শিক্ষকের মর্যাদা সুনিশ্চিত করেছে ইসলাম। কোরআন-হাদিসে শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৫)। এর মাধ্যমে তিনি শিক্ষার গুরুত্ব ও শিক্ষকের মর্যাদার কথা তুলে ধরেছেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তার শিক্ষক হাম্মাদ (রহ.)-এর বাড়ির দিকে পা বিছিয়েও বসতেন না। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) তার শিক্ষক আবু হানিফা (রহ.)-কে খুব সম্মান করতেন। নিজ সন্তান মারা যাওয়ার পরও তার দরসে উপস্থিত ছিলেন। (তাজকিরাতুস সামে ওয়াল মুতাকাল্লিম, পৃষ্ঠা: ৮৬)
শিক্ষক সমাজের বিবেক। শিক্ষক বাঁচলে শিক্ষা বাঁচবে; শিক্ষা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। শিক্ষক দেশ গড়ার প্রধান নিয়ামক শক্তি। তার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তার বৈধ অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষা করা এবং জীবনের মান উন্নত করার ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সচেষ্ট হওয়া সময়ের দাবি। একজন প্রাজ্ঞ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শিক্ষক সমাজ বদলে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। আদর্শ শিক্ষক আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুই ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও পদ-গৌরব লোভনীয় নয়; তারা হলো—এক. ধনাঢ্য ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ ধনসম্পদ দান করেছেন এবং তা সৎপথে ব্যয় করার ক্ষমতা দিয়েছেন। দুই. ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ জ্ঞান দান করেছেন এবং সে অনুযায়ী সে কাজ করে ও অপরকে শেখায়।’ (বুখারি, হাদিস: ৭১)
সম্মানের ঐতিহ্য ও রীতি প্রাচীন: সমাজে শিক্ষককে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখার ঐতিহ্য ও রীতি বেশ প্রাচীন। শিক্ষা অনুযায়ী মানবচরিত্র ও কর্মের সমন্বয় সাধন করা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তাগিদ। জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) একবার তার বাহনে ওঠার জন্য সিঁড়িতে পা রাখলেন। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সিঁড়িটি শক্ত করে ধরলেন। এ সময় জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) বললেন, ‘হে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচাতো ভাই, আপনি হাত সরান।’ উত্তরে ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, ‘না, শিক্ষক ও বড়দের সঙ্গে এমন সম্মানসূচক আচরণ করতে হয়।’ (আল ফকিহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ, পৃষ্ঠা: ২১৯৭)
বিনয় ও সম্মান শিক্ষকের প্রাপ্য মর্যাদা: একজন শিক্ষক জ্ঞান প্রচারের মাধ্যমে সমাজের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। মুসলিম সমাজে শিক্ষককে শুধু জ্ঞানের ধারক হিসেবে নয়; বরং পথপ্রদর্শক হিসেবে সম্মান করা হয়। কারণ, তিনি মানুষকে সঠিক পথে চালিত করতে সাহায্য করেন। ইমাম আহমদ (রহ.) ইসলামি জ্ঞান, তাকওয়া ও আল্লাহভীতির দিক দিয়ে তার শিক্ষকের তুলনায় অগ্রগামী ছিলেন। তবু তিনি কখনো তার শিক্ষকের সামনে বসতেন না। বলতেন, শিক্ষকের সামনাসামনি বসার অনুমতি দেওয়া হয়নি। (তাজকিরাতুস সামে ওয়াল মুতাকাল্লিম, পৃষ্ঠা: ৭৮)
ইমাম শাফি (রহ.) ইমাম মালেক (রহ.)-এর অন্যতম শিষ্য ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি ইমাম মালেক (রহ.)-এর সামনে খুব বিনয় ও সতর্কতার সঙ্গে কিতাবের পৃষ্ঠা উল্টাতাম। খেয়াল রাখতাম, যেন তিনি শব্দ পেয়ে কোনোভাবে বিরক্ত না হন।’ (তাজকিরাতুস সামে ওয়াল মুতাকাল্লিম, পৃষ্ঠা: ৮৮)
শিক্ষকের সম্মানে বেতন-ভাতার ব্যবস্থা: উমর (রা.) ও উসমান (রা.) তাদের শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তারা শিক্ষক ও ধর্মপ্রচারকদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। আব্দুর রহমান ইবনুল জাওজি (রহ.) তার বিখ্যাত ‘সিরাতুল উমরাইন’ বইয়ে উল্লেখ করেন, উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ও উসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর যুগে মুয়াজ্জিন, ইমাম ও শিক্ষকদের সরকারি ভাতা দেওয়া হতো। (কিতাবুল আমওয়াল, পৃষ্ঠা: ১৬৫)
উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ.)-ও তার যুগে ইয়াজিদ ইবনে আবি মালেক ও হারেস ইবনে ইউমজিদ আশআরি (রহ.)-কে ওই অঞ্চলে দ্বীন শেখানোর কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। বিনিময়ে তাদের জন্য সম্মানজনক পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয়েছিল। (কিতাবুল আমওয়াল, পৃষ্ঠা: ২৬২)
আর্থিক মূল্য শিক্ষকতার মূল্যায়ন নয়: রাসুলুল্লাহ (সা.) দারুল আরকাম প্রতিষ্ঠা, গোত্রে গোত্রে শিক্ষিত সাহাবিদের পাঠানো, আসহাবে সুফফার নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধবন্দিদের মুক্তিপণ হিসেবে শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের প্রাথমিক উদ্যোগ নেন। তাই আর্থিক মূল্যমানে শিক্ষকতা পেশার পরিমাপ করা যায় না। কেননা, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় জ্ঞানীরা আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে।’ (সুরা ফাতির, আয়াত: ২৮)
আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘যারা জানে আর যারা জানে না, তারা সমান হতে পারে?’ (সুরা জুমার, আয়াত: ৯)
আল্লাহতায়ালা শিক্ষকদের বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছেন। ফলে মুসলিম সমাজে শিক্ষকমাত্রই বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের ব্যক্তি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শেখ। আর যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো, তাকে সম্মান করো।’ (আল মুজামুল আওসাত লিত তাবারানি, হাদিস: ৬১৮৪)
লেখক: সহকারী মুফতি, মারকাজুশ শাইখ আরশাদ আল মাদানি, মানিকনগর