
তৎকালীন আরব সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথা ছিল, বিশেষত মক্কার সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোতে, নবজাত শিশুদের জন্মের পর মরুভূমির উন্মুক্ত পরিবেশে লালন-পালন করা। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের বিশুদ্ধ বাতাস ও বেদুইনদের সংগ্রামী জীবনধারার সংস্পর্শে শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তোলা। এই প্রথা অনুসারেই মক্কায় জন্মগ্রহণকারী শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর জন্মের আট অথবা দশ দিন পর বনু সাদ গোত্রের মহীয়সী নারী হালিমা সাদিয়ার (রা.) তত্ত্বাবধানে প্রেরণ করা হয়। বনু সাদ ছিল তায়েফ শহর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি মরু অঞ্চল।
দুধমাতা হালিমা (রা.) পরম স্নেহ ও যত্নের সাথে দীর্ঘ দুই বছর মহানবি (সা.)-কে লালন-পালন করেন। দুই বছর বয়স সমাপ্ত হতেই নবি মুহাম্মদ (সা.) দুধ ছাড়েন। আর সময় তার স্বাভাবিক গতিতে ৫৭৩ সালে পৌঁছলেও হালিমা (রা.)-এর কাছে মনে হলো এই সময়টুকু তাঁর কাছে অন্য সময়ের তুলনায় খুব দ্রুতই পার হয়েছে। হালিমা (রা.) গভীর বিষাদে আপ্লুত হন।
সে সময়ের আরবীয় রীতি অনুযায়ী, দুধ ছাড়ানোর পর নবি মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর মাতা আমেনা বিনতে ওহাবের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। এই বিদায়কালে দুধমাতা হালিমা (রা.), তাঁর দুধভাই আবদুল্লাহ এবং দুধবোন সায়মা অত্যন্ত ব্যথিত ও মর্মাহত হন। ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করেন, দুগ্ধপোষ্য শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে স্তন্যপান থেকে বিরত করার সময় মা হালিমার গভীর কান্না, আবেগ ও ভালোবাসায় অভিভূত হয়ে মা আমেনা তাঁকে আরও কিছুকাল তায়েফের বনু সাদ অঞ্চলে লালন-পালনের জন্য পুনরায় তাঁর কাছে অর্পণ করেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম: ১/ ১৬২- ১৬৪)
নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর দুধ ছাড়ার অব্যবহিত পরই তাঁর পবিত্র মুখে স্পষ্ট ও বিশুদ্ধ উচ্চারণে প্রথম কথা ফোটে। হালিমা (রা.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী, শিশু মুহাম্মদ (সা.) সর্বপ্রথম যে বাক্যগুলো উচ্চারণ করেছিলেন তা হলো: ‘আল্লাহু আকবর কাবিরা, ওয়াল হামদুলিল্লাহি হামদান কাসিরা, ওয়া সুবহানাল্লাহি বুকরাতাও-ওয়া আসিলা’ (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, অতি মহান; সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, বহু প্রশংসা এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ পবিত্র)। (খাসাইসে কুবরা : ১/৫৫)
অন্য সাধারণ শিশুদের তুলনায় এই শিশুই ছিলেন অধিক হৃষ্টপুষ্ট ও সুগঠিত। শিশুরা সাধারণত যে বয়সে ভাষা রপ্ত করে, সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নবি মুহাম্মদ (সা.) বনু সাদের বিশুদ্ধ পরিবেশে লালিত হন। তৎকালীন আরব সমাজে বনু সাদ গোত্রের ভাষাগত দক্ষতা, অলঙ্কারপূর্ণ বাগ্মিতা এবং উচ্চমানের সাহিত্যচর্চার বিশেষ খ্যাতি ও স্বীকৃতি ছিল। নবি মুহম্মদ (সা.) পরবর্তী সময়ে তাঁর সাহাবিদের কাছে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করে বলতেন, ‘আমি তোমাদের তুলনায় অধিক বিশুদ্ধ ভাষী কোরাইশি এবং আমি সাদ ইবনে বকর গোত্রের দুধ পান করেছি।’ (নবীয়ে রহমত, পৃ: ১১৪)
নবি মুহাম্মদ (সা.) অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও চমৎকারভাবে কথা বলতেন, যার ফলে শোনা মাত্রই তাঁর বক্তব্য সহজে অনুধাবন করতে পারত। তিনি কখনো কর্কশ বা রূঢ় ভাষায় কারও সাথে কথা বলতেন না এবং কাউকে অশালীনভাবে সম্বোধনও করতেন না। তাঁর চালচলন এবং কথা বলার ভঙ্গিও ছিল অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র ও স্মরণীয়। শৈশবকাল থেকেই তাঁর মিষ্টি ও সত্যপূর্ণ কথা সবার মন জয় করে নিত এবং সবাই তাঁকে ভালোবাসত। সত্যবাদিতা তাঁর শৈশব থেকেই সর্বজনবিদিত ছিল। হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘তোমরা যত দ্রুত কথা বলো, তিনি তত দ্রুত বলতেন না। তিনি থেমে থেমে কথা বলতেন, যাতে প্রত্যেক শ্রোতা তাঁর কথা বুঝতে পারত।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩,৬৩৯)
হালিমা সাদিয়া (রা.) নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর অসাধারণ দৈহিক বিকাশের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর শারীরিক বৃদ্ধি অন্য শিশুদের তুলনায় অনেক উন্নত ছিল। এমনকি দুই বছর বয়সেই তাঁকে বেশ বড়সড় দেখাচ্ছিল।’ (সিরাতে খাতুল আম্বিয়া, পৃ: ৭)
নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর শৈশবকাল ছিল পূর্ণ পরিপক্বতা, মাধুর্য এবং নৈতিক শিক্ষা ও চরিত্রের উজ্জ্বল প্রতিফলন। বনু সাদের মরুপ্রান্তরে যে আলো ছড়িয়েছিল একটি শিশু, সেটি ছিল সারা মানবতার আলোকবর্তিকা ও মহান শিক্ষা।
লেখক : আলেম ও সাংবাদিক