হজ দুনিয়ার বুকের ঐশী সফর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশ থেকেও পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন মুসলিম নর-নারীরা। বিদেশ সফরের অভিজ্ঞতা এবং হজ পালনের আমল ও বিধান সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান না থাকার কারণে পবিত্র এ সফরে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। বাংলাভাষী হাজিদের জন্য হজ পালনের প্রয়োজনীয় বিধানাবলি তুলে ধরা হলো।
হজের গুরুত্ব ও ফজিলত
হজ ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম এবং বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের জন্য এক পবিত্রতম ইবাদত। প্রতি বছর ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে মক্কা ও মদিনার পানে ছুটে যান। এই যাত্রা শুধু আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি কিংবা অতীতের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনাই নয়, বরং এটি মুমিনের ঈমান ও আনুগত্যের এক দৃঢ় বহিঃপ্রকাশ। কোরআন ও হাদিসের আলোকে হজের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম।
হজ পালন করা প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য আল্লাহতায়ালার এক সুস্পষ্ট নির্দেশ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহর জন্য মক্কা-এলাকায় হজ আদায় করা তার জন্য বাধ্যতামূলক, আর আল্লাহর জন্য মানুষের ওপর হজ করা ফরজ, যাদের সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে।’ (সুরা ইমরান, ৯৭) এই আয়াত দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে, শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলিমের জন্য হজ পালন করা ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য।
হজের মাধ্যমে বান্দা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে এবং অতীতের সব পাপ থেকে মুক্তি লাভ করার সুযোগ পায়। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ পালন করবে, সে যেন অসামাজিক কাজ এবং গুনাহ থেকে বিরত থাকে।’ (সুরা বাকারা, ১৯৭) শুধু তাই নয়, হজ এমন এক মহান ইবাদত, যা মুমিনের জীবনের সব গুনাহকে ধুয়ে-মুছে তাকে নিষ্পাপ করে তোলে।
ইসলামে হজের মর্যাদা অতুলনীয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ করবে এবং সেখানে কোনো অশ্লীলতা বা পাপ কাজ করবে না, সে তার জন্মের দিনটির মতো পবিত্র হয়ে ফিরে আসবে।’ (বুখারি, ১৫২১)
এই হাদিস হজের তাৎপর্য ও ফজিলত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয় যে, এটি পাপ মোচনের ও আত্মশুদ্ধির এক বিশেষ সুযোগ।
হজের ইতিহাস
হজ শুধু একটি ইবাদত নয়, এটি ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভ এবং মুসলমানদের জীবনে এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এই পবিত্র সফর বিশ্বজুড়ে মুসলিম উম্মাহকে এক কাতারে শামিল করে, যেখানে আল্লাহর প্রতি পরম আনুগত্য ও দাসত্বের সুর প্রতিধ্বনিত হয়। হজের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, এর গভীর তাৎপর্য এবং মানবজীবনে এর প্রভাব অনন্য।
হজের ইতিহাস সুপ্রাচীন, যা ইসলামের আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই এই অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রথা হিসেবে প্রচলিত ছিল। প্রাক-ইসলামিক যুগে আরবের বিভিন্ন গোত্র পবিত্র কাবাঘরের প্রতি অগাধ ভক্তি প্রদর্শন করত। যদিও সেই সময় শিরক ও কুসংস্কারে পরিপূর্ণ ছিল তাদের আচার-অনুষ্ঠান। কালের বিবর্তনে হজের মূলনীতি থেকে সরে গিয়ে নানাবিধ কুপ্রথা সেখানে স্থান করে নিয়েছিল।
ইসলাম আগমনের আগে কাবাঘর বিভিন্ন আরব জাতির মিলনকেন্দ্র হলেও, সেখানে পৌত্তলিকতা ও নানা অপকর্ম বিস্তার লাভ করেছিল। অশ্লীলতা, পাপাচার ও নৈতিক অবক্ষয় ছিল সেই সময়ের হজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলামের আগে হজের অনেক নিয়ম পরিবর্তিত হয়ে বিকৃত রূপ ধারণ করেছিল। যা মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বিধিবিধানের মাধ্যমে সংশোধিত হয়।
ইসলামের আগমন হজের বিধানকে সুস্পষ্টভাবে কোরআন ও হাদিসের আলোকে প্রতিষ্ঠা করে। হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা মূলত আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহীম (আ.) ও তার ছেলে হজরত ইসমাইল (আ.) কর্তৃক শুরু হয়েছিল। যখন ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর আদেশে কাবাঘরের পুনর্নির্মাণ করেন, তখনই আল্লাহ তাঁকে হজের বিধান দান করেন।
হজ না করার শাস্তি
যদি কোনো মুসলমান হজ করার মতো শারীরিক ও আর্থিক সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এই ফরজ ইবাদত পালনে অবহেলা করেন, তবে ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে তিনি গুনাহগার হবেন। কোরআন ও হাদিসে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহর জন্য মানুষের ওপর হজ করা ফরজ, যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে।’ (সুরা ইমরান, আয়াত: ৯৭) এই আয়াত স্পষ্টভাবে সামর্থ্যবানদের জন্য হজ ফরজ হওয়ার কথা উল্লেখ করে এবং যারা এই নির্দেশ অমান্য করে, তারা আল্লাহর অবাধ্য হিসেবে গণ্য হবে।
সহিহ মুসলিমের একটি হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘যে ব্যক্তি ইবাদত করার জন্য সক্ষম অথচ হজ করেনি, তার যদি মৃত্যু হয়, তবে সে যেন ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো অবস্থায় মারা গেল।’ (নাউজুবিল্লাহ)। এ হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায়, হজ পালনে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা ত্যাগ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ।
ইচ্ছাকৃতভাবে হজ না করলে আল্লাহর কাছে এর জবাবদিহি করতে হবে এবং কঠিন শাস্তি পেতে হবে । শুধু তাই নয়, হজ ফরজ হওয়ার পরও যারা তা দীর্ঘদিন ধরে এড়িয়ে চলেন, তারা আল্লাহর দয়া ও কৃপা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। ফরজ ইবাদত পালনে ইচ্ছাকৃত অবহেলা করা, আধ্যাত্মিক দিক থেকেও ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে ।
হজ কত প্রকার ও কী কী?
ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী, হজ প্রধানত তিন প্রকার। সেগুলো হলো—১. তামাত্তু। ২. কিরান। ৩. ইফরাদ।
তামাত্তু: তামাত্তু হজ হচ্ছে এমন একটি হজ, যেখানে একজন মুসলমান প্রথমে ওমরা পালন করে এবং পরে হজ পালন করেন একই বছর। এটি বিশেষভাবে ওই মুসলিমদের জন্য যারা মক্কা বা তার আশপাশে অবস্থান করছেন এবং যারা আলাদা আলাদা করে ওমরা ও হজ সম্পাদন করতে চান। তামাত্তু হজে ওমরা পালন করা হয় হজের আগে। হজ ও ওমরার মধ্যে ইহরাম খুলে দেওয়া হয় এবং পরে আবার নতুন করে ইহরাম বাঁধতে হয়। এ ধরনের হজ সাধারণত আলাদা আলাদা সময়ে পালিত হয়, তবে তা একই বছরেই করতে হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তামাত্তু হজ হলো সর্বোত্তম হজ।’ (মুসলিম, ১২১১)
কিরান: কিরান হজ হলো এমন হজ যেখানে একজন মুসলমান ওমরা ও হজ একত্রে করেন, কিন্তু তার মধ্যে ইহরাম খুলে দেওয়া হয় না। অর্থাৎ একজন মুসলমান ইহরাম বাঁধে এবং তা পুরো হজ ও ওমরা পালনকালীন অবস্থায় থাকে। কিরান হজে ওমরা এবং হজ একই সঙ্গে পালিত হয়, কিন্তু ইহরাম খুলে দেওয়ার সুযোগ থাকে না। ওমরা ও হজ একত্রে পালন করা হয়। হজের সময় ইহরাম খুলে দেওয়ার সুযোগ নেই। এটি তামাত্তু থেকে কঠিন হলেও, বেশির ভাগ মুসলমান কিরান হজ পছন্দ করেন। কারণ এটি একটি সম্মানজনক পদ্ধতি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিরান হজ করলে ইহরাম একবারেই থাকতে হবে এবং ওমরার পরেই হজ পালিত হবে।’ (বুখারি)
ইফরাদ: ইফরাদ হজ হলো একমাত্র হজ পালন করা, যেখানে একজন মুসলমান কেবল হজ পালন করেন এবং ওমরা করার প্রয়োজন হয় না। এটি সাধারণত মক্কা থেকে দূরবর্তী অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য যারা প্রথমবারের মতো হজে যান। এ হজে ওমরা পালনের প্রয়োজন নেই। শুধু হজ পালন করা হয়। এটি ওইসব মুসলমানদের জন্য সহজ, যারা হজের আগে ওমরা করতে ইচ্ছুক নন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হজ হলো একটাই, তবে এটি করার আগে যদি কোনো বাধা না থাকে, তবে তুমি ওমরা করতে পারো।’ (মুসলিম)
হজের ফরজ ও ওয়াজিব
হজ ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি। হজ শুধু শারীরিক ইবাদত নয়; এটি আত্মিক পরিশুদ্ধি, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা এবং তাওহিদের পূর্ণ প্রকাশ। একজন মুসলমানের জীবনে একবার হজ ফরজ হয়, যদি সে আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান হয়। কিন্তু অনেকেই জানেন না—হজ পালনের কিছু নির্দিষ্ট ফরজ ও ওয়াজিব কাজ আছে, যেগুলো সঠিকভাবে না করলে হজ শুদ্ধ হয় না।
ফরজ কাজ (৩টি): ‘ফরজ’ হলো এমন কাজ, যা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করলে হজ বাতিল হয়ে যায়। হজে তিনটি ফরজ রয়েছে। আর তা হলো,
১. ইহরাম বাঁধা ও নিয়ত করা: হজ শুরু করার আগে ইহরাম বাঁধা ও হজের নিয়ত করা আবশ্যক।
২. আরাফাতে অবস্থান (ওকুফে আরাফা): ৯ জিলহজ দিন আরাফার ময়দানে অবস্থান করা হজের মূল রোকন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হজ হলো আরাফা।’ (তিরমিজি, ৮৯১)।
৩. বিদায়ি তাওয়াফ (তাওয়াফে বিদা): মক্কা ত্যাগ করার আগে কাবাঘর শেষবার তাওয়াফ করা ফরজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সবার শেষ আমল হোক বাইতুল্লাহর তাওয়াফ, তবে হায়েজ (ঋতুমতী) নারীরা ব্যতীত।’ (মুসলিম, ১৩২৮)
ওয়াজিব কাজ (৬টি): ‘ওয়াজিব’ এমন কাজ, যা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করলে দম (কোরবানি) দিতে হয়, তবে হজ বাতিল হয় না। হজের ছয়টি ওয়াজিব কাজ রয়েছে। আর তা হলো,
১. মুজদালিফায় অবস্থান: ৯ জিলহজ রাতে আরাফা থেকে ফেরার পর মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। হাদিসে এসেছে, এক সাহাবি বলেছেন, ‘আমি দেখেছি রাসুলুল্লাহ মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে পড়ে রাত কাটিয়েছেন মুজদালিফায়।’ (বুখারি, ১৬৭৫)।
২. জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা: ১০, ১১, ১২ (বা ১৩) জিলহজ শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ করা। ‘তোমরা আমার কাছ থেকে হজের কর্মপদ্ধতি শিখে নাও।’ (মুসলিম, ১২৯৭)।
৩. কোরবানি করা: তামাত্তু ও কিরান হজ করলে কোরবানি ওয়াজিব। (সুরা বাকারা, ১৯৬)।
৪. হালক বা কসর করা: পুরুষদের মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছোট করা ও নারীদের হালকা কাটতে হয়।
৫. সাঈ করা (সাফা-মারওয়া): তাওয়াফের পর সাফা ও মারওয়ার মধ্যে সাতবার দৌড়ানো। ‘নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা বাকারা, ১৫৮)।
৬. বিদায়ি তাওয়াফ করা: বিদায়ি তাওয়াফ শেষ করে মাকামে ইবরাহিমের কাছে দুই রাকাত নামাজ পড়াও ওয়াজিব।
লেখক: আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক