
সন্তান জন্মের আনন্দ প্রতিটি পরিবারে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। জন্মনিবন্ধন, নাম রাখা, মিষ্টি বিতরণ ও দোয়া অনুষ্ঠান এসবই আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। তবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সুন্নত, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে প্রায় বিস্মৃত, তা হলো তাহনিক।
তাহনিক কী?
তাহনিক হলো সদ্যোজাত শিশুর মুখে নরম ও মিষ্টিজাতীয় খাদ্য, বিশেষত খেজুর, চিবিয়ে দিয়ে দেওয়া। এটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সুন্নত। তিনি নিজ হাতে চিবানো খেজুর শিশুর তালুতে মাখিয়ে দিতেন এবং শিশুর জন্য বরকতের দোয়া করতেন।
হাদিসের আলোকে তাহনিক
তাহনিকের গুরুত্ব একাধিক সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে আবু ত্বালহা জন্মগ্রহণ করলে আমি তাকে নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে গেলাম। রাসুলুল্লাহ তখন খেজুর নিয়ে মুখে চিবালেন এবং তা শিশুর মুখে দিলেন। শিশুটি তৎক্ষণাৎ মুখ নাড়াতে শুরু করল। রাসুলুল্লাহ বললেন, ‘আনসারদের খেজুর ভালোবাসা সত্যিই প্রগাঢ়।’ পরে রাসুলুল্লাহ তার নাম রাখলেন আবদুল্লাহ।’ (মুসলিম ও বায়হাকী)
আরেক হাদিসে হযরত আবু মূসা (রা.) বলেন, ‘আমার একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করলে আমি তাকে সঙ্গে করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি তার নাম রাখলেন ইবরাহীম এবং একটি খেজুর দিয়ে তিনি তার তাহনিক করলেন, আর তার জন্য বরকতের দোয়া করলেন। অতঃপর তাকে আমার কোলে ফিরিয়ে দিলেন।’ (বুখারি, মুসলিম)
তাহনিকের বৈজ্ঞানিক উপকারিতা
আধুনিক বিজ্ঞানও তাহনিকের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে। নবজাতকের দেহে জন্মের পর রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা শিশুর মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। মিষ্টিজাতীয় খাদ্য, বিশেষত খেজুর, গ্লুকোজের একটি তাৎক্ষণিক এবং প্রাকৃতিক উৎস। সদ্য-প্রসূত শিশুকে মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়ালে তার পাকতন্ত্রে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া ভালোভাবে শুরু হয় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। এটি শিশুর শরীরে শক্তি জোগায় এবং বিভিন্ন জটিলতা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
শারীরিক উপকারিতার পাশাপাশি রাসুলুল্লাহ (সা.) এই অভ্যাসের মাধ্যমে শিশুদের জীবনের শুরুতেই একটি পবিত্র স্পর্শে বরকতের বীজ বপন করেছেন। তিনি শুধু খাদ্যই দেননি, বরং এর সাথে দোয়াও করেছেন। এক অর্থে এটি নবজাতকের শারীরিক ও আত্মিক পরিচর্যার এক যুগান্তকারী রীতি।
আজকের সমাজে তাহনিক
এক সময় আমাদের সমাজেও কোনো নেককার আলেম বা বুজুর্গের মাধ্যমে তাহনিক করানোর প্রচলন ছিল। তবে দুঃখজনকভাবে বর্তমানে এই সুন্নত প্রায় বিলপ্ত। অথচ সন্তানকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দেখানো পথে মানুষ করতে চাইলে এবং তাদের জীবনকে সুন্নাহর আলোয় উদ্ভাসিত করতে চাইলে তাহনিক যেমন একটি চমৎকার সূচনা, তেমনি শারীরিক ও আত্মিক কল্যাণের এক অনন্য দ্বার। এই সুন্নতকে পুনরায় সমাজে প্রচলিত করার মাধ্যমে আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য এক সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারি।
লেখক : আলেম ও সাংবাদিক