
জিলহজ মাস মুসলিম উম্মাহর জন্য এক বিশেষ মহিমা ও ইবাদতের মাস। এই মাসে আল্লাহর মহিমা ঘোষণার জন্য কোরআন ও হাদিসে এক বিশেষ জিকিরের কথা বলা হয়েছে, যা শরিয়তের পরিভাষায় তাকবিরে তাশরিক নামে পরিচিত। এই তাকবিরের গুরুত্ব অপরিসীম এবং এর বিধানগুলো সঠিকভাবে জানা প্রতিটি মুসলিমের জন্য জরুরি।
তাকবিরে তাশরিক কী?
তাকবিরে তাশরিক হলো: আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
বাংলা অর্থ হলো: আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোনো ইলাহ নেই। আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; সব প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য।
তাকবিরে তাশরিকের গুরুত্ব ও ফজিলত
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যেন তারা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।’ (সুরা হজ, ২৮)। বিখ্যাত সাহাবি রইসুল মুফাসসিরিন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে নির্দিষ্ট দিন বলতে আইয়ামে তাশরিক (জিলহজের ৯ থেকে ১৩ তারিখ) এবং আল্লাহর স্মরণ বলতে তাকবিরে তাশরিক বোঝানো হয়েছে। (সহিহ বুখারি)
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকবিরে তাশরিকের ফজিলত সম্পর্কে বলেন, ‘(আইয়ামে তাশরিকের) এই দিনগুলোতে তাকবিরে তাশরিকের আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমল উত্তম নয়।’ সাহাবিরা জানতে চাইলেন, আল্লাহর পথে লড়াইও কি (এর চেয়ে উত্তম) নয়? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহর পথে লড়াইও নয়। তবে সে ব্যক্তির কথা ভিন্ন, যে নিজের জানমালের ঝুঁকি নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় লড়াইয়ে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না। (সহিহ বুখারি, ৯৬৯)। এই হাদিস তাকবিরে তাশরিকের অপার ফজিলতের ইঙ্গিত বহন করে।
তাকবিরে তাশরিক কখন পড়বেন
তাকবিরে তাশরিকের সময়কাল ৯ জিলহজ ফজর থেকে শুরু হয়ে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর এটি পড়া আবশ্যক। জামাতে নামাজ আদায় করা হোক বা একাকী, ওয়াক্তের মধ্যে পড়া হোক বা কাজা, নামাজি ব্যক্তি মুকিম (স্থায়ী বাসিন্দা) হোক বা মুসাফির (পর্যটক), শহরের বাসিন্দা হোক বা গ্রামের, নারী হোক বা পুরুষ সবার ওপর ফরজ নামাজের পর একবার তাকবিরে তাশরিক বলা ওয়াজিব। (দুররে মুখতার, ২/১৮০)
তাকবিরে তাশরিক কীভাবে পড়বেন
১. পড়ার সঠিক নিয়ম: প্রতি ফরজ নামাজের সালাম ফেরানোর পরপরই, কোনো কথাবার্তা বা নামাজ পরিপন্থী কোনো কাজ করার আগেই তাকবিরে তাশরিক পড়তে হবে। (রদ্দুল মুহতার, ২/১৮০)
২.উচ্চস্বরে ও নিচুস্বরে: পুরুষরা উচ্চস্বরে একবার পড়বেন, আর নারীরা নিচুস্বরে পড়বেন, যাতে শুধু তারা নিজে শুনতে পান। (ফাতাওয়া শামি: ২/১৭৮)
৩. ভুলে গেলে: যদি কেউ নামাজের পর তাকবির বলতে ভুলে যান। পুরুষেরা মসজিদ থেকে বের হওয়ার আগে এবং নারীরা নামাজের স্থান ত্যাগ করার আগে তা মনে পড়লে তাকবির আদায় করে নিতে হবে। তবে যদি মসজিদ বা নামাজের স্থান থেকে বের হয়ে যান, তাহলে এই ওয়াজিব ছুটে যাবে। আর এই ওয়াজিবের কোনো কাজা নেই এবং ওয়াজিব ছেড়ে দেওয়ার কারণে ওই ব্যক্তি গুনাহগার হবেন। (মাবসুত সারাখসি, ২/৪৫)
৪. কাজা নামাজে: ৯ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত কোনো নামাজ কাজা হয়ে গেলে এবং সে কাজা নামাজ যদি এই দিনগুলোর মধ্যেই আদায় করা হয়, তাহলে সেই কাজা নামাজের পরও তাকবিরে তাশরিক পড়তে হবে। (ফাতাওয়া শামি: ২/১৭৮)।
৫. ছুটে যাওয়া রাকাত: যদি কোনো ব্যক্তির জামায়াতে নামাজ আদায়কালে প্রথম দিকে এক বা একাধিক রাকাত ছুটে যায়, তাহলে ইমাম সাহেব সালাম ফেরানোর পর ওই ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নিজের নামাজ আদায় করার পর তাকবিরে তাশরিক বলবেন। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২)।
৬. ইমামের ভুলে গেলে: জামাতে নামাজ আদায় করার ক্ষেত্রে ইমাম সাহেব তাকবির বলতে ভুলে গেলে ইমামের জন্য অপেক্ষা না করে মুক্তাদিদের তাকবির বলা উচিত। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২)।
৭. কতবার পড়বেন: তাকবিরে তাশরিক একবার পড়া ওয়াজিব। তিনবার বলার কোনো ভিত্তি নেই। সুন্নত মনে করে তিনবার পড়লে মাকরুহ হবে। (ফাতাওয়া নাওয়াজেল: ১৪/৫৯৪)
তাকবিরে তাশরিক জিলহজ মাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল। এর সঠিক নিয়ম জেনে ও বুঝে তা আদায় করার মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় এবং অশেষ সওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে এই গুরুত্ব আমল সঠিকভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন । আমিন।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক