সিজদা আরবি শব্দ। অর্থ মাথা নত করা, আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহতায়ালার ইবাদতের উদ্দেশ্যে বিনম্রচিত্তে মাটিতে কপালসহ সাতটি অঙ্গ রাখাকে সিজদা বলা হয়। একমাত্র আল্লাহতায়ালার ইবাদত হিসেবে সিজদা করতে হবে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করো এবং ইবাদত করো।’ (সুরা নজম, আয়াত: ৬২)
সিজদা করা ইবাদত। সিজদা আল্লাহতায়ালা নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। তাঁর অনুগ্রহ কামনা করা এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উপায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(আল্লাহকে) সিজদা করো এবং (তাঁর) নৈকট্য লাভ করো।’ (সুরা আলাক, আয়াত: ১৯)
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সিজদাবস্থায় বান্দা তার প্রভুর সর্বাধিক নৈকট্যে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা এ সময় বেশি বেশি দোয়া করো।’ (মুসলিম, হাদিস: ৪৮২)। সুতরাং আল্লাহতায়ালার নিকটবর্তী হওয়ার জন্য, একমাত্র তাঁর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে ইবাদত হিসেবে সিজদা করতে হবে।
আধ্যাত্মিক উৎকর্ষসাধনের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপায় হলো সিজদা। সিজদার মাধ্যমে মানুষ তার দেহের সর্বোচ্চ পয়েন্ট বা অঙ্গ মাথার ফ্রন্টাল লোবকে সর্বনিম্ন স্তর মাটির সঙ্গে ঠেকিয়ে যাবতীয় অহংকারকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। মহাকবি শেখ সাদি তার কবিতায় লিখেছেন, ‘নিজের বড়ত্ব-অহংকারকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দাও, যদি তুমি প্রকৃত অর্থে বড় হতো চাও। বীজ মাটির সঙ্গে মিশে বাগানের ফুল হয়ে সুশোভিত হয়।’ সুতরাং আত্ম-অহমিকা, আমিত্ব, বড়ত্ব এবং অহংকার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে প্রকৃত অর্থে উৎকর্ষ লাভ করার অনন্য মাধ্যম সিজদা।
এর পাশাপাশি সিজদার কিছু আশ্চর্যজনক বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্যগত উপকারিতা রয়েছে। এ বিষয়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ জিয়াইল হক সিজদাহর বিজ্ঞান নামে একটি বই লিখেছেন। গবেষণালব্ধ বইটির সারসংক্ষেপ হলো—
সিজদাবস্থায় ব্রেনে তুলনামূলক বেশি রক্তপ্রবাহ ঘটে
আমরা জানি মানুষের ব্রেন হলো ৮৬ বিলিয়ন বা ৮৬০০ কোটি নিউরন বা কোষের সমষ্টি। এটি আবার কয়েক ভাগে বিভক্ত। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে লোব বলা হয়। আধুনিক গবেষণায় নির্ণীত মানুষের ব্রেন মোট চারটি লোবে বিভক্ত—
১. ফ্রন্টাল লোব। মাথার একদম সামনে অর্থাৎ কপালের পেছনে এর অবস্থান। বুদ্ধিবৃত্তিক ও আবেগীয় কার্যকম নিয়ন্ত্রণ করা এর মূল কাজ।
২. প্যারাইটাল লোব। ফ্রন্টাল লোবের পেছনে এর অবস্থান। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গৃহীত তথ্যের সমন্বয় করার এর মূল কাজ।
৩. টেম্পোরাল লোব। ফ্রন্টাল লোব ও প্যারাইটাল লোবের নিচে এর অবস্থান। ঘ্রাণ, শ্রবণ, কথা বলা, শোনা ও দেখা এবং দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি তৈরি করা মূলত এর কাজ।
৪. অক্সিপিটাল লোব। মাথার একদম পেছনে এর অবস্থান।
সিজদা অবস্থায় মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ও আবেগীয় কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রক ফ্রন্টাল লোবকে মাটির সঙ্গে মিলিয়ে রাখার কারণে ব্রেনে অন্যান্য লোবসহ বাকি কোষগুলি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি পরিমাণে রক্ত সরবরাহ পায়। আর বেশি রক্ত সরবরাহ পাওয়া মানে বেশি অক্সিজেন পাওয়া। এতে ব্রেনের কোষগুলো পুষ্টি পায় এবং কার্বন-ডাই-অক্সইড বের হয়ে যায়। ফলে সিজদা থেকে উঠলে রিল্যাক্স ও সতেজ লাগে।
সিজদার কারণে অতিমাত্রায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়
সিজদা দেওয়ার ফলে ফুসফুসের ওপর পেটের ডায়াফ্রামসহ পুরা পেটের চাপ পড়ে। এর ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের গভীরতা বাড়ে এবং শরীর থেকে অতিরিক্ত মাত্রায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের হয়ে যায়। রক্তে কার্বন-ডাই-অক্সইড বেশি থাকাতে শরীর ক্লান্ত থাকে। বর্জ্যরূপী এ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের হয়ে যাওয়ার কারণে শরীর চাঙ্গা হয়, মন ফুরফুরে লাগে এবং মেজাজ সতেজতা লাভ করে। ফলে কাজে মনোযোগী হওয়া সহজ হয়।
আরও পড়ুন: সুদি কারবারে জড়িত ব্যক্তি ইমাম হতে পারবে?
মানসিক স্থিতিশীলতা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম
মানুষের ব্রেন হলো একটি বিস্ময়কর পাওয়ার হাউস অথবা পাওয়ার প্লান্ট বা বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র। মানব শরীরের শত শত কোষের মেমব্রনের ভেতরে ও বাইরে নির্দিষ্ট মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। উৎপাদিত এ বৈদ্যুতিক প্রবাহ অ্যাটোমিক বন্ডের মাধ্যমে শরীরের কোষগুলো একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে বার্তা প্রেরণ করতে সক্ষম হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে নিউরোট্রান্সমিশন বলা হয়। শরীরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে বা এক কোষ থেকে অন্য কোষে বৈদ্যুতিক প্রবাহের চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে জীবনের অবসান ঘটা। মানুষের শরীরের এ বৈদ্যুতিক চুম্বকীয় বলয়কে বায়োম্যাগনেটিক ফিল্ড বলা হয়। এ ছাড়া জমিন বা মাটি অথবা ভূতলে একপ্রকার চুম্বকীয় বলয় রয়েছে, যাকে জিওম্যাগনেটিক ফিল্ড বলা হয়। জমিনের জিওম্যাগনেটিক ফিল্ডের সঙ্গে মানব শরীরের বায়োম্যাগনেটিক ফিল্ডের সংযোগ ঘটিয়ে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভের মাধ্যমে মানসিক স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব। এর সুক্ষ্ম ইশারা পবিত্র কোরআন থেকে পাওয়া যায়। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘আর তোমাদের জন্য জমিনে রয়েছে নির্দিষ্টকালের স্থিতিশীলতা ও জীবিকা।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৩৬)
সিজদা করার দ্বারা মানুষের শরীরের বায়োম্যাগনেটিক ফিল্ডের অতিমাত্রার বৈদ্যুতিক প্রবাহকে মাটি বা জমিনের জিওম্যাগনেটিক ফিল্ডে আর্থিং করা সম্ভব হয় এবং এতে মানসিক স্বস্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়। বিষয়টা অনেকটা ঘর বা বাড়ির বৈদ্যুতিক সার্কিটের ভোল্টেজের মাত্রাকে স্থিতিশীল বা নিরাপদ করতে বৈদ্যুতিক সিস্টেমটিকে মাটিতে সংযুক্ত করার মাধ্যমে অতিরিক্ত ভোল্টেজ বা স্ট্যাটিক চার্জ নিষ্কাশন করার মতো।
হতাশা, উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা ও মানসিক চাপ দূর করে
অ্যাংজাইটি, স্ট্রেস, হতাশা, উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা ও মানসিক চাপ থেকে মুক্তির জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের থেরাপি চিকিৎসার প্রচলন রয়েছে। এর মধ্যে রিলাক্সেশন থেরাপি, ডিপ ব্রিদিং থেরাপি, ইলেকট্রো কনভালসিভ থেরাপি অন্যতম। এসব থেরাপির প্রধানতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানসিক চাপ দূর করে সতেজতা ও প্রফুল্লতা ফিরিয়ে আনা। ব্রেন ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে বিষাক্ত বর্জ্যতুল্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের করে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ানো। আর এসব কিছুই সহজভাবে প্রাকৃতিন নিয়মে অর্জন করা সম্ভব হয় সিজদার মাধ্যমে।
ব্যাক পেইন বা কোমর ব্যথার উপশম ঘটায়
ইউনির্ভাসিটি অব হার্ভার্ডে ২০১৪ সালে দ্য বেস্ট মেডিসিন ফর ব্যাক পেইন মে বি গুড ওল্ড-ফ্যাশন্ড মুভমেন্ট অ্যান্ড এক্সারসাইজ শিরোনামে একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সিজদা মানুষের ব্যাকবোন বা ভারটেব্রা ও এর মধ্যকার নার্ভসহ রক্তনালিকে শক্তিশালী করে এবং মাংসপেশীকে পরিপুষ্ট করে। ফলে নিশ্চিতভাবে বলা হয়, সিজদা মানুষের ব্যাক মেইন বা কোমর ব্যথা প্রতিরোধে বা উপশমে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
ব্রেনের প্রি-ফন্টাল কার্যক্রমে পজেটিভ পরিবর্তন ঘটে
আমেরিকার ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ যৌথভাবে দ্য ইফেক্ট অব প্রসট্রেশন (সিজদা) অন দ্য প্রি-ফন্টাল ব্রেইন অ্যাকটিভিটি: অ্যা পাইলট স্ট্যাডি শিরোনামের এক গবেষণায় সিজদা করার আগে ও পরে কিছু নারী-পুরুষের ব্রেন ম্যাপিং করে দেখেছেন, সিজদা করার কারণে মানুষের ব্রেনের প্রি-ফন্টাল কার্যক্রমে পজেটিভ তারতম্য ঘটে। ১০ সেকেন্ড সময় ধরে নিয়মিত সিজদা করার দ্বারা এ পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে এবং বিশ সেকেন্ড সময়কালব্যাপী সিজদা করলে এ পরিবর্তন আরও বেশি প্রগাঢ় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সিজতা কারলে মানুষের ব্রেনে যেসব পরিবর্তন সাধিত হয় এর ফলে ব্যক্তির স্মৃতি, মানসিক স্থিতিশীলতা ও প্রশান্তি, জটিল ও কঠিন চিন্তা করা এবং বিশ্লেষণ করার সামর্থ্যে, এমনকি আচরণেও তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। (সিজদাহর বিজ্ঞান, জিয়াউল হক, ঋদ্ধ প্রকাশন, পৃষ্ঠা : ৫৬-৬৮)
লেখক: আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক