এঁকেছেন মাসুম
বর্তমান অবস্থান: নুরুল মিয়ার টং দোকান
আমি, রাজু আর তন্ময় বসে চা পান করছিলাম। রাজু ব্যাংকার। ছোটখাটো একটা ভুঁড়ি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ওর। তন্ময়কে আমরা ডাকতাম মৈনাক পর্বত। এখনো ডাকি। এমনই বিশাল সাইজ তার। আমি ছাড়া বাকি দুজনই বিয়ে সেরে ফেলেছে। আমরা এখন আর দেশের সব সুন্দরীকে নিয়ে আলোচনা করি না। আমাদের আলোচনার বিষয় দেশের সমস্যা, জাতিসংঘের অধিবেশন নিয়ে ফলোআপ, জলবায়ু পরিবর্তন, রোহিঙ্গা ইস্যু আরও যত খবর।
আজকের বিষয় ছিল কোচিং সেন্টার বন্ধ করা নিয়ে। খবর শুনে রাজু চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘বলে কী? কোচিং বন্ধ হয়ে গেলে দেশজুড়ে প্রেম-পিরিত হবে কেমনে?’
‘আর বেঞ্চ ভাঙা হবে কেমনে?’
রাজুর কথা শুনে দুজনেই হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতে মৈনাক পর্বত আমার পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিল। এটা ওর ছোটবেলার অভ্যাস।
১২ বছর আগে
এইচএসসি পরীক্ষার আগে আমরা একটা কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। কোচিং সেন্টার বাছাই করার ব্যাপারে আমরা প্রাধান্য দিতাম সুন্দরী মেয়ের সংখ্যা, বাসা থেকে কোচিংয়ের দূরত্ব আর আশপাশের টং দোকানের অবস্থা বুঝে। পড়ালেখার মান খুব বেশি ভাবতাম না।
‘পড়ালেখা সব নিজের কাছে!’ আমাদের কলেজের শিকদার স্যারের এই ডায়ালগ আমরা প্রায় ছাড়তাম।
মামুন কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে গেলাম আমরা তিনজন। আমাদের মধ্যে পড়ালেখায় সিরিয়াস বেশি তন্ময়। সে এই কোচিংয়ে আসতে চাইছিল না। তাকে রাজু ধমক দিয়ে বলে, ‘পাশেই দুইটা গার্লস কলেজ। তারপর মনু মিয়ার পেঁয়াজু-বেগুনি। এমন সুজলা সুফলা পরিবেশ পাবি আর কোথাও?’
সেই কোচিংয়ে ভর্তির পর একদিন পরীক্ষার সময় দেরি করে আসে তন্ময়। তাড়াহুড়ো করে বসতে গিয়ে ধড়াম করে পুরো বেঞ্চসহ ভেঙে পড়ে। তার পেছনে বেঞ্চে বসা এক মেয়ে অবাক হয়ে বলে, ‘কী হলো’?
তন্ময় আমাদের বন্ধু, তাই আমরা অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছিলাম। কিন্তু মেয়েটার ওই ‘কী হলো’ প্রশ্নে আর হাসি আটকে রাখতে পারিনি। সেই ‘কী হলো’ এতটাই হিট করে যে, পরে আমরা সেটি অনেকবারই ব্যবহার করেছি। মনে আছে এইচএসসি পরীক্ষায় হিসাববিজ্ঞান প্রশ্ন ভয়ানক কঠিন করে। ওটা দেখে পরীক্ষার হলে আমার পেছনে বসা রাজু ফিসফিস করে বলে, ‘কীরে কী হলো?’
রাজু কোচিংয়ে যেত অন্য কারণে। সে একটা মেয়েকে পছন্দ করে। নাম পিয়া। সে ওই মেয়েকে ইম্প্রেস করবে। ওই মেয়ে আবার মারাত্মক ট্যালেন্টেড। এদিকে রাজু প্রায় সময় বরাবর ৩৫ পায়। আর এক গ্রেস দিয়ে ওকে পাস করানো হয়। একদিন রাজু খবর আনল সকালের ব্যাচে যে প্রশ্নে পরীক্ষা হয়, বিকেলেও সেই একই প্রশ্নে। ‘আমরা যদি সকালের প্রশ্ন জোগাড় করতে পারি আর ঠেকায় কে!’
শুনে তন্ময় বলল, ‘এইভাবে পাস করে কি লাভ হবে?’
‘তুই গারো পাহাড়ের হাতি চুপ থাক।’
শরীর নিয়ে কেউ খোঁটা দিলে খুবই মাইন্ড করত তন্ময়, তাই ও চুপ হয়ে গেল। কীভাবে কীভাবে প্রশ্ন জোগাড় করে ফেলল রাজু। ফলাফল হলো ভয়াবহ। অর্থনীতি পরীক্ষায় রাজু ৭৭ আর আমি ৬৫। তন্ময় সৎ থেকে পেয়েছে ৫৯। পিয়া পেয়েছে ৬৮। মার্কস শুনে পুরো ক্লাস হা করে রাজুর দিকে তাকিয়ে থাকল। রাজু দুদিন টি-শার্টের কলার তুলে হাঁটাচলা করল। পরের সব পরীক্ষায় রাজু ফাটিয়ে দিল। প্রায় সর্বোচ্চ পাচ্ছিল। ঝামেলা লেগে গেল ব্যবস্থাপনা পরীক্ষার দিন। বিকেলের প্রশ্নটা বদলে দিল। প্রশ্ন দেখে সেই ক্ষেপে গেল রাজু। ‘এইসব কী? এগুলা কি ভদ্রলোকের কাজ। সকালে এক কথা বিকেলে আরেক কথা!’
আমি বললাম, ‘হালা আস্তে। কেউ শুনে ফেললে তোর সব অ্যাচিভমেন্ট যাবে।’
যদিও ততদিনে পিয়া রাজুর ওপর ইম্প্রেস। এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রাজু প্রপোজ করবে পিয়াকে। কোচিংয়ের ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে সে অবস্থান নিল। যেভাবে এখন ডি-বক্সের ভেতরে অবস্থান নেয় মেসি। আমি গিয়ে পিয়াকে বললাম, ‘তোমার সঙ্গে নাকি তন্ময়ের কী কথা আছে। ওয়াশরুমের ওখানে যাও।’
পিয়া কেমন একটা মুচকি হেসে রওনা দিল। প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর এসে পিয়া বলল, ‘কই তোমার বন্ধু?’
তন্ময় ছিল আমার পাশে। সে ফিসফিস করে বলল, ‘কী হলো?’
দৌড়ে গিয়ে দেখলাম রাজু বাথরুমের ভেতরে। আমরা গেলে সে বের হলো।
‘কী হইছে তোর?’ অবাক আমি।
‘কেমন যেন পেটটা মোচড় দিয়ে উঠল!’
হো হো করে হেসে ফেললাম আমরা। সেই পিয়াকেই পরে বিয়ে করে রাজু।
বর্তমান অবস্থান: নুরুল মিয়ার টং দোকান
‘তোদের বিয়ের দিন স্টেজে আমি কি বলেছিলাম মনে আছে?’ জিজ্ঞাসা করলাম রাজুকে।
‘পেট মোচড় দিচ্ছে নাকি রাজু?’ তন্ময় মনে করিয়ে দিল।
হাসতে হাসতে সেই শুরুতে বলা কথাটাই রাজু আবার বলল, ‘কোচিং বন্ধ হয়ে গেলে দেশজুড়ে প্রেম পিরিত হবে কেমনে?’