সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষত বিপ্লবপরবর্তী নতুন বাংলাদেশে জাতির বড় সমস্যা হচ্ছে বাজারব্যবস্থা। নিয়ন্ত্রণহীন বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। এর পেছনে বিবিধ কারণ থাকলেও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট প্রধান সমস্যা। এ ব্যাপারে কোরআন ও সুন্নাহে রয়েছে বাস্তবসম্মত চমৎকার নির্দেশনা।
ইসলাম শুধু ইবাদতের কথা বলেনি, লেনদেন ও কায়কারবার ঠিক করার কথাও বলেছে। মুহাম্মাদ (রহ.) বলেন, ‘ব্যবসা ও লেনদেনের মধ্যে মানুষের তাকওয়া ও পরহেজগারি নিহিত। যার লেনদেন ভালো, সেই প্রকৃত মুত্তাকি ও আত্মশুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি।’
আজ মুসলিম উম্মাহর সংকটটা কোথায়? একজন অমুসলিম দার্শনিক এক মুসলিমকে বলেন, ‘তোমাদের নবি (সা.)-এর আইডলজিকে কাজে লাগিয়ে আমরা পৃথিবীতে সফল হচ্ছি। তাঁর আইডলজি, আচার-আচরণ আর লেনদেনের সুন্নাহ তোমাদের মাঝে নেই। তাই আমরা মুসলিম দেশে কাজের জন্য যাই না; বরং মুসলিমরাই বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশে কাজের জন্য আসে।’ পৃথিবীতে অর্থনীতির দুটি ব্যবস্থা বিদ্যমান—সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থয় ব্যক্তি পরিশ্রম করবে কিন্তু ব্যক্তি সম্পদের মালিক নয়, সম্পদের মালিক রাষ্ট্র। যার দরুন ব্যক্তির কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যায়। পুঁজিবাদ মানুষের মালিকানা প্রসারিত করেছে, অবাধ করেছে। যত বুদ্ধি আর শ্রম, তত আয় আর সমৃদ্ধি। এখানে সব ধরনের কাজ হালাল করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যেকোনো উপায়ে ব্যক্তিকে ধনী হওয়ার সুযোগ করে দেয়। যে কারণে পুঁজিবাদে পেশাটাই মুখ্য; সেটা বৈধ বা অবৈধ যাই হোক।
ইসলামি অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তির মালিকানা অবশ্যই স্বীকৃত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এবং আমি তাদেরকে যে উপজীবিকা প্রদান করেছি তা থেকে দান করে থাকে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৩)। আল্লাহতায়ালা বান্দাকে সম্পদের মালিক বানিয়ে দিচ্ছেন। এই মালিকানা দিচ্ছেন আল্লাহ, অর্থাৎ মালিকের ওপরও মালিক আছে। ইসলামি অর্থনীতিতে ব্যক্তি হালাল পথে অবাধে আয় করতে ও ব্যয় করতে পারবে। কিন্তু হারাম পথে আয় ব্যয়-নিষেধ। তার মালিক আল্লাহ তাকে হালাল-হারামের মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছেন আয় ও ব্যয়ে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ব্যবসা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৭৫)
ইসলামি জীবনব্যবস্থায় ইচ্ছে করলেই কেউ অবৈধ পথে আয়-ব্যয় করতে পারে না। কারণ সে জানে তাকে তার মালিক আল্লাহর কাছে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। অপরদিকে পুঁজিবাদ ব্যক্তিকে আয় ও ব্যয়ে অবাধ করে দেয়, যেখানে থাকে না বৈধ-অবৈধের কোনো সীমা।
পুঁজিবাদের থাবায় এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হারাম ব্যবসা ছেয়ে গেছে। যতই তাদের সতর্ক করা হোক না কেন, লাভ হচ্ছে না। কেউ সেখান থেকে বের হতে পারছে না, হারাম থেকে বাঁচতে পারছে না। কারণ ঘরে ঘরে হারামে ছয়লাব হয়ে গেছে। আজ বাজারে অস্থিরতা, কোনোভাবেই তার লাগাম টেনে রাখা যাচ্ছে না। এর কারণ পণ্য মজুত এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দাপট। ইসলাম এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যারা পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, তারা ‘খাতিই’ বা অপরাধী। এটা কোনো সাধারণ অপরাধ নয়; বরং কোরআনে এই শব্দটি ব্যবহার হয়েছে কারুন ও হামানের ক্ষেত্রে। সুতরাং যারা এ কারবার করবে তারা কারুন ও হামানের উত্তরসূরি, তাদের সাথেই তাদের হাশর হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা নিজেদের মধ্যে তোমাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না এবং তা বিচারকদের (ঘুষ হিসেবে) প্রদান করো না। যাতে মানুষের সম্পদের কোনো অংশ পাপের মাধ্যমে জেনে-বুঝে খেয়ে ফেলতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৮)
অর্থনৈতিক মুক্তি ও বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইসলামি অর্থনীতির মূলনীতি, ইসলামি অর্থব্যবস্থার রোডম্যাপ বাস্তবায়ন ছাড়া মুক্তি নেই। সরকার কর মাফ করছে পণ্যের। আরও নানা উদ্যোগ নিয়েও কাজ হচ্ছে না। কেন? কারণ সরকার চাইছে, কিন্তু এই লোভী পুঁজিপতিরা চাইছে না মূল্য কমুক। তাদের পেটের হাবিয়া দোজখ অল্পতে ভরছে না। এদের সোজা করার জন্য প্রচলিত নানা আইনের আগে দরকার আল্লাহর ভয়। তাকওয়া ছাড়া আর কি প্রতিষেধক হতে পারে! ইসলামে সব কিছুর আগে ঈমান। ঈমান পাকাপোক্ত হলে তারপর আইন নির্ধারণ করলে আইনের শাসনের সুফল পাওয়া যাবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নবুয়াত লাভের পর ১৩ বছর মক্কায় মানুষের ঈমান মেরামত করেছেন। মদিনায় গিয়ে হালাল-হারামের আইন করে তা বাস্তবায়ন করেছেন। যার কারণে সাহাবিরা (রা.) খুব সহজে মানতে পেরেছেন। বাংলাদেশেও আইন আছে বাজার সিন্ডিকেটের ব্যাপারে কিন্তু ৫৩ বছরেও তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। ফলে সিন্ডিকেট হোল্ডাররা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তাই নেতা নয়, নীতির পরিবর্তন দরকার। আর এই পরিবর্তন আনতে হবে কোরআন দিয়ে। কোরআনই হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, মুক্তির সনদ। বাজারব্যবস্থার মূলে আঘাত করতে হবে। মানুষের মধ্যে তাকওয়ার গভীরতা বাড়াতে হবে। দুনিয়া আল্লাহর কাছে মূল্যহীন এই চেতনা মানুষের মধ্যে জাগ্রত করতে হবে।
বাজারের অস্থিরতা ও ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানার জন্য দেশের যে আইন আছে, তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। দু-একজনকে শাস্তির আওতায় নিলে বাকিরা দেখেই শিক্ষা নেবে। ইসলাম নিজের ব্যাপারে নরম কিন্তু অন্যের হকের ব্যাপারে কঠোর। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বাজারে পণ্য আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত হয়। আর পণ্য মজুতকারী অভিশপ্ত হয়।’ (ইবনে মাজাহ, ২১৪৪)
লেখক: খতিব, আন-নূর জামে মসজিদ, টঙ্গী
, , ,