
প্রতি বছর ইসলামিক ফাউন্ডেশন বইমেলা ও অমর একুশে বইমেলায় ইসলামি প্রকাশকদের স্টল পেতে বেশ বেগ পোহাতে হয়। অনেকে পানও না। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মেলা নিয়ে এবার আন্দোলনও হয়েছে জোরেশোরে। প্রকাশকদেরও নেই সম্মিলিত কোনো অ্যাসোসিয়েশন। ইসলামি প্রকাশনীগুলো ব্যক্তিগত উদ্যোগে গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন জায়গায় ছোট পরিসরে মেলা করছেন। ইসলামি প্রকাশনাশিল্পের সমস্যা-সম্ভাবনা, অমর একুশে বইমেলা ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন মেলা, প্রকাশনী ও লেখকদের মাঝে সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত এবং দেশি লেখকদের মৌলিক বই প্রকাশে প্রকাশকদের আগ্রহ কেমন—এমন নানা বিষয়ে ছয়জন প্রকাশক কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে।
ইসলামি প্রকাশনীগুলোর অংশগ্রহণে মেলা হোক
— ওবায়দুল্লাহ আযহারী
স্বত্বাধিকারী, মাকতাবাতুল আযহার
প্রতিটি জাতীয় বইমেলায় অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক আমরা। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামি বইমেলা ও একুশের বইমেলা—দুটোতেই আমরা সব শর্ত মেনেই নিয়মিত আবেদন করেছি। কখনো পেতাম, কখনো পেতাম না।
আমাদের দাবি হলো, ইসলামি বইমেলা যেন সব ইসলামি প্রকাশনীর অংশগ্রহণমূলক হয়। যারা নিয়ম মেনে আবেদন করবে, তারা যেন স্টল বরাদ্দ পায়। অমর একুশে বইমেলাতেও যেসব ইসলামি প্রকাশনী নিয়ম-কানুন মেনে আবেদন করবে, তাদেরও যেন স্টল দেওয়া হয়। মেলা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এমন কোনো নিয়ম যেন না আসে, যা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যা ইসলামি ভাবধারার প্রকাশনীর চেতনাবিরোধী। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখতে চাই, ইসলামি বইয়ের প্রকাশকদের দুটি ভিন্ন সমিতি রয়েছে। একটি হলো, বাংলাদেশ সৃজনশীল ইসলামী পুস্তক প্রকাশক সমিতি, অন্যটি হলো বাংলাদেশ ইসলামী প্রকাশক ফোরাম।
আমাদের দাবি হলো—এই দুটো সমিতির সব সদস্য যেন স্টল পায়। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ও মিডিয়ার যথাযথ প্রচার পায়, এমন বৃহৎ পরিসরে মেলা আয়োজন করা। সেটা বাইতুল মুকাররমসংলগ্ন কোনো চত্বরে হোক, বা অন্য কোনো বড় জায়গায় হোক, আমরা সাধুবাদ জানাই।
প্রকাশকদের দাবি মানলে ইফা গৌরব ফিরে পাবে
— দেওয়ান মো. মাহমুদুল ইসলাম
স্বত্বাধিকারী, রাহনুমা প্রকাশনী
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বইমেলা মারাত্মকভাবে অবহেলিত হয়ে আছে। কোনো নীতিমালা নেই, কর্তৃপক্ষের স্বদিচ্ছা নেই এবং মানসম্মত সৃজনশীল প্রকাশকদের অংশগ্রহণেরও তেমন সুযোগ নেই। বিগত কয়েক বছরে সৃজনশীল প্রকাশকদের পক্ষ থেকে একটি অংশগ্রহণমূলক ভালো ও আন্তর্জাতিক মানের মেলা করার জন্য ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা অনেকবার বসেছি, অনুরোধ করেছি, সর্বাত্মক সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছি, কিন্তু কর্তৃপক্ষের কোনো সহযোগিতা আমরা পাইনি; উল্টো আমরা নানারকম অবিচার ও নিগ্রহের শিকার হয়েছি।
দেশের সামগ্রিক অবস্থার পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মেলা নিয়ে বাংলাবাজারসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার প্রকাশকদের পক্ষ থেকে ধর্ম উপদেষ্টা, ইফার ডিজি ও মেলা কমিটিকে (বর্তমানে মেলা কমিটি নেই) কিছু অধিকারের কথা জানানো হয়। এই অধিকারগুলোর সঠিকভাবে প্রয়োগ হলে একটি সুশৃঙ্খল, দৃষ্টিনন্দন, পাঠকপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য আলোচিত বইমেলার আয়োজন করা সম্ভব। প্রকাশকদের দাবিগুলোর প্রতিফলন ঘটলে ইফা তার পুরোনো গৌরব ফিরে পাবে। বাংলাদেশের আপামর ধর্মপরায়ণ মানুষ একটি ধর্মীয় সংস্কৃতি উপহার পাবে। ইসলামি প্রকাশক ও লেখকরা ইসলামি সাহিত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবেন।
ইসলামি পুস্তক প্রকাশকদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন
— আহমাদ গালিব
স্বত্বাধিকারী, মাকতাবাতুল ইসলাম
ইসলামি বই প্রকাশ করেন এমন প্রকাশকের সংখ্যা তিন শতাধিক। তাদের মধ্য থেকে শ-খানেক প্রকাশক দুটি সমিতিতে বিভক্ত। একটি বাংলাদেশ সৃজনশীল ইসলামী পুস্তক প্রকাশক সমিতি, অপরটি বাংলাদেশ ইসলামী প্রকাশক ফোরাম। একটি ব্যবসায়িক অ্যাসোসিয়েশন যেসব বৈশিষ্ট্য ও নিয়ম-কানুন ধারণ করে সক্রিয় থাকে, এই দুটি সমিতি তেমন নয়। তাই বলা যায়, ইসলামি পুস্তক প্রকাশকদের শক্তিশালী কোনো ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম নেই। যদি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সব ইসলামি পুস্তক প্রকাশক ঐক্যবদ্ধভাবে একটি অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুলে সক্রিয় থাকেন, তা হলে তা তুলনামূলক অধিক কার্যকর ও শক্তিশালী রূপ লাভ করবে। সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ে সহায়ক হবে।
এদিকে ইসলামি পুস্তক প্রকাশকদের মাঝে যোগাযোগের ঘাটতি এবং মাজহাবকেন্দ্রিক নানা মতপার্থক্যের কারণে সম্প্রীতির বন্ধন কিছুটা দুর্বল। ফলে শক্তিশালী অ্যাসোসিয়েশন তাদের মাঝে গড়ে উঠবে কি না এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। তবে আশা রাখি, সবাই শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম গড়তে এগিয়ে আসবে।
একুশে বইমেলাতে স্টল বরাদ্দে বৈষম্য দূর হোক
— নূর মোহাম্মাদ আবু তাহের
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স
স্টল না পাওয়ার দায় একাডেমি কর্তৃপক্ষ ও প্রকাশনা সংস্থা দুই পক্ষেরই। বাংলা একাডেমি নির্ধারিত শর্তাবলি না মেনে ছলচাতুরী করে বইমেলায় স্টল নেওয়ার আকাঙ্ক্ষার দায় কিছু প্রকাশনাকে নিতে হবে। বিপরীতে সব শর্তপূরণ করার পরও শুধু চিন্তাকাঠামোর ভিন্নতায় পরিকল্পিতভাবে কোনো কোনো প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার সম্পূর্ণ দায় একাডেমির কর্তাব্যক্তিদের। বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে কাজ করা মানুষগুলোও যখন কেবল রাজনৈতিক বিবেচনাকে সামনে রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন প্রচণ্ড হতাশা এসে ভর করে।
রাজনৈতিক বিবেচনা পরিহার করে পেশাদার ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে স্টল বরাদ্দ দিলে কারও আপত্তিই গ্রহণযোগ্য হবে না। স্টলবঞ্চিত প্রকাশনীগুলো বাংলা একাডেমি বর্ণিত শর্তাবলি পূরণ করে শুধু ইনসাফের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বৈষম্যবিরোধী স্পিরিট দেশের সর্বত্র যেমন আকাঙ্ক্ষিত, বাংলা একাডেমির বইমেলাতেও সেই স্পিরিট অনেক বেশি প্রত্যাশিত। বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলাতে স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর হোক। যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদন করা প্রকাশনাকে স্টল দেওয়া হোক।
মৌলিক বই আরও প্রকাশ করা প্রয়োজন
— শাহাদাৎ হুসাইন
প্রকাশক, মাকতাবাতুত তাকওয়া
ইসলামি প্রকাশনীগুলো বাংলাদেশি লেখকদের মৌলিক বই প্রকাশ করতে চান না; অভিযোগটি অবান্তর নয়। এর বাস্তবতা আছে। তবে এখন অনেক প্রকাশনী মৌলিক বই প্রকাশ করছেন। তারা সফলও হচ্ছেন। আমাদের দেশের অনেক লেখক যোগ্যতার বাইরে গিয়ে ভিন্ন বিষয়ে লেখেন। তখন বইটি প্রকাশ করা হলে মার্কেটে কদর থাকে না। পাঠকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। দেশের যোগ্যতাসম্পন্ন যেসব ব্যক্তি মৌলিক বই লিখেছেন, তাদের বইগুলো বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। যারা অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি, তারা যদি মৌলিক বিষয়ে কাজ করেন, তা হলে খুব ভালো চলে। প্রকাশকরাও ছাপতে আগ্রহী হন। পাঠকও আগ্রহভরে কেনেন।
আমাদের কওমি জগৎটা আকাবির, আসলাফ ও মুরব্বিকেন্দ্রিক। সবাই তাদের বই পড়ার চেষ্টা করে। ভিনদেশি ইসলামি স্কলারদের বই প্রকাশ করলে পাঠকরাও নিতে আগ্রহ দেখান বেশি, প্রকাশকরাও প্রকাশ করে লাভবান হন। তবে দেশি লেখকদের মৌলিক বই আরও বেশি প্রকাশ করা প্রয়োজন। মৌলিক বই লেখার ক্ষেত্রে লেখকদেরও যথেষ্ট জ্ঞান ও গবেষণা করে লেখা উচিত।
লেখক-প্রকাশকদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটুক
— আহমেদ ইয়াসিন
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সমকালীন প্রকাশন
লেখকদের বইয়ের সম্মানী দেওয়া নিয়ে আগে নানা ধরনের আলাপ ছিল। বিশেষ করে ২০১৫ সালের আগে অনেক প্রকাশনী সম্মানী দিতেন না। এর পর প্রকাশনা অঙ্গনে বড় পরিবর্তন এসেছে। শুধু প্রকাশকরাই নন; লেখকরাও এ ব্যাপারে বেশ সচেতন। প্রকাশক ও লেখকদের মধ্যকার সম্পর্কও আগের তুলনায় এখন ভালো ও স্বচ্ছ। আমার মনে হয়, সম্মানী নিয়ে লেখকরা অভিযোগ করেন না এখন। যদি থেকেও থাকে, আমার জানা নেই।
যেসব লেখককে আমরা চিনি, জানি বা যাদের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়, ওঠাবসা আছে—তাদের কাছ থেকে আমরা এ রকম কোনো অভিযোগ শুনিনি। এটা এখন মীমাংসিত বিষয়।
একটা সময় লেখক এবং অনুবাদকরা কাজের বিনিময়ে যে পারিশ্রমিক বা সম্মানী পাওয়ার কথা, সেটা থেকে বঞ্চিত হতেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই অবস্থা আর বিরাজমান নেই। আমরা চাই এ অবস্থার আরও উন্নতি ঘটুক। প্রকাশনাশিল্প আরও সমৃদ্ধ হোক। লেখক-প্রকাশকদের চাওয়া-পাওয়াগুলো আরও সুন্দর ও সুগম হোক।