পাখি আল্লাহর অনুপম সৃষ্টি। পাখিদের কথা কোরআনের একাধিক আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা কি দেখে না, আকাশের শূন্যগর্ভে নিয়ন্ত্রণাধীন বিহঙ্গের প্রতি? আল্লাহই তাদের স্থির রাখেন। অবশ্যই এতে নিদর্শন রয়েছে মুমিনদের জন্য।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৭৯)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তুমি কি দেখ না, তিনি হলেন আল্লাহ, আসমান ও জমিনে যারা আছে সকলেই যাঁর প্রশংসাগীতি উচ্চারণ করে আর (উড়ন্ত) পাখিরাও তাদের ডানা বিস্তার করে? তাদের প্রত্যেকেই তাদের ইবাদত ও প্রশংসাগীতির পদ্ধতি জানে। তারা যা করে, আল্লাহ সে সম্পর্কে খুবই অবগত।’ (সুরা নুর, আয়াত: ৪১)
শীতকালে অতিথি পাখির পদচারণা, উড়ে বেড়ানো আর ডানা ঝাপটানোতে মুখরিত হয় রূপসী বাংলা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষ করে শীতপ্রধান দেশ—সুদূর সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, তিব্বতের হিমশীতলসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ওরা আসে। পৃথিবীর ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৮৫৫ প্রজাতি বা প্রায় ১৯ শতাংশ পাখি পরিযায়ী। সোনাজঙ্গ, কুনচুনি, বাতারণ, শাবাজ, জললিপি, বালিহাঁস, রাজশকুন, তিলেময়না, রামঘুঘু, ডুবুরি পাখি, কাদাখোঁচা, রাজসরালি, পাতিকুট, কালভমাথা, গাঙচিল, চকাচকি ইত্যাদি নানা নামের নানা রঙের পরিযায়ী পাখি আসে। সংখ্যায় যা প্রায় ১৫০ প্রজাতিরও বেশি। পাখিদের মধ্যে হামিং বার্ড সবচেয়ে ছোট, মাত্র দুই ইঞ্চি। আর সবচেয়ে বড় হলো উটপাখি— যা প্রায় নয় ফুট হয়ে থাকে।
অতিথি পাখিকে পরিযায়ী বলা হয়, ইংরেজিতে মাইগ্রেটরি বার্ড। ওরা আমাদের দেশে আসে মূলত একটু উষ্ণতা ও খাবারের জন্য। এরা আমাদের ক্ষতি করে না। ফসলের ক্ষতিকর পোকা, কীটপতঙ্গ খায়। পরিযায়ী পাখির বিষ্টা উৎকৃষ্ট সার। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াতের মাধ্যমে পরাগায়নে ভূমিকা রাখে। এরা আমাদের দেশ ও প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়ায়। আমাদের বিমুগ্ধ করে। অথচ আমরা কত নিষ্ঠুর! এদের সঙ্গে আমরা প্রতারণা করে, ফাঁদ পেতে হত্যা করি। আপ্যায়নের নামে খাবারে বিষ মেখে দিই।
দেশের মিরপুর চিড়িয়াখানার লেক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় লেক, বরিশালের দুর্গাসাগর, নীলফামারীর নীলসাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা এবং সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ছাড়াও নিঝুম দ্বীপ, ঢালচর, চরকুকরী-মুকরী কিংবা দুবলার চরে অতিথি পাখি বেশি দেখা যায়। এরা আমাদের ক্ষতি করে না।
পবিত্র কোরআনে হুদহুদ নামে একটি পাখির কথা উল্লেখ আছে। সে সুলায়মান নবিকে বিভিন্ন খবর দিত। আল্লাহতায়ালা তাঁকে পাখিদের ভাষা শিক্ষা দিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘সুলায়মান হয়েছিল দাউদের উত্তরাধিকারী এবং বলেছিল হে মানুষ, আমাকে পাখিকুলের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এটা অবশ্যই সুস্পষ্ট অনুগ্রহ।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ১৬)
মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অহেতুক কোনো চড়ুইপাখি মেরে ফেলল, কিয়ামতের দিন পাখিটি আল্লাহর কাছে এই বলে নালিশ করবে যে, হে আল্লাহ অমুক ব্যক্তি আমাকে অহেতুক হত্যা করেছে।’ (নাসায়ি)। পাখির মধ্যে আছে মানুষের জন্য শিক্ষা। পাখির শূন্যে উড়ে বেড়ানো, ঘর তৈরি, খাবার সংগ্রহ ও প্রজননে আছে মানুষের চিন্তার উপাদান।
অতিথি পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য করতে হবে। তাদের যত্ন নিতে হবে। কোনোভাবেই তাদের হত্যা করা যাবে না। তাড়িয়ে দেওয়ার আয়োজন করা যাবে না। দেশের কিছু মানুষের পাখির সঙ্গে বৈরিতাপূর্ণ আচরণের জন্য এখন আগের মতো এরা আসে না। মনে রাখতে হবে, অকারণে প্রাণহত্যা জায়েজ নেই। ঘৃণ্য অপরাধ। অবুঝ প্রাণী যারা বিনা কারণে হত্যা করে, পরকালে তাদের মুক্তি নেই। প্রচলিত আইনেও এসব পাখি ধরা ও বিক্রি করা নিষেধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি যথাযথ কারণ ছাড়াই কোনো পাখি হত্যা করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার হিসাব নেবেন।’ (নাসায়ি, হাদিস: ৪৪৪৫)
আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখি আসা আল্লাহর কুদরতেরই নিদর্শন। তাই পরিযায়ী পাখিদের ভালোবাসতে হবে। তাদের যত্ন নিতে হবে। তাদের প্রতি দয়া করতে হবে। এদের প্রতি দয়া ও যত্নে আছে সওয়াব। যারা পাখিদের প্রতি দয়া করবে না, আল্লাহও তাদের প্রতি দয়া করবেন না। পাখি শিকারিদের আল্লাহর নবি (সা.) অভিশাপ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যেকোনো প্রাণীর ওপর দয়া করার মধ্যেও রয়েছে প্রভূত সওয়াব।’ (বুখারি, হাদিস: ৬০০৯)
একবার কয়েকজন সাহাবি একটি পাখির দুটি বাচ্চা ধরে ফেললেন। আর পাখিটি ছটফট করতে লাগল। নবি (সা.) পাখিটির ছটফটানি দেখে বললেন, কে একে তার বাচ্চার বিষয়ে কষ্ট দিয়েছে? তার বাচ্চা তাকে ফিরিয়ে দাও। আবার তিনি দেখতে পেলেন, পিঁপড়ের টিবিকে আগুনে জ্বালানো হয়েছে, তখন তিনি বলেন, আগুনের রব ছাড়া আর কারও জন্য বৈধ নয় আগুন দ্বারা আজাব দেওয়া। (আবু দাউদ, হাদিস: ২৬৭৫)
লেখক : অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, সেলস অপারেশনস ফেয়ার, ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড, বনানী