ (মুসলিম, হাদিস: ৬৭৩)
১২. সুতরা রেখে নামাজে দাঁড়ানো
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন নামাজ পড়বে, তখন সে যেন তার নামাজের জন্য সুতরা ঠিক করে নেয়। যদিও সেটি একটি তীর দ্বারাও হয়।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৫৩৪০)। কমপক্ষে আধা হাত উঁচু বা লম্বা কোনো লাঠি বা এ জাতীয় কিছুকে নামাজের সামনে রাখাকে সুতরা বলা হয়।
১৩. কাতার সোজা করে দাঁড়ানো এবং সামনের কাতার আগে পূরণ করা
জামাতে নামাজ পড়ার জন্য কাতার সোজা করে দাঁড়ানো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা নামাজের কাতারগুলো সোজা করে দাঁড়াও। কারণ কাতার সোজা করা নামাজ পূর্ণতার অংশ।’ (বুখারি, হাদিস: ৭২৩)
১৪. ইকামত দেওয়া
একাকী বা জামাতে আদায়কৃত নামাজের জন্য ইকামত দেওয়া সুন্নত। এমনকি দ্বিতীয় জামাতের নামাজের জন্যও ইকামত দেওয়া উচিত। ইকামত আরবি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে কোনো কিছু সোজা করা বা প্রতিষ্ঠা করা। (লিসানুল আরব, ১১/৩৫২)
শরিয়ত অনুমোদিত শব্দমালা বা বাক্যমালা দ্বারা নামাজের সূচনা হওয়ার ঘোষণা দেওয়াকে ইকামত বলা হয়। ইকামতকে দ্বিতীয় আজানও বলা হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ জুমা ও দুই ঈদের নামাজের জন্য ইকামত দেওয়া ফরজে কিফায়া।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক