
‘বিরোধ’ অর্থ হলো মতপার্থক্য, বৈষম্য, শত্রুতা, দ্বন্দ্ব, কলহ, যুদ্ধ, অনৈক্য, প্রতিকূলতা ইত্যাদি। বিরোধ বলতে ‘কোনো কাজ বন্ধ করার জন্য তার বিপরীতে কিছু করা বা আমরা চাই না এমন কোনো কাজের বিরোধিতা করা।’ সমাজের সর্বত্রই মতপার্থক্য বা বিরোধ কম-বেশি বিদ্যমান। পরিবারে একে অন্যের মধ্যে বিরোধ, পাড়া-প্রতিবেশী বা সমাজে পরস্পর পরস্পরে বিরোধ, সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে বিরোধ, ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে দরকষাকষি নিয়ে বিরোধ, রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরোধ, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বিরোধ, বিরোধ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বিরোধ থেকে বিশৃঙ্খলা, মারামারি, সংঘাত সৃষ্টি হয়। পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক পরিবেশ নষ্ট হয়। দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। ছোট ছোট বিরোধ থেকে ধীরে ধীরে বড় বড় সংঘাত-বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সুতরাং বিরোধ যত দ্রুত নিরসন করা যায় ততই ভালো।
যেখানে বিরোধ থাকবে সেখানেই তা সমাধানের পথও থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীর যেখানেই বিরোধ লাগুক, সেখানেই কিছু মানুষ বিরোধ নিষ্পত্তি বা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসেন। সালিশ বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করেন। এতে সমাধান না হলে মানুষ আইনের দ্বারস্থ হয়। আইনের বিভিন্ন ধারায় বিরোধ নিষ্পত্তি করা যায়। বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতাকারী, সালিশ ব্যক্তি, আইন-আদালত সবই রয়েছে।
বিরোধ নিষ্পত্তি হলো একটি প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোকে আলোচনা, মধ্যস্থতা, আদালত বা অন্য কোনো আইনসম্মত পদ্ধতির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত সমাধান করা হয়। আমাদের দেশে তিনটি নিয়মে বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়-
১. পক্ষগণ কারও সাহায্য ছাড়া নিজেরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় উপনীত হয়ে যায়।
২. পক্ষগণের মধ্যে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি মধ্যস্থতাকারী নিযুক্ত হন এবং কোনো ধরনের বলপ্রয়োগ বা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া ব্যতীত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষকে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেন।
৩. তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আদালত বা কোনো মধ্যস্থতাকারী বডি থাকে। যেখানে পক্ষগণকে সমঝোতায় এনে সমাধান প্রণয়ন করা হয়।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় সালিশ, গ্রাম আদালত এবং মুসলিম পারিবারিক আইনে সালিশ বা মধ্যস্থতার বিধান রয়েছে। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫-এর মধ্যে মামলার বিচারের শুনানির পূর্বে আদালতের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে আপস বা সমঝোতার মাধ্যমে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করার, এমনকি বিচার শেষ হওয়ার পরও রায় প্রদানের পূর্বে সালিশ বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধানের বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে পারস্পরিক সমঝোতায় একটি জটিল সমস্যাও সহজে সমাধান করা যায়। আইনসিদ্ধভাবে বিকল্পভাবে পক্ষগণের বিরোধ বা সমস্যা নিরসন করা যেতে পারে। যাকে ইংরেজিতে Alternative Dispute Resolution (ADR) বলা হয়। এ পদ্ধতিতে পক্ষগণকে পরস্পরের সম্মুখে বসিয়ে মধ্যস্থতাকারীরা ঘটনার আর্থসামাজিক ও মানসিক কারণ খুঁজে বের করেন। ক্ষতিগ্রস্ত কী প্রতিকার চায় তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় এবং ভবিষ্যতে যেন অপরাধ সংঘটিত না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখা হয়। সার্বিক দিক বিবেচনায় একটি বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তিকল্পে ওই পদ্ধতি দিন দিন জনগণের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সালিশান বা বিচারক বিশুদ্ধ নিয়তে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পক্ষগণের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করতে করেন। নিরপেক্ষভাবে ইনসাফভিত্তিক সমাধানে এগিয়ে আসেন। এ ক্ষেত্রে কোনো পক্ষকে গায়েল করা বা কোনো পক্ষকে প্রাধান্য দেওয়া কোনোভাবেই সমীচীন নয়। কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, চতুর প্রতিপক্ষের কাছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল-অসহায় অন্যপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর নানা কারণের মধ্যে রয়েছে, একপক্ষের চতুরতা, সালিশানদের তথ্য যাচাইয়ে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি, উৎকোচ গ্রহণ ইত্যাদি।
বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতাকারী বা সালিশানের উচিত হলো, উভয়পক্ষের অভিযোগ মনোযোগসহকারে শোনা এবং এর সত্যতা যাচাই করা। ইনসাফভিত্তিক সমাধানে এগিয়ে আসা। কোনোভাবেই স্বজনপ্রীতি না করা। কোনো পক্ষের কাছ থেকে হাদিয়া-তোহফা বা উৎকোচ গ্রহণ না করা। ইসলামের দৃষ্টিতে উৎকোচ বা ঘোষ আদান-প্রদান করা সুদ, চুরি-ডাকাতি, জিনা-ব্যভিচারের মতো হারাম ও অবৈধ কাজ। কোরআনে কারীমে ঘুষদাতা বা গ্রহণকারীকে সীমা লঙ্ঘনকারী, পাপিষ্ঠ ও নিকৃষ্ট বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের অনেককেই তুমি দেখবে পাপে, সীমা লঙ্ঘনে ও অবৈধ ভক্ষণে তৎপর; তারা যা করে নিশ্চয় তা নিকৃষ্ট।’ (সুরা মায়েদা, ৬২)।
ঘুষের প্রচলন মানুষের নীতি-নৈতিকতা নষ্ট করে দেয়। ঘুষের মাধ্যমে অবৈধ ও অনৈতিক কাজ বেড়ে যায়। অনেক সময় চতুর প্রতিপক্ষ অন্যায় করে মধ্যস্থতাকারীকে উৎকোচ দিয়ে পার পেয়ে যায়। মধ্যস্থতাকারী ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণ করে অন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয়। ফলে অন্যপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা জুলুমের নামান্তর। ঘুষ আদান-প্রদানের চূড়ান্ত পরিণাম জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। আল্লাহতায়ালা বলেন- ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে-বুঝে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারককে উৎকোচ দিও না।’ (সুরা বাকারা, ১৮৮)।
রাসুল (সা.) ঘুষদাতা এবং গ্রহীতার ওপর অভিসম্পাত করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ঘুষ আদান-প্রদানকারী উভয়ে জাহান্নামে যাবে।’ (তাবরানি)।
বিরোধ নিরসনের জন্য সালিশ বা মধ্যস্থতাকারী আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। অপরাধ ও অপরাধীর পক্ষ ত্যাগ করা। অন্তরে হৃদ্যতা ও ভালোবাসা লালন করা। পক্ষগণের ভালো-মন্দের বিবেচনা করা। বিরোধ নিরসনে অনুকূল গুণাবলি ধারণ করা এবং প্রতিকূল স্বভাব ত্যাগ করা। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহর দয়ায় তুমি তাদের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছিলে। যদি তুমি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদের ক্ষমা করো এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং কাজে-কর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা আলে ইমরান, ১৫৯)।
যাদের মধ্যে বিরোধ তারা উভয়পক্ষ অবশ্যই নিজ স্বার্থবিরোধী সত্য মেনে নিতে হবে। আক্রমণাত্মক আচরণ পরিহার করতে হবে। উভয়পক্ষ বিরোধ নিরসনের ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা নিসা, ৩৫)।
লেখক: শিক্ষক ও প্রবন্ধকার