রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য শাহপরী দ্বীপে বুক পেতে প্রথমে দাঁড়িয়ে ছিলেন গাজী ইয়াকুব। করোনায় লাশ কাফন-দাফনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজও শুরু করেছিলেন তিনি। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। অসহায় মানুষকে ঘর দিচ্ছেন। স্বাবলম্বী করছেন। গড়ে তুলেছেন তাকওয়া ফাউন্ডেশন।
ছোটবেলা থেকেই মানুষের কষ্টটা বুঝতেন গাজী ইয়াকুব। মাদরাসায় পড়াকালে ধনী-গরিব মানুষের বৈষম্য পীড়া দিত তাকে। ইয়াকুব পণ করেছিলেন, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। পড়াশোনা শেষে ব্যবসা শুরু করেই দাঁড়ালেন মানুষের পাশে। খাবার, শীতবস্ত্র, টিউবওয়েল দিলেন অসহায়কে। এভাবে বাড়ালেন সেবার পরিধি।
৩৩০ ঠিকানায় চিঠি
২০০০ সালে দেশে শীত জেঁকে বসেছিল। শীতার্তদের জন্য মন কাঁদল গাজী ইয়াকুবের। অল্প রোজগারে কতজনের পাশে দাঁড়ানো যায়? তাই তাকওয়া ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কুরিয়ার সার্ভিসে চিঠি পাঠালেন ৩৩০ সংসদ সদস্যের কাছে। শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আবেদন জানালেন। লোকজন হাসাহাসি ও মশকরা করেছিল। উত্তরবঙ্গের জাতীয় পার্টির এক এমপি ফোন করে সাহস যুগিয়ে ছিলেন।
একা দাঁড়িয়ে গিয়েছেন
এলো ২০১৭ সাল। জানলেন, রোহিঙ্গা মুসলিমরা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আসছেন। ইয়াকুব গেলেন টেকনাফের শাহপরী দ্বীপে। সারাদিন উদ্ধার কাজ করতেন। অল্পস্বল্প খাবার দিতেন তাদের। বিবিসির এক সাংবাদিক বললেন, ‘আপনার কাজগুলো ফেসবুকে লাইভ করেন।’ তাই করলেন ইয়াকুব। সাড়া পড়ল। আমেরিকান প্রবাসী নুসাইবা তাসনিম কিছু টাকা পাঠালেন। আগতদের স্যালাইন, শুকনা খাবার, কাপড় ও বোরকা দিতে লাগলেন। লাইভও দেখাচ্ছিলেন। এরপর ঢাকার আলেম ও নানা মানুষ টাকা দিলেন তাকে। পরে একদিনই রোহিঙ্গাদের দিলেন ১৭ লাখ টাকা। গাজী ইয়াকুব বললেন, ‘ভেসে আসা ২১ লাশ দাফন করেছি। হাজারো ঘর, শত শত বাথরুম, আটটি মাদরাসা, নয়টি মসজিদ এবং শতাধিক টিউবওয়েল স্থাপন করেছি। সাত শতাধিক শিশুর সুন্নতে খতনা করিয়েছি। পরিবারের সম্মতিতে তাদের বিবাহযোগ্য পাত্র-পাত্রীদের বিয়ে দিয়েছি।’
আরও পড়ুন: শৃঙ্খলায় আরও উন্নতি ঘটানো সম্ভব হলে বাংলাদেশিরা হবেন সেরা হাজি
বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়
গাজী ইয়াকুব করোনার শুরুতে খবর পেলেন, মিরপুর শাহ আলীতে এক নারী মারা গেছেন। কাফন-দাফনে কেউ এগিয়ে আসছে না। ইয়াকুব মর্মাহত হলেন। পাঁচজনের টিম করলেন। পিপি পরে ছবি দিলেন ফেসবুকে। লিখলেন, ‘আমরা কাফন-দাফনের কাজ করব।’ হুলুস্থূল কাণ্ড ঘটে গেল সবখানে। মিডিয়াগুলো বড় করে খবর দিল। নারীকে কাফন-দাফন করলেন। তার সাহস দেখে দেশের ৫২ জেলায় কাফন-দাফনের টিম প্রস্তুত হয়ে গেল। প্রতিটি টিমে নারী সদস্যও ছিল। তাদের জন্য তাকওয়া ফাউন্ডেশনের লোগোসংবলিত টি-শার্ট দেওয়া হলো। লোকজন পিপি, ডেটল ও হ্যান্ডগ্লাভস দিল। ভয়ংকর সে সময়ে কয়েক হাজার মরদেহ দাফন করেছে তাকওয়া ফাউন্ডেশন। শতাধিক হিন্দুর সৎকারও করেছে। এ সময় নানা ধরনের সেবাও দিয়েছে তারা।
আসমানীদের মুখে হাসি
কবি জসীম উদদীন আসমানী কবিতায় আসমানীর নড়বড়ে ঘর, দুর্দশা ও অভাবের কথা বলেছেন। এমন আসমানীদের জন্য কাজ করছে তাকওয়া ফাউন্ডেশন। এ পর্যন্ত ৫০টি অসহায় দরিদ্র পরিবারকে দুই রুমের ঘর দিয়েছে তারা। ১১০ জনকে সেলাইমেশিন, দিয়েছেন ১১টি ভ্যানগাড়ি। প্রতি মাসে ১০ বিধবাকে ৫১০০ টাকা এবং ৩০ এতিমকে মাসিক খরচ দিচ্ছেন। ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস দিচ্ছেন। রমজানে ইফতারসামগ্রী ও শীতে কম্বল দেন। ২৪-এর বন্যায় ৪০ হাজার পরিবারকে খাবার ও ১ হাজার পরিবারকে দিয়েছেন ঘরোয়া আসবাব। ৬৫০ শিক্ষার্থীকে বিছানা দিয়েছেন। ২১টি ঘর করে দিয়েছেন। নগদ অর্থ দিয়েছেন প্রায় ৬০ লাখ। ইয়াকুব জানালেন, ‘মানুষই টাকা দেয় তাকওয়া ফাউন্ডেশনকে। আমরা শুধু প্রয়োজনটা তুলে ধরি।’
তাকওয়া এখন উদাহরণ
চলতি বছরের অক্টোবরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে ক্রয়মূল্যে সবজি বিক্রি করেছে তাকওয়া ফাউন্ডেশন। ঢাকাসহ দেশের নানা জায়গায় এ সেবা দিয়েছে সংগঠনটি। তাকওয়া থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক সংগঠন ও ব্যক্তি দেশের নানা জায়গায় ক্রয়মূল্যে সবজি বিক্রি করেছে। মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে।
স্বপ্ন
গাজী ইয়াকুব বললেন, ‘এ কাজের প্রেমে ও মায়ায় পড়ে গেছি। এতিম, পথশিশু ও বৃদ্ধদের জন্য কমপ্লেক্স এবং দাতব্য সংস্থা করতে চাই। ভাসমান অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস দিতে চাই। শিক্ষা, চিকিৎসা, পথশিশু ও বিধবা মা-বোনদের নিয়ে কাজ করতে চাই। পৃথিবীব্যাপী তাকওয়া ফাউন্ডেশনের সেবা ছড়িয়ে দিতে চাই।’
তাকওয়া ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান গাজী ইয়াকুবের জন্ম ঢাকার মিরপুরে। পিতা হাফেজ মাওলানা ইউসুফ গাজী। ১৯৯৯ সালে লালবাগ মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) শেষ করেছেন। বর্তমানে মারকাযুল কোরআনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক তিনি। মানবসেবার ওপর ভারত, ব্যাংকক ও মালয়েশিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক