
হজ, ইসলামের এক সুমহান স্তম্ভ, যা মুসলিমের জীবনে বড় পরিবর্তন আনে। এটি কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক সুমহান পথ। হজ-পরবর্তী নতুন জীবন কেমন হওয়া উচিত, তা নির্ভর করে হজের শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতাকে একজন ব্যক্তি কতটা ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে।
পাপমুক্ত জীবন ও আল্লাহর স্মরণ
হজ শেষে একজন হাজিকে পাপমুক্ত জীবনযাপন করতে হবে। অসৎ কর্ম পরিহার করে সৎকর্মে নিমগ্ন থাকা এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য সচেষ্ট থাকা হজের মূল উদ্দেশ্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নির্ধারিত মাসগুলোতে হজ সম্পন্ন করো। এই মাসগুলোতে যে ব্যক্তি নিজের ওপর হজ ফরজ করে নিল, তার জন্য গালাগাল, কলহ বা পাপ কাজ করা উচিত নয়। আর যেকোনো ভালো কাজ তুমি করো, আল্লাহ তা জানেন।’ (সুরা বাকারা, ১৯৭) এই আয়াত হজের সময় ও পরবর্তী জীবনে পাপ, কলহ এবং অন্যায় থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেয়।
আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তোমরা যখন হজের কার্যাবলি শেষ করবে, তখন আল্লাহকে তেমনিভাবে স্মরণ করবে, যেভাবে নিজেদের বাপ-দাদাকে স্মরণ করে থাক; বরং তার চেয়েও বেশি স্মরণ করবে।’(সুরা বাকারা, ২০০) এটি নির্দেশ করে যে হজের পর নতুন জীবনে আল্লাহর স্মরণ ও কৃতজ্ঞতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া উচিত। আল্লাহর জিকির ও শুকরিয়া হজের পর জীবনের নিত্যসঙ্গী হবে।
আত্মশুদ্ধি, আনুগত্য ও দৈনন্দিন ইবাদত
হজের পর একজন হাজিকে অতীতের পাপ থেকে তওবা করে নতুন জীবন শুরু করতে হবে। হজের সময় অর্জিত পবিত্রতা ধরে রাখা অপরিহার্য। হজ আত্মশুদ্ধির এক অপূর্ব সফর, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে আত্মসমর্পণ, আনুগত্য, ত্যাগ, ধৈর্য এবং আত্মিক নবজাগরণের শিক্ষা নিহিত।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রোজা, জাকাত ও দোয়া হজ-পরবর্তী জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া উচিত। হজের সময় অর্জিত নিয়মানুবর্তিতা দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। মক্কা-মদিনার পবিত্র ভূমিতে নবীদের দুঃখ-কষ্ট স্মরণ করে হৃদয়ে আল্লাহর ফয়সালার প্রতি গভীর আস্থা তৈরি হয়, যা তাকদিরে সন্তুষ্ট থাকার এক অনুপম গুণ।
সামাজিক সম্পর্ক ও হালাল জীবিকা
পরিবার, প্রতিবেশী ও সমাজের সঙ্গে শান্তি ও সদ্ভাব বজায় রাখা হজের অন্যতম শিক্ষা। হজের সময় যে মমত্ব ও একত্ববোধ তৈরি হয়, তা জীবনে প্রতিফলিত করা উচিত। সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনেও হজের শিক্ষার প্রভাব থাকা প্রয়োজন। হারাম উপার্জন ইবাদতের স্বাদ নষ্ট করে দেয়, তাই বাইতুল্লাহর সফরে যাওয়া ব্যক্তির জীবিকা হবে হালাল, সততা ও নিষ্ঠায় ভরপুর।
ধৈর্য, দানশীলতা ও পবিত্রতা
হজের স্মৃতি ধরে রাখতে দানশীলতা ও সদকার পরিমাণ বৃদ্ধি করা উচিত। হজের সময় অর্জিত ত্যাগের মনোভাব দানের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব। হজরত হাজেরা (আ.)-এর সাফা-মারওয়ায় দৌড়ানোর ঘটনা সংকটের মধ্যেও ধৈর্য ও নির্ভরতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হজ আমাদের শেখায় বাইতুল্লাহর মতো নিজেদের মনকেও শিরক, হিংসা, গিবত ও অহংকারের ময়লা থেকে মুক্ত রাখতে। বাইরের পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি অন্তরের শুদ্ধতাও অপরিহার্য।
হজ কেবল একটি যাত্রা নয়, এটি একটি জীবনব্যাপী শিক্ষা যা আমাদের জীবনের প্রতিটি দিকে প্রভাব ফেলে। হজের সময় আমরা একত্ব, ত্যাগ, ধৈর্য, ভ্রাতৃত্ববোধ ও আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের শিক্ষা লাভ করি। এই শিক্ষাগুলো হজ-পরবর্তী জীবনে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রয়োগ করাই হজের সার্থকতা।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক