ভ্রূণ একটি বহুকোষী জীবের বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়। প্রতিটি ভ্রূণ একটি পুরুষ শুক্রাণু কোষ ও একটি মহিলা ডিম্বাণু কোষ দ্বারা নিষিক্তকরণের মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়। শুক্রাণুর বিষয়ে বিজ্ঞানের সম্প্রতি গবেষণা হলো গড়ে ‘তিন মিলিয়ন স্পার্ম তথা শুক্রাণু’র মধ্যে মাত্র একটিই ওভামকে ফার্টিলাইজ করতে যথেষ্ট। অর্থাৎ ফার্টিলাইজেশনের জন্য মাত্র ০.০০০০৩% স্পার্মই যথেষ্ট। যৌনভাবে প্রজনন করে এমন জীবগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত ভ্রূণ গঠিত হতে দেখা যায়। যা বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে উন্নতি বা পরিপূর্ণতা লাভ করে।
আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী ‘গর্ভধারণের সময় থেকে শুরু করে ৪০ সপ্তাহের মধ্যে তিনটি ত্রৈমাসিকে বিভক্ত হয়ে ভ্রূণ বৃদ্ধি পায়। তৃতীয় সপ্তাহে গর্ভবতীর মাসিক বন্ধ হয়। চতুর্থ সপ্তাহে হৃৎপিণ্ড, রক্তনালি, রক্ত এবং অন্ত্রের উৎপত্তি শুরু হয়। ষষ্ঠ সপ্তাহে চোখ এবং কান গঠনের সূত্রপাত। সপ্তম সপ্তাহে মুখমণ্ডল তৈরি হয়। ১২তম সপ্তাহে সকল অঙ্গ। যেমন- পেশি, হাড়, হাত ও পায়ের আঙুলসহ পরিণত ভ্রূণ ও জনন-অঙ্গ গঠিত হয়। ২৪তম সপ্তাহে চোখের পাতা খুলতে পারে। ২৮তম সপ্তাহে বলিষ্ঠভাবে নড়াচড়া করতে সক্ষম হয়। ৩০তম সপ্তাহে মাথা নিচ দিকে দিয়ে জন্মের জন্য প্রস্তুত হয়। এভাবে সাধারণত ৯ মাসে শিশু জন্মগ্রহণ করে; অর্থাৎ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীতে উক্ত শিশুর আগমন ঘটে।’ (দ্য ডেভেলপিং হিউম্যান)
এই ভ্রূণবিষয়ক তথ্যগুলো আধুনিক বিজ্ঞান মাত্র কিছু বছর আগে দিলেও প্রায় ১৫০০ বছর আগে এগুলোর বিষয়ে মহানবি (সা.)-এর মাধ্যমে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। যে কারণে অনেক বিশেষজ্ঞ কোরআনকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বস্তুত আধুনিক ভ্রূণতত্ত্বের (এমব্রিওলোজি) সঙ্গে কোরআনের বর্ণনার আশ্চর্য মিল রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর মানুষ কি (এক সময়) স্খলিত শুক্রবিন্দুর অংশ ছিল না? তার পর (একপর্যায়ে) তা হলো রক্তপিণ্ড, অতঃপর আল্লাহপাক (তাকে দেহ সৃষ্টি করে) সুবিন্যস্ত করেছেন। এর পর তা থেকে তিনি (আল্লাহ) স্ত্রী ও পুরুষের জোড়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা কিয়ামা, আয়াত: ৩৭-৩৯)
আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণা অনুযায়ী ভ্রূণ উন্নতি বা পরিপূর্ণতা লাভ করে বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে। ঠিক একইভাবে বিভিন্ন স্তরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে আল-কোরআনেও। যেমন নুতফা (শুক্রাণু), আলাকা (জমাট রক্ত), মুদগা (গোশতের টুকরা বা চিবানো মাংসপিণ্ড), ইযাম (হাড়) এবং পরবর্তী স্তর হচ্ছে ‘হাড়কে গোশতের দ্বারা আবৃত করা’।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে মুহাম্মদ) পড়ুন আপনার প্রভুর নামে, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে।’ (সুরা আলাক্ব, আয়াত: ১-২) এখানে আয়াতের আরবি শব্দ ‘আলাক্ব’ অর্থ জমাট রক্ত, ঝুলন্ত বস্তু বা জোঁকের মতো বস্তু। অন্য অর্থ, দৃঢ়ভাবে আটকে থাকে এমন আঠালো জিনিস। বিজ্ঞান বলে নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর দেয়ালে আটকে থাকে এবং ঝুলন্ত অবস্থায় (ইমপ্লানটেইশান স্টেজ) বেড়ে ওঠে। আধুনিক বিজ্ঞান থেকে আরও জানা যায়, ভ্রূণের প্রাথমিক অবস্থায় এটি রক্তের মতো লালচে এবং জোঁকের আকৃতির।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আমি সেই ঝুলন্ত বস্তুকে চিবানো মাংসপিণ্ডে (মুদগা) পরিণত করেছি।’ (সুরা: আল-মুমিনুন, আয়াত: ১৪) ঠিক একই কথা বলে বিজ্ঞান, ‘ভ্রূণের ২৬-২৮ দিনের মধ্যে এটি চিবানো মাংসপিণ্ডের মতো হয়।’ (দ্য ডেভেলপিং হিউম্যান)
মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে মানুষ! তোমার সৃষ্টি প্রক্রিয়াটা লক্ষ্য করো) আমি মানুষকে মাটি (মাটির মূল উপাদান) থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাকে আমি শুক্রকীট হিসেবে একটি সংরক্ষিত জায়গায় (নির্দিষ্ট সময়ের জন্য) রেখে দিয়েছি। এর পর এ শুক্রবিন্দুকে আমি এক ফোঁটা জমাট রক্তে পরিণত করি। অতঃপর এ জমাট রক্তকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করি, (কিছুদিন পর) এ পিণ্ডকে অস্থি পাঁজরে পরিণত করি, তার পর (এক সময়) এ অস্থি-পাঁজরকে গোশতের পোশাক পরিয়ে দেই। অতঃপর (বানানোর প্রক্রিয়া শেষ করে) আমি তাকে (সম্পূর্ণ) ভিন্ন এক সৃষ্টি (তথা পূর্ণাঙ্গ মানুষ) রূপে পয়দা করি; আল্লাহতায়ালা কত উত্তম সৃষ্টিকর্তা।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত: ১২-১৪)
মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান আপন মাতৃগর্ভে বীর্যের আকারে ৪০ দিন, জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয়ে ৪০ দিন, গোশত আকারে ৪০ দিন। এর পর আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে পাঠান এবং চারটি বিষয়ে আদেশ দেন, শিশুর আমল, শিশুর রিজিক, শিশুর আয়ুষ্কাল ও ভালো না মন্দ সব লিপিবদ্ধ করো। অতঃপর তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দেওয়া হয়।’ (বুখারি)
পরিশেষে বলব, কোরআন সম্পূর্ণ ঐশীবাণী। তার বড় প্রমাণ প্রায় ১৫০০ বছর আগে কোরআনে বর্ণিত ভ্রূণতত্ত্ববিষয়ক বিস্তারিত তথ্য। যখন আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্য জানার কোনো মানবীয় উপায় ছিল না। যেটা আধুনিক বিজ্ঞান মাত্র কিছু বছর আগে থেকে দিচ্ছে। আর কোরআন কোনো বিজ্ঞানগ্রন্থ নয়, তবুও কোরআনে উল্লেখ আছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব মৌলিক বিষয়। তাই কালের বিবর্তনে অ্যারিস্টটল, হিপোক্রাটাস, গ্যালনসহ কিথ মুরের মতো বিজ্ঞানীদের গবেষণা পরিবর্তন হলেও কোরআনের গবেষণার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আর এ কারণেই কোরআন সব দিক থেকে বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সুতরাং পৃথিবীর শেষ পর্যন্তও এই কোরআন গোটা মানবজাতিকে আলোর পথ দেখাতে সক্ষম।
লেখক: শিক্ষক, যশোর ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, যশোর সেনানিবাস