মাওলানা আবদুল আলীম—মারকাযু শাইখিল ইসলাম আল মাদানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল। দীর্ঘ আট বছর ধরে এ দায়িত্বে আছেন। এর আগে শিক্ষকতা করেছেন পাঁচ বছর। জন্ম দিনাজপুরের বীরগঞ্জে। দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেছেন ইদারাতুল উলুম আফতাবনগর থেকে। বেশ কিছু বইয়ের অনুবাদকও তিনি। স্মার্ট ফোন ব্যবহারে মাদরাসা ছাত্রদের ক্ষতি, দক্ষ ও চিন্তাশীল ছাত্র গঠনের উপায়, মুহতামিমের গুণাবলি, মাদরাসা পরিচালনার নিয়ম-কানুন, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও মারকাযু শাইখিল ইসলাম আল মাদানী ঢাকার বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে।
কওমি মাদরাসায় একসময় ছাত্রদের জন্য মোবাইল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। এখন অনেক মাদরাসায় নিয়মটি কিছুটা শিথিল হয়েছে। কিন্তু আপনার এখানে এখনও আছে। এতে কোন ধরনের সুফল পাচ্ছেন?
শুধু মাদরাসা নয়; মোবাইলের বিষয়টা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। আমাদের বিশ্বাস, যেকোনো ডিভাইস শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষতিকর। শিক্ষার্থীদের জন্য মোবাইল নিষিদ্ধের ব্যাপারটি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। মোবাইলের ব্যাপারে যত কঠোর হওয়া যায়, শিক্ষার্থীদের জন্য তত ভালো। আমাদের মুরব্বিরা এটাকে বিষধর সাপের সঙ্গে তুলনা করেন।
আমাদের মারকাযে শুরু থেকেই এ ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোরতা রয়েছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কঠোরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের এখানে ছাত্রদের সম্পূর্ণ আবাসিক ব্যবস্থাপনায় থাকতে হয়। প্রতি রুমে শিক্ষকরা পর্যবেক্ষণ করেন। নিরাপত্তার খাতিরে সিসি ক্যামেরাও আছে। স্মার্ট ফোন নিয়ে প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। তবে বিরতির পর বাসা থেকে আসার সময় বাটন ফোন আনতে পারে। কিন্তু সেটা অফিসে জমা রাখতে হয়। বাড়িতে যাওয়ার দিন আবার নিয়ে যায়। আমাদের পক্ষ থেকে মারকাযের সত্যায়ন সিলসহ প্রত্যেক ক্লাসে ছাত্রদের কাছে দুই তিনটি বাটন ফোন দেওয়া আছে। ছাত্ররা সেটা দিয়ে নির্ধারিত সময়ে বাড়িতে যোগাযোগ করতে পারে। অভিভাবকরাও সেখানে ফোন করেন।
মোবাইল নিষিদ্ধের কারণে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। যোগ্য ও শাস্ত্রীয় আলেম তৈরি হচ্ছে। বোর্ড পরীক্ষায় রেজাল্টও ভালো হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ। তবে উচ্চতর ফিকহ বিভাগের ছাত্রদের আমরা কম্পিউটার দিয়েছি। শিক্ষকদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ইন্টারনেট সংযোগ করে দিয়েছি। তারা প্রয়োজনমতো ব্রাউজিং করতে পারে।
সভ্য, দক্ষ ও আদর্শিক ছাত্র গঠন এবং তাদের জীবন ও সময় নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে একটি প্রতিষ্ঠানের কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
মাদরাসায় তালিম (শিক্ষা) ও তরবিয়ত (দীক্ষা) দুটিই সমান থাকতে হবে। শিক্ষা মোটামুটি সব জায়গায় আছে, কিন্তু দীক্ষার বড়ো অভাব। বর্তমানে আদর্শ শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। ফলে আদর্শ ছাত্র গঠন একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আগের অধিকাংশ শিক্ষকরা আদর্শবান ছিলেন। তাঁরা দেশের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষাকেও সমান গুরুত্ব দিতেন। প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখতে হবে, তাঁর আমল ও চরিত্র কেমন? তাঁর মাঝে নববি আদর্শ আছে কিনা? তিনি ছাত্রদের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ কিনা? তার ভেতরে ছাত্রগঠনের তীব্র ইচ্ছা ও স্বপ্ন আছে কিনা? তা হলে আদর্শ ছাত্র গঠন হবে। অন্যথায় আদর্শ ছাত্রগঠন খুবই দুরহ ব্যাপার হবে।
মাদরাসা পরিচালক বা মুহতামিম হওয়ার জন্য কী কী গুণ বা যোগ্যতা থাকা আবশ্যক?
মাদরাসাগুলো নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা—আল হাইয়াতুল উলয়া, বেফাক ও অন্য বোর্ডগুলো—তাদের থেকে এ ধরনের কোনো নীতিমালা আজও পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। কারা মুহতামিম হবেন, কারা কোন ধরনের শিক্ষক হবেন, এ ধরনের কোনো নিয়ম বোর্ডগুলোর নেই। ফলে সবাই নিজেদের মতো নিয়ম বানাচ্ছেন। ইচ্ছামতো মাদারাসা করছেন। মুহতামিম হচ্ছেন। মুহতামিম ও শিক্ষক হওয়ার জন্য বোর্ডগুলো থেকে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকা দরকার। মাদরাসা পরিচালনা করা গুরুদায়িত্ব। নানা দিক সামলাতে হয় তাদের—ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবক ইত্যাদি। আমল, জ্ঞান ও গুণে যারা সমৃদ্ধ, তাদেরই কেবল মুহতামিম হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
অনেকে বলেন, বর্তমান সময়ের মাদরাসার ছাত্ররা আগের মতো যোগ্য, দক্ষ, চিন্তাশীল হয়ে উঠছে না। অনেকে বলেন, কর্মজীবন নিয়েও মাদরাসাছাত্ররা হতাশ। কেন এমনটি হচ্ছে?
এখানে দুটিই পরিপূরক প্রশ্ন। প্রবাদ আছে, বৃক্ষ তার ফলে পরিচয়। যোগ্য, দক্ষ, চিন্তাশীল শিক্ষকের বিকল্প নেই। শিক্ষকদের থেকেই ছাত্ররা শিখবে। প্রথমে শিক্ষকদের বিশুদ্ধ চিন্তা লালন করতে হবে, তাদের দক্ষ হতে হবে। তাহলে ছাত্ররা দক্ষ ও চিন্তাশীল হবে।
বর্তমান সময়ের ছাত্ররা হতাশ—এটি দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। আমাদের ছেলেরা কি করবে, এটা আমাদের ঠিক করে দিতে হবে। প্রতি বছর মাদরাসা থেকে যে পরিমাণ আলেম বের হচ্ছে, এ পরিমাণ কর্মসংস্থান কি আছে আমাদের? আমাদের কর্মক্ষেত্র খুবই ছোট। কর্মক্ষেত্র বাড়াতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষা গড়ে তুলতে হবে। ধর্ম ও কর্ম দুটিই লাগবে। ছাত্রদের বলব, রিজিকদাতা একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা দ্বীনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে আজীবন খেদমত করব। তাওয়াক্কুল ও অল্পতুষ্টি যেন আমাদের পাথেয় হয়। তাহলে কখনও হতাশা আসবে না।
অনেক আলেম মাদরাসার পরিচালক বা মুহতামিম হওয়ার যোগ্যতা ও দক্ষতা না থাকার পরও তা হচ্ছেন। এতে পড়াশোনার মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ছে, আপনি কি মনে করেন।
সবাই যেন মুহতামিম না হতে পারেন, সে জায়গায় কাজ করা প্রয়োজন। অযোগ্যরা মুহতামিম হলে শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়বে। পড়াশোনার মান ক্ষুণ্ন হবে। অযোগ্য মুহতামিমদের নিয়ে নানা রকম অভিযোগও আছে।
অনেকে বলেন, ‘পরিচালক বা মুহতামিমের জীবন চলে রাজার হালে, শিক্ষকরা মরে ধুকে ধুকে’—আসলেই কি ব্যাপারটি তাই? এর থেকে উত্তরণের পথ কী?
অনেকাংশে সত্য না হলেও কিছুটা হয়তো সত্য। অনেক মাদরাসার ক্ষেত্রে এমন অভিযোগ আসে, শিক্ষকরা কষ্টে দিনাতিপাত করেন, মুহতামিমরা আয়েশে থাকেন। মাস শেষে বেতন পান না শিক্ষকরা। এমনটি না হওয়া উচিত। মুহতামিম বা পরিচালকের আয়-উপার্জনটা একটু বেশি হবে, এটা স্বাভাবিক। মুহতামিমের জীবনের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষকরা যেন তাদের জীবনের তুলনা না করেন। মুহতামিম তো একটা জায়গায় পৌঁছেছেন। তবে মুহতামিমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব, শিক্ষকদের প্রতি যেন সুনজর থাকে।
অনেক মুহতামিম অনিয়ম করেন। এমনটি না করা উচিত। যাদের আয় ভালো, সামর্থ্য আছে, তারা ভালো বেতন-বোনাস দিতে পারেন। আমাদের উপার্জন কম, তারপরও আমরা দেওয়ার চেষ্টা করি। অবিবাহিত শিক্ষকদের বিয়ের সময় মোটা অঙ্কের হাদিয়া দিই। প্রতি বছর একজন শিক্ষককে উমরায় পাঠাই। শিক্ষকদের মূল্যায়ন করলে প্রতিষ্ঠান এগিয়ে যায়। শিক্ষার মান ভালো হয়।