মানুষের জীবনযাত্রায় বড় রকমের প্রয়োজন হয় অর্থনীতির। অর্থ হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার অন্যতম পথ্য। এ অর্থই মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে বুকটান দিয়ে দাঁড়াতে সাহস জোগায়। ইসলাম মানুষকে শিক্ষা দেয় হালাল অর্থে স্বাবলম্বী হতে। সঠিক পথে আয়-রোজগার করতে। ইসলাম সব বিষয়ে মানুষকে যে সুন্দর, শোভন জীবন উপহার দিয়েছে, কোনো ধর্ম বা মতবাদ এমন সুন্দর জীবন উপহার দিতে পারেনি। পারবেও না।
বর্তমান পৃথিবীর সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক অভিশাপ। সমাজতন্ত্র স্বাধীন মানুষকে পরাধীন, যান্ত্রিক ও ইতর বস্তুতে পরিণত করে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানুষকে বল্গাহীন স্বাধীন, নিপীড়ক, স্বার্থপর ও স্বেচ্ছাচারী করে তোলে। ইসলামি অর্থনীতি এই দুই মেরুর অর্থনীতি ব্যবস্থার মাঝে সমন্বয় সাধন করে সমৃদ্ধিশালী সর্বজনীন কল্যাণকামী ও সভ্য সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা পালন করে। অর্থনৈতিক সফলতা ও মুক্তি একমাত্র আল্লাহ প্রেরিত অভ্রান্ত সত্যের উৎস কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক ইসলামি অর্থনীতির মাঝেই নিহিত আছে। যেসব দেশ এখনো সমাজতন্ত্রের দাবিদার, তারা বহুবার পরিবর্তন, সংযোজন, সংশোধন করেও ফলবান হতে পারেনি। আর পুঁজিবাদের ইতিহাস তো শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা, অন্যায় যুদ্ধ ও সংঘাতের রক্তাক্ত ইতিহাস। পুঁজিবাদের দর্শন চরম ভোগবাদী ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতার দর্শন। ইসলামি অর্থনীতির দর্শন হলো জনহিতকর, সুষম ও সর্বযুগোপযোগী দর্শন—যা আবহমানকাল থেকে মানবকল্যাণে অবদান রেখে আসছে।
পুঁজিবাদ: বর্তমান বিশ্বে রাজনীতি ও অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক পুঁজিবাদগোষ্ঠী। বিশ্বের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের কথা বলে পুঁজিবাদীরা যে পরিকল্পনা বা কর্মসূচি মানব বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করেছে, এতে মানুষ সাময়িক উপকার দেখলেও এসবের গভীরে যে ‘অ্যালোপ্যাথিক’ ওষুধের মতো দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণগুলো লুকিয়ে আছে, তা আমরা অনেকেই সাধারণ চোখে দেখতে পাচ্ছি না। পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রধান ক্ষতিকর দিক হলো, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিত্তশালীদের সঙ্গে বিত্তহীনদের আকাশ-পাতাল ব্যবধান।
পুঁজিবাদের চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—
- ব্যক্তির সম্পত্তিতে অন্য কারও প্রাপ্য বা অধিকার নেই।
- অর্থোপার্জনে যেকোনো পথ অবলম্বন করা যাবে।
- মালিক ইচ্ছামতো সম্পদ খরচ করতে পারবে।
- ইচ্ছামতো সম্পদ সঞ্চয় করা যাবে।
মোটকথা, ব্যক্তি স্বার্থটাই পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। পুঁজিবাদের থিউরিতে ব্যবসা আর সুদে কোনো পার্থক্য নেই। সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে, পুঁজিবাদ আর সুদভিত্তিক অর্থনীতির পোশাক কিংবা সাজসজ্জা দেখতে চমকপ্রদ হলেও তা মানুষের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর।
আরও পড়ুন: যে তিন কাজে দেরি করতে নিষেধ করেছেন নবিজি (সা.)
সমাজতন্ত্র: কমিউনিজমের জনক বলে খ্যাত কার্ল মার্ক্স মূলত বস্তুবাদ আর ভাববাদের মাঝে দ্বান্দ্বিক ছিলেন। কার্ল মার্ক্স পুঁজিবাদবিরোধী চিন্তাচেতনা ও বস্তুবাদের ভিত্তিতে এক নব্য অর্থনৈতিক মতবাদ কমিউনিজমের জন্ম দিয়েছেন। কমিউনিজমের ইশতেহার হলো— অর্থোপার্জনের সব পথ ও পন্থা সমাজের সম্মিলিত মালিকানায় থাকবে। কোনো কিছু ব্যক্তিগত ইচ্ছায় ব্যবহার কিংবা ব্যবহারের অধিকার কারও থাকবে না। ব্যক্তিগত জীবনের ইচ্ছা, কর্ম—সবই হবে রাষ্ট্রের জন্য। প্রত্যেকের জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় উপকরণাদি দেবে সরকার। ব্যক্তি সরকারের নির্দেশে যেকোনো কাজ করতে বাধ্য। এই ইশতেহার প্রকাশের পরপরই কার্ল মার্ক্স চিন্তা ‘কমিউনিস্ট’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত লাভ করে।
কার্ল মার্ক্সের চিন্তাচেতনার সঙ্গে বিশ্বের মার্ক্সবাদীদের বক্তব্য ভিন্ন হোক কিংবা অভিন্ন, আজ আমরা বলতে বাধ্য যে, মার্ক্সবাদ ব্যর্থ হয়েছে মানুষের মৌলিক সমস্যার সমাধান দিতে। কার্ল মার্ক্স এত নিবেদিত হয়েও ব্যর্থ হলেন এ জন্য যে, সসীম জ্ঞানের গবেষণা ত্রুটিমুক্ত নয়। অসীম জ্ঞান ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কার্ল মার্ক্স মানুষের অন্ন, বাসস্থান, বস্তুর সমস্যার সমাধানের কথা বলেছেন, কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি ভাত খেয়ে ওষুধ সেবনের পর কাপড় গায়ে দিয়ে যে মানুষের মন একটু আতর কিংবা সুগন্ধি ব্যবহার করতে চায়। এই মন চাওয়াটাকে তিনি আবেগ কিংবা অপ্রয়োজনীয় বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
ইসলাম: ইসলামি অর্থনীতির মূল ভিত্তি কোরআন-হাদিস মোতাবেক সর্বক্ষেত্রে ইনসাফসম্মত বণ্টন। ইসলামি অর্থনীতিতে আবেগ কিংবা স্বার্থপরতা কাজ করেনি। ইসলাম মানুষের বাস্তবিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি নীতি ও কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ স্বাভাবিক ও ব্যক্তিগত অধিকার দিয়ে সম্পদ ব্যবহারের ভারসাম্য রক্ষার নিয়মনীতি দিয়েছে। আধুনিক যুগে ইসলামি অর্থব্যবস্থা কায়েম করা হলে বিশ্বে ফিরে আসবে শান্তি, সমৃদ্ধি ও প্রগতি।
ইসলাম যে অর্থনীতিতে সব মতবাদকে ছাড়িয়ে ছাপিয়ে, এর উদাহরণ মিলবে ইসলামের নবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনকালে। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, তখন মদিনাবাসী ছিল কৃষক। অর্থনীতিতে দরিদ্র। শিক্ষায় জ্ঞানহীন। একটা সময় তারা মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাহচর্য পেয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ হয়ে উঠে। পৃথিবীর ইতিহাসে তারা হয় অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র। গরিব-কৃষক-মজদুর সমাজ অর্থনীতিতে হয় স্বাবলম্বী। মদিনাকে গড়ে তোলে অর্থনীতিতে স্বাবলম্বী ও পৃথিবীবাসীর জন্য মাইলফলক রূপে।
অর্থনীতিতে সফল সমৃদ্ধি পেতে সেসময় ইসলামের নবি মুহাম্মাদ (সা.) দেন ১০ দফা। এই ১০ দফা অনুযায়ী বিশ্বের অর্থনীতি সাজাতে পারলে, বিশ্ব পাবে অর্থনীতিতে সুসজ্জিত নতুন এক মাত্রা। মানুষ পাবে শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি। দারিদ্র্য থেকে মুক্তি। ১০ দফা হলো—
- হালাল উপায়ে উপার্জন ও হারাম পথ বর্জন।
- সুদ বর্জন।
- ব্যবসায়িক অসাধুতা উচ্ছেদ।
- জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন।
- বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা।
- মানবিক শ্রমনীতির প্রবর্তন।
- ওশরের প্রবর্তন ও ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ইসলামিকরণ।
- উত্তরাধিকার ব্যবস্থার যৌক্তিক রূপদান।
- রাষ্ট্রের ন্যায়সংগত হস্তক্ষেপ বিধান।
- নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রবর্তন।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক