
মেয়েটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় লাইব্রেরিতে। স্থানীয় একটা লাইব্রেরিতে কাজ করি তখন। সেখানেই মেয়েটা এসেছিল। ওয়াইল্ড লাইফের ওপর বইয়ের জন্য। নাম সুজাইনা। মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর দুটি জিনিস জানলাম। এক মেয়েটা খুব দুঃসাহসী। বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে খুব পছন্দ করে। দ্বিতীয় ব্যাপারটি হলো কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরা, ফরসা মেয়েটার সম্প্রতি তার প্রেমিকের সঙ্গে ব্রেকআপ হয়ে গেছে। কোনো এক মনীষী বলেছিলেন, ‘কোনো মেয়ের কাছাকাছি আসিবার জন্যে মেয়েটা যা যা পছন্দ করে তুমিও তাই তাই পছন্দ করিবে।’
আমিও ওয়াইল্ড লাইফের ওপর পড়াশোনা শুরু করলাম। একদিন আমি আর সুজাইনা মিলে বান্দরবানের একটা পাহাড়ি এলাকায় বেড়াতে গেলাম। যেতে যেতে আমরা বন্ধুরা যে একবার সুন্দরবনে বাঘের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে করে বাঘের পিছু নিয়েছিলাম, সেটা জানালাম। একবার যে আমাদের গ্রামের বাড়িতে জ্যোৎস্না রাতে একটা গোখরা সাপ ধরে ফেলেছিলাম, সেটা জানালাম। সুজাইনা খুবই ইম্প্রেসড। প্রতি কথার পর সে চোখ বড় করে করে বলছিল, ‘সত্যি!’
আমি যদিও প্রতিবারই উত্তর দিলাম, ‘সত্যি না তো কি মিথ্যা?’
কিন্তু চরম সত্যিটা হলো আমি এসব কিছুই করিনি। আমার এই জীবনে সবচেয়ে দুঃসাহসিক কাজ হচ্ছে একবার লিফট বন্ধ থাকার কারণে আমাদের লাইব্রেরির পাঁচতলায় সিঁড়ি ভেঙে উঠেছিলাম।
যেতে যেতে হঠাৎ একটা উঁচু জায়গায় এসে পানির শব্দ শুনলাম। একটা পাহাড়ের কিনারায় এসে দেখি একটা ঝরনা বয়ে গেছে নিচে। কিনারায় একটা বৃদ্ধ লোক উদাস বসে বিড়ি টানছে (বিড়ি টানা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর)।
কিনারায় দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের মতো হাততালি দিয়ে সুজাইনা বলল, ‘নিচে নামা যাবে না?’
‘যাইব অবশ্যই।’ এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বৃদ্ধ বলল।
‘এই নামো তুমি।’ আবদার শুনে মনে হলো আমি সুজাইনার মামা।
‘আমি?’ অবাক হয়ে একটা ঢোক গিলে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘তো আর কে?’
‘ইয়ে মানে...,’ আমতা আমতা করতে লাগলাম।
‘আরে আমিও নামতাম। গতকাল থেকে সর্দি।’
‘এই পথ দিয়ে নামা যাবে?’ বৃদ্ধ লোকটিকে আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘যাইব অবশ্যই।’ উদাস মুখে বৃদ্ধ বলল।
আমার ইচ্ছা করল বুইড়াকে লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দিই। যে ভাব নিয়ে ‘যাইব অবশ্যই’ বলতেছে, মনে হচ্ছে সে সকাল-বিকাল চারবার ওঠানামা করে।
‘কোনো ঝামেলা হবে না তো?’
বৃদ্ধ এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘আরে না। খালি কয়দিন আগে এক পোলায় পড়ে গেছিল। ওঠার পর খালি উল্টাপাল্টা কথা কইতেছিল!’
‘কী উল্টাপাল্টা কথা?’ আমি ঢোক গিললাম আরেকটা।
‘কী না কী এক মাছের সঙ্গে নাকি তার আলাপ হইছে। আবোল তাবোল কথা। পরে হে রে পাগলাখানায় পাঠাইছে!’
‘এই নামো না প্লিজ।’ সুজাইনার কণ্ঠে মুক্তা ঝরে পড়ল।
আমি সুজাইনার চোখের দিকে তাকালাম। এটাই সুযোগ। এক মনীষী বলেছেন, ‘সুযোগ হেলায় হারিও না, মুরুব্বিদের সম্মান করিও।’
আমি নামতে শুরু করলাম। দু-একবার পা হড়কে গেল। প্রেম মানুষকে দুঃসাহসী করে। কোনো এক কবি বলেছিলেন, ‘আমি ভালোবেসে বুনো ষাঁড়ের চোখে বাঁধতে পারি লাল কাপড়।’
পা হড়কে ফড়ফড় করে পানিতে পড়ে গেলাম। প্রথম ডুবে এক জগ পানি খেলাম। পরেরবার দেখলাম একটা মাছ। বোয়াল মাছ নাকি?
‘আমি বোয়াল দ্য গ্রেট!’
মাছ কথা বলছে! মাথা টাথা গেছে নাকি।
‘আমি একজন মোটিভেশনাল স্পিকার!’
‘পানিতেও মোটিভেশনাল স্পিকার!’ আমি মাননীয় স্পিকার হয়ে গেলাম!
‘শোনো হে বৎস। জীবনে কখনো মিথ্যা বলিবে না। তুমি যা তাই দেখাবে। একবার এক ব্যাঙ হাতি হতে যেয়ে ফুলতে ফুলতে পেট ফেটে মারা যায়। জীবনে সবকিছু পেতে হয় না। সবকিছু পাওয়ার জন্যই মানুষ অভিনয় করে। যেমন তুমি করছো সুজাইনার সঙ্গে!’
আরে শালা এ দেখি সুজাইনার নামও জানে।
‘দেখো হে বৎস, মিথ্যা বলে যা পাওয়া যায়, তা টিকে না। তুমি এখনই উপরে উঠে তুমি যা তাই বলে দাও। সুজাইনা তোমার সঙ্গে থাকলে থাকবে, না থাকলে নাই।’
আমি পানি থেকে উঠে তরতর করে উপরে উঠে গেলাম।
সুজাইনা আমাকে দেখে খুশিতে লাফ দিয়ে উঠল।
‘ওয়াও! তুমি এতক্ষণ পানির নিচে ছিলে। ইউ আর জাস্ট গ্রেট!’
‘সুজাইনা তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে!’ আমি তখন কাঁপছি। শীতে নয়, উত্তেজনায়।
‘হ্যাঁ বলো।’
‘দেখো আমি কিন্তু এত দুঃসাহসী না। ভ্রমণপিপাসুও নই। তোমাকে যে বললাম, সুন্দরবনের বাঘের পায়ের ছাপ, খালি হাতে সাপ ধরা এগুলো সব ভুয়া। সাপ আমি জীবনে দেখছিই দুই জায়গায়। চিড়িয়াখানায় আর ডিসকভারি চ্যানেলে! এই যে এখন নিচে নামলাম, আমার জন্যে না। তোমার আবদার রাখতে।’
‘ওকে। সত্যি বলার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। এই জন্যই আমরা সারা জীবন অনেক ভালো বন্ধু হয়ে থাকব।’
বন্ধু! এই চেয়েছিলাম। আমি বেশ কিছু পাথর কুড়িয়ে নিচে জ্বলে ছুড়তে লাগলাম।
‘হালা বোয়াল দ্য গ্রেট। তোর মোটিভেশনাল স্পিকিংয়ের নিকুচি করি। আমার সব শেষ করি দিলি।’ রাগে ক্ষোভে আমি একের পর এক পাথর ছুড়তে লাগলাম।
‘এটাও গেছে। পাগলাখানায় পাডাইবার প্রয়োজন!’