ছবি এআই
এলাকার সবচেয়ে বড় মুদি দোকানটা রফিকের। সুসজ্জিত দোকান। নাম রফিক জেনারেল স্টোর। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের জিনিসই দোকানে পাওয়া যায়।
ভরদুপুর। ক্রেতা নেই। রফিক বসেছিল দোকানে। তাকে কেমন মনমরা লাগছিল। ক্রেতার অভাবে মনমরা থাকার কথা না। ভরদুপুরে সাধারণ মুদি দোকানগুলোতে ক্রেতা থাকে না।
এরকম সময় রফিকের বন্ধু মিজান এল। মিজানকে দেখে রফিক নড়েচড়ে বসল। একটা টুল দেখিয়ে বসতে বলল। তবে তার মনমরা ভাব কাটল না। মিজান বলল, এই ভরদুপুরে তুই দোকানে বসে আছিস?
- কী করব বল?
- তোর কর্মচারী কই?
- কর্মচারী চাকরি ছেড়ে চলে গেছে।
- কেন?
- বিয়ে করেছে। এখন আর মুদি দোকানে চাকরি করবে না।
- এরই মাঝে তোর তিন-চারজন কর্মচারী চলে গেল।
- সবার একই কেস। বিয়ে করে তারপর চলে যায়। গিয়ে নিজের মতো ব্যবসা শুরু করে।
মিজান একটু অবাক হলো। সত্যি অদ্ভুত ব্যাপার। মিজান বলল, তোর কর্মচারীদের বিয়ে হয়ে যায়, অথচ তোর বিয়ে হচ্ছে না।
- সমস্যা তো ওখানেই।
- ওখানেই মানে?
- মানে তারা চাকরি করে। আমি তো কোনো চাকরি করি না।
- ব্যবসা তো করিস।
- মেয়ের বাপ-মা সেভাবে ভাবে না। ভাবে ছেলে বেকার ছিল, ভাদাইম্যা ছিল। শেষে বাপ একটা মুদি দোকান করে দিয়েছে। ছেলে জাস্ট দোকানদার। দোকানদারের সঙ্গে তারা মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হয় না। কোনো মেয়েও দোকানদারকে বিয়ে করতে রাজি হয় না।
- তাহলে তোর কর্মচারীদের বিয়ে হয় যে!
- কর্মচারীরা তো দোকানদার না। তারা চাকরি করে। বায়োডাটায় লিখে-ম্যানেজার, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ‘ম্যানেজার’ শব্দটা শুনতেই কেমন ওজনদার লাগে। কেউ কেউ লেখে ‘জেনারেল ম্যানেজার’।
- হা হা হা।
মিজান অনেকক্ষণ হাসল।
রফিক জিজ্ঞেস করল, চা খাবি?
হাসি থামিয়ে মিজান বলল, চা খেতেই তো এসেছি। তোদের পাশের দোকানের চা-টা সেই রকম হয়। কুচি কুচি করে আদা কেটে দেয় এই ব্যাপারটা ভালো লাগে।
রফিক পাশের দোকানে ফোন করে দুই কাপ লাল চা দিতে বলল।
ওরা যখন চা খাচ্ছিল তখন সেখানে এল এক যুবক। যুবকের চেহারা-সুরত বেশ সুন্দর। পোশাক-আশাকে ফিটফাট। শিক্ষিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তরুণ অধ্যাপক। যুবক এসে একবার দোকানের নেমপ্লেটে তাকায়, একবার রফিক আর মিজানের মুখের দিকে তাকায়, আরেকবার পুরো দোকানটায় চোখ বোলায়। সে এরকম করছে তো করছেই। ব্যাপার কী? খারাপ কোনো মতলব নাই তো? আজকাল পাড়া-মহল্লায় লুটপাট, ডাকাতি বেড়ে গেছে। দোকান লুট করবে নাকি? হয়তো সে কোনো ডাকাত দলের লিডার। তার দলের লোক আশপাশেই আছে।
রফিক সাহস নিয়ে বলল, কিছু বলতে চান?
- জি।
- বলুন।
- আপনাদের এই দোকানের ঠিকানায় একটা বিজ্ঞাপন পেয়েছিলাম ফেসবুকে। কর্মচারী নিয়োগ হবে।
- হ্যাঁ দিয়েছিলাম, তা প্রার্থী কে?
- আমি নিজেই প্রার্থী। আমি ম্যাথমেটিক্সে মাস্টার্স।
মিজান আর রফিক বড় চোখ করে তাকালো যুবকটার দিকে। এরকম সুদর্শন, উচ্চশিক্ষিত যুবক মুদি দোকানে কর্মচারীর চাকরি করবে! রফিক বলল, আপনি এখানে চাকরি করতে চাচ্ছেন কেন? বেতন তো সেরকম দিতে পারবে না, তার চেয়ে টিউশনি করলেও...।
- বেতন যা খুশি দেবেন। বেতন কোনো বিষয় না। চাকরিটা আমার দরকার।
- ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন।
যুবকটা তার ফোন তুলে ধরল মিজান আর রফিকের সামনে। স্ক্রিনে একটা মেয়ের ছবি। টানা টানা হরিণী চোখ। কানের পাশ দিয়ে ঢেউ খেলানো চুল নেমে গেছে। মেয়েটার মুখে মুচকি হাসি। তার বাম গালে টোল পড়ে আছে। খুবই রূপবতী একটা মেয়ে।
ছবিটার দিকে তাকিয়ে রফিক কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার মুখে যেন কোনো কথা জোগাচ্ছিল না। মিজান বলল, কার ছবি এটা?
যুবকটা বলল, এই মেয়েটার সঙ্গে আমার বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়েছে। সমস্যা হলো, একটা চাকরি হলেই আমি মেয়েটাকে বিয়ে করতে পারব। টিউশনি করে আমি ৪০-৪৫ হাজার টাকা আয় করি। কিন্তু টিউশনিকে তারা গুরুত্ব দেয় না। তারা চায় চাকরি। তাই চাকরিটা আমার খুব দরকার। ওকে বিয়ে করতে না পারলে আমার জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমার স্বপ্ন ছিল গালে টোল পড়া কোনো মেয়েকে বিয়ে করব। মেয়েটা হাসলে বাম গালে টোল পড়ে।
- কিন্তু দোকানের কর্মচারী...।
- আমি বায়োডাটায় লিখব, জেনারেল ম্যানেজার-ডিপার্টমেন্টাল স্টোর।
মিজান তাকালো রফিকের মুখে। রফিক যুবককে বলল, বায়োডাটা এনেছেন?
- জি। এই যে।
- রেখে যান। এর মধ্যেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।
যুবকটা খুশি হলো। ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল। তারপর রফিক কেমন ঠেসে গিয়ে বসে রইল। মিজান বলল, কীরে, এমন সুদর্শন, উচ্চশিক্ষিত কর্মচারী পেলি অথচ কেমন চুপসে গেলি যেন।
রফিক বলল, যুবকের ফোনে যে মেয়েটাকে দেখলি সেই মেয়েকে গত মাসে আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। দোকানদার বলে তারা আমাকে পাত্তা দেয়নি।
- বলিস কী!
- সত্যি বলছি!
- হা হা হা হা।
- তুই হাসছিস?
- হাসা উচিত না, তাও হাসছি। দোকানের মালিক আর কর্মচারীর জীবনের স্বপ্ন একই ছিল। তবে জিতে যাচ্ছে কর্মচারী।
রফিকের বুক ভেঙে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে গেল।