
মানুষের জীবনে সবচেয়ে গভীর ও ব্যক্তিগত যে অনুভূতিটি আছে, তা হলো দোয়া। বিপদে-আপদে, স্বপ্নপূরণের আশায়, ব্যথায়-কষ্টে কিংবা নীরব ভালোবাসায় মানুষ একান্তে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে। দোয়া মানেই চাওয়া, আর আল্লাহই একমাত্র যিনি আমাদের সব চাওয়া পূরণ করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা সবাই দোয়া করি, কিন্তু সবার দোয়া কি কবুল হয়? অনেকেই হতাশ হয়ে বলেন, “আমি তো বহুদিন ধরে দোয়া করছি, কিছুই হচ্ছে না!" তখন প্রশ্ন আসে, দোয়া কি আসলেই কবুল হয়? নাকি আমাদের চাওয়ায় কোনো ভুল থেকে যাচ্ছে?
আল্লাহ কোরআনে বলেন, “তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।" (সুরা গাফির: ৬০) আল্লাহ আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, যে-ই তাঁকে ডাকে, তিনি তা শোনেন। কিন্তু দোয়ার উত্তর আসার একটি নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বান্দার দোয়া তিনভাবে কবুল করেন- কখনো তিনি বান্দাকে তার চাওয়া জিনিসই দেন, কখনো তার চেয়ে ভালো কিছু দেন, আবার কখনো এই দোয়ার প্রতিদান আখিরাতের জন্য সংরক্ষণ করেন (মুসনাদ আহমদ, ১১১৩৩)। অর্থাৎ, মানুষ যেটিকে ‘না পাওয়া’ মনে করে, সেটিও আসলে পাওয়ারই অংশ। কারণ আল্লাহ আমাদের জন্য যা ভালো, সেটিই নির্ধারণ করেন।
আমাদের অনেকের মধ্যেই একটা ভুল ধারণা কাজ করে, আমরা মনে করি, দোয়া মানেই তাৎক্ষণিক ফল পাওয়া। কিন্তু দোয়া কখনোই জাদুর কাঠির মতো নয়, বরং এটি পরীক্ষা, আস্থার এবং ধৈর্যের বিষয়। অনেক সময় আমরা ভাবি, ‘কেন আমার দোয়া কবুল হচ্ছে না?’ অথচ আমরা কি কখনো নিজেদের দিকে ফিরে তাকাই? হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি হারাম উপার্জন করে, হারাম খায়, তার দোয়া কবুল হয় না (মুসলিম, ১০১৫)। আমাদের রিজিক, জীবনযাপন, আত্মার শুদ্ধতা সবকিছুই দোয়া কবুলের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমরা যদি নিজেদের সংশোধন না করি, তা হলে আল্লাহর কাছে আমাদের আকুতি কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে?
দোয়া কবুলের কিছু নির্দিষ্ট সময় আছে, যখন দোয়া করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রাতের শেষ তৃতীয়াংশ, যখন আল্লাহ নিজে পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘কোনো প্রার্থনাকারী আছে কি, যে আমার কাছে চাইবে? আমি তাকে দেব।’ (বুখারি, ১১৪৫) এ সময় দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ঠিক তেমনি আজানের পর, ইফতারের সময়, বৃষ্টি নামার মুহূর্ত, জুমার দিনের বিশেষ সময়ে দোয়া করলে তা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি এই সময়গুলো কাজে লাগাই? নাকি দোয়া শুধু তখনই করি, যখন বিপদে পড়ি?
দোয়া শুধু চাওয়ার বিষয় নয়, এটি আত্মার প্রশান্তিরও মাধ্যম। আমরা যখন আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চাই, তখনই আমাদের মনের মধ্যে একটা নির্ভরতা তৈরি হয়। মনে হয়, ‘আমার চাওয়া শোনা হচ্ছে, আমি একা নই।’ তাই দোয়া কখনো বৃথা যায় না, বরং এটি আমাদের অন্তরের প্রশান্তি ও আশার প্রদীপ হয়ে থাকে। আল্লাহ কখনো আমাদের শূন্য হাতে ফেরান না, হয় দুনিয়ায়, নয়তো আখিরাতে তিনি তার প্রতিদান দেন। তাই হতাশ না হয়ে, ধৈর্য ধরে, নিজের আত্মশুদ্ধির দিকে মনোযোগ দিয়ে আমাদের দোয়া করতে হবে।
অনেক সময় আমরা চাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি, কিন্তু কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যদি কৃতজ্ঞ হও, তবে আমি তোমাদের আরও বেশি দেব।’ (সুরা ইবরাহিম: ৭) আমরা কি দোয়ার পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি? নাকি শুধু চাই, কিন্তু যে নেয়ামতগুলো ইতোমধ্যেই পেয়েছি, তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলে যাই? অনেক সময় আল্লাহ আমাদের দোয়া দেরিতে কবুল করেন, কারণ তিনি আমাদের ধৈর্য পরীক্ষা করেন। আমরা যদি ধৈর্য ধরে, দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর কাছে চাই, তা হলে কোনো দোয়াই বৃথা যাবে না।
আল্লাহ আমাদের সব নেক দোয়া কবুল করুন, আমাদের অন্তরকে তাঁর প্রতি আস্থায় পরিপূর্ণ করুন এবং আমাদের দেরিতে পাওয়া কিংবা না পাওয়ার মধ্যেও যে কল্যাণ লুকিয়ে আছে, তা বোঝার ক্ষমতা দিন। আমিন!
লেখক : শিক্ষার্থী, জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়