
রোজা শুধু উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য ফরজ নয়; বরং অতীত নবি-রাসুলদের উম্মতদের জন্যও রোজা ফরজ ছিল। যদিও এর সময়, নিয়ম-পদ্ধতি ও ধারায় অনেক ভিন্নতা ছিল।
হজরত আদম (আ.)-এর রোজা: প্রথম নবি আদম (আ.)-এর ধর্মে রোজার বিধান দেওয়া হয়েছিল বলে তাফসির গ্রন্থগুলোতে উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য সেই রোজার ধরন ও প্রকৃতি কেমন ছিল, তা জানা যায় না। এ বিষয়ে বাইবেল, কোরআন ও বিশুদ্ধ হাদিসের কিতাবেও কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে কেউ কেউ বলেছেন, আগের যুগের প্রত্যেক নবির শরিয়তেই চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখার বিধান ছিল।
হজরত নুহ (আ.)-এর রোজা: তাফসিরে ইবনে কাসিরে এসেছে, রাঈসুল মুফাসসিরিন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, মুআজ ইবনে জাবাল, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.); তাবিয়ি আতা, কাতাদা ও দহহাক (রাহ.) বর্ণনা করেন- নুহ (আ.) থেকে শেষ নবি মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক নবির যুগেই প্রতি মাসে তিনটি করে রোজা রাখার বিধান ছিল। পরে তা রমজানের রোজার বিধানের মাধ্যমে তা রহিত করা হয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির : ১/৪৯৭); তাফসিরে কুরতুবি : ২/২৭৫)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, নুহ (আ.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ছাড়া পুরো বছর রোজা রাখতেন। (ইবনে মাজাহ : ১৭১৪)
হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর রোজা: মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর যুগে ৩০টি রোজা ছিল বলে কেউ কেউ লিখেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, ইবরাহিম (আ.)-এর ওপর প্রতি রমজানের প্রথম তারিখ সহিফা অবতীর্ণ হয়। এ জন্য তিনি রমজানের এক তারিখ রোজা রাখতেন। তাঁর অনুসারীদের জন্য ১, ২ ও ৩ রমজান রোজা রাখা ফরজ ছিল। এ ছাড়া নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তির স্মরণে ১০ মুহাররম তাঁর উম্মতের জন্য রোজা রাখা ফরজ ছিল। আর কোরবানির স্মরণে ১১, ১২ ও ১৩ জিলহজসহ মোট সাত দিন ইবরাহিম, ইসমাইল ও ইসহাক (আ.)-এর উম্মতের জন্য রোজা ফরজ ছিল।
হজরত দাউদ (আ.)-এর রোজা: আসমানি কিতাব জবুরপ্রাপ্ত নবি দাউদ (আ.)-এর সময়ও রোজার প্রচলন ছিল। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় রোজা দাউদ (আ.)-এর রোজা। তিনি একদিন রোজা রাখতেন আর একদিন খেতেন।’ (সহিহ মুসলিম : ১১৫৯) অর্থাৎ, দাউদ (আ.) বছরে মোট ছয় মাস (একদিন পরপর) রোজা রাখতেন।
হজরত মুসা (আ.)-এর রোজা: আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত; রাসুল (সা.) মদিনায় হিজরত করে ইয়াহুদিদের আশুরার দিনে রোজা রাখতে দেখলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ তোমরা কীসের রোজা রাখছ?’ তারা বলল, ‘এটা সেই মহান দিন, যেদিন আল্লাহতায়ালা মুসা (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়কে বনি ইসরাইল তথা ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন। ফলে শুকরিয়াস্বরূপ মুসা (আ.) ওই দিনে রোজা রেখেছিলেন। তাই আমরাও তাঁর অনুসরণে এদিন রোজা রাখি।’ এ কথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি তোমাদের চেয়ে মুসা (আ.)-এর অধিক নিকটজন।’ এর পর তিনি এদিন রোজা রাখলেন এবং সবাইকে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (বুখারি : ২০০৪)
হজরত ঈসা (আ.)-এর রোজা: প্রথমটি হলো, তাদের পিতার উপদেশে নির্দিষ্ট কয়েক দিন খাদ্যপানীয় থেকে বিরত থাকা; আর ইফতার হবে নিরামিষ দিয়ে, তাতে মাছ-মাংস ও দুগ্ধজাত জিনিস খাওয়া যাবে না। যেমন- বড় দিনের রোজা, তাওবার রোজা, যা ৫৫ দিন পর্যন্ত দীর্ঘ হয়। এমনিভাবে সপ্তাহে বুধ ও শুক্রবারের রোজা। দ্বিতীয়টি হলো, খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা, তবে শুধু মাছ খাওয়া যেত। এই রোজার মধ্যে ছোট রোজা বা জন্মদিনের রোজা, যা ৪৩ দিন দীর্ঘায়িত হয়, দূতদের রোজা, মারইয়ামের রোজা ইত্যাদি। তবে খ্রিষ্টধর্মে ফরজ বলতে কোনো রোজা ছিল না। (তাফসিরে তাবারি : ৩/৪১১)
ঈসা (আ.) দ্বীন প্রচারের শুরুতে ইনজিল পাওয়ার আগে জঙ্গলে ৪০ দিন সিয়াম-সাধনা করেছিলেন। একদিন তাঁকে তাঁর অনুসারীরা জিজ্ঞেস করেন যে, ‘আমরা অপবিত্র আত্মাকে কী করে বের করব?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘দোয়া ও রোজা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে বের হতে পারে না।’ (মথি : ৭-৬৬; সিরাতুন্নবি : ৫/২৮৭-২৮৮)
লেখক: আলেম ও প্রাবন্ধিক