লোকে আমাদের লাল পিঁপড়ে বলে ডাকে। কিন্তু এই নামটা আমাদের জাতিগত। আমাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। যেমন আমার নাম কুট্টুস। আমার জন্ম স্যাঁতস্যাঁতে একটি মাটির ঢিবিতে। জন্মের পর জানতে পারলাম, আমাদের মাটির ঘরে ক্ষণিক আগে কোনো মহামানব জল বিয়োগ করেছেন। ফলে আকাশে প্রচুর রোদ থাকার পরও বন্যার মতো স্রোতে ভেসে গেছে আমাদের ঘর। আমার বাবা-মা ও অন্য প্রতিবেশীরা তখন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। আমাদের প্রতিবাদের ভাষা তার কান অবধি পৌঁছাবে না বলে আমরা ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে অনত্র চলে গেলাম। সেটাও আমাদের পায়ের হিসেবে প্রায় ১০ মাইল দূরে।
জন্মের পর এ রকম বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে আমি খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। এখানে এসে কেউ কেউ নতুন ঘর বানাতে লাগল। আর কেউ গেল খাবারের সন্ধানে। জন্মের পর আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমার পরিবারটি তেমন অবস্থাসম্পন্ন নয়। কারণ আমাদের কোনো খাবারই মজুত ছিল না। তাই আমাকে প্রতিবেশীদের কাছে রেখে বাবা-মা দুজনই গেলেন খাবারের সন্ধানে। বিশেষ করে সামান্য মিষ্টান্নের খোঁজ যদি পায়, কারণ আমার জন্ম উপলক্ষে বাবা-মা কাউকেই মিষ্টিমুখ করাতে পারেননি।
এর পরবর্তী ঘটনা আমার বাবার মুখ থেকে শোনা। বাবা-মা দুজনই হেঁটে প্রায় পাঁচ মাইল পথ অতিক্রম করেছিলেন। হঠাৎ অন্য জাতির (কালো পিঁপড়া) কিছু পিঁপড়েকে মুখে খাবার নিয়ে হন্দদন্ত হয়ে ছুটতে দেখে বাবা-মাও সেদিকে ছুটেছিলেন। কিছু দূর এগোতেই দেখলেন একটি বড় মিষ্টির পলিথিনে অনেক শিরা লেগে আছে। যা দিয়ে দুই জাতির কমপক্ষে ৫০ হাজার পিঁপড়ের খাবারের ব্যবস্থা হতে পারে। বাবা ঠোঙার বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। মা ঠোঙার ভেতরে গিয়ে শিরা এনে বাবার কাছে দিলেন। দ্বিতীয়বার আনতে যাওয়ার সময় ঘটল মর্মান্তিক ঘটনা। কোথেকে গুটিকয়েক দুষ্টু ছেলে এসে পলিথিনের ঠোঙায় দিল পানি ভরে। বাবা কোনোমতে দৌড়ে বেঁচেছিলেন। কিন্তু মা পলিথিনের ভেতর থেকে আর বের হতে পারেননি। অথই জলেই তার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হয়।
এরপর আমরা থাকার নতুন জায়গাও ত্যাগ করলাম। বাবা আর আমি হেঁটে হেঁটে একটা গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলাম, যার শেষপ্রান্ত বলে কিছু নেই। আমরা বড় বড় ঘাস গাছের নিচ দিয়ে চলছি। বাবা হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে একটি মানুষের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর ছুটলেন তার দিকে। আমি প্রশ্ন করতেই তিনি শুধু একটি বাক্য বললেন- তোর মায়ের খুনি।
দেখলাম, বাবা বিশাল একটি পায়ের ওপর উঠে গেছে। দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে একটি আঙুলের ফাঁকে ঢুকে গেলেন। পরমুহূর্তে মানুষটি উঃ করে একটা শব্দ করে বাবাকে আঙুলে তুলে নিয়ে টিপে মেরে ফেলল। এরপর মরদেহটি ছুড়ে ফেলে দিল।
কষ্টে আর ক্ষোভে আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আমিও ছুটে গিয়ে মানুষটির অন্য পায়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে একটা কামড় বসালাম। আমায় মেরে ফেলার আগেই আমি ঘাসের বনে ঝাঁপ দিলাম। তাই বেঁচে গেলাম।
অনেক ভেবেচিন্তে আমি লিখতে বসেছি। আমাদের কষ্টের কথা শুনে যদি একটি মানুষেরও মনে দয়া হয় তবে অন্তত তার বেখেয়ালে অথবা দুষ্টুমির ছলে হয়তো বলি হবে না আমার মতো নিরীহ কোনো জীব। লেখাটা যখন শেষ করেছি, তখন দূরে পিঁপড়েদের ব্যাপক শোরগোল শোনা যাচ্ছে। হয়তো নতুন কারও ঘর গুঁড়িয়ে গেল কারও পায়ের আঘাতে অথবা পিষে গেল সারি সারি পিঁপড়ে কারও অসাবধানী পায়ের তলে।
জাহ্নবী