
একা থাকলে আমাকে কেমন যেন বিষণ্নতায় পেয়ে বসে। তাই একা একা কোথাও যেতে একেবারেই ভালো লাগে না। একুশের বইমেলা চলছে। তাই অফিস কলিগ প্লাস আমার ক্লোজ বন্ধু ফিরোজকে বললাম, দোস্ত একুশের বইমেলা চলছে। চল, সেখান থেকে বেড়িয়ে আসি।
ফিরোজ হিসাবের খাতা থেকে মাথা তুলে বলল, বইমেলা! আমার ভাই বইমেলায় যেতে একেবারেই ভালো লাগে না।
আমি অবাক, এটা আবার কেমন কথা? বই ভালো লাগবে না কেন?
ফিরোজ বলল, আমার কাছে সব বই একই রকম লাগে। তা ছাড়া একবার বই পড়ে ফেললে সেটা আর কোনো কাজে লাগে না। শুধু শোকেসে সাজিয়ে রাখতে হয়। শোকেসেই যদি সাজাব, তাহলে শোপিস দিয়ে সাজাই, কী বলেন?
আমি ফিরোজের সঙ্গে একমত হতে পারলাম না, এটা কী বললে, ভাই? তোমার মতো শিক্ষিত লোকের কাছ থেকে এমন কিছু আশা করিনি। পড়ে ফেললে বই কোনো কাজে লাগে না, এটা কে বলল? বই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটা অংশ। বই ছাড়া আমাদের এক দিনও কি চলে? চলে না। এই যেমন আলম সাহেবের কথাই ধরো। তিনি আমাদের পাশের বাসায়ই থাকেন। গত শুক্রবারের কথা। হঠাৎ কী মনে করে তাদের বাসায় উপস্থিত হলাম। তিনি আমাকে অন্দরমহলে নিয়ে বসালেন। বাসায় আর কাউকে না দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ভাবি-বাচ্চারা বেড়াতে গেছে নাকি? কাউকে দেখছি না যে?
আলম সাহেব বললেন, আর বলবেন না, ভাইসাহেব, গতকাল আপনার ভাবি আমার ওপর রাগ করে তার বাবার বাড়ি চলে গেছে।
আমি বললাম, তাই নাকি? তা রান্নাবান্না করে কে?
আলম সাহেব বললেন, আমিই করি। আমার রান্নার হাত বেশ ভালো। দাঁড়ান, আপনাকে চা বানিয়ে খাওয়াই।
কথা শেষ করেই তিনি রান্নাঘরের দিকে রওনা হলেন। বাসায় কেউ নেই দেখে আমিও তার পেছন পেছন গেলাম। আলম সাহেব চুলার পাশে রাখা একটা বই থেকে পাতা ছিঁড়ে তাতে ম্যাচ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে চুলা ধরালেন। এমন সময় চুলার কোনা থেকে একটা তেলাপোকা বেরিয়ে দৌড় দিতেই আলম সাহেবের হাত বিদ্যুৎগতিতে সেই বইটা তুলে নিল। তারপর বইটা ধপাস করে পড়ল তেলাপোকার পিঠে। ততক্ষণে তেলাপোকার কম্ম সাবাড়। আলম সাহেবকে বিরক্ত না করে আমি আবার বসার রুমে ফিরে এলাম।
কিছুক্ষণ পর বইকে ট্রে বানিয়ে সেটার ওপর চায়ের কাপ রেখে আলম সাহেব বসার রুমে এসে বললেন, নিন, চা রেডি। আমি চা নিয়ে এক চুমুক দিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আলম সাহেব আসলেই চমৎকার চা বানান। চুমুক দেওয়া শেষে চায়ের কাপটা সামনের টি-টেবিলে রাখতেই টেবিলটা একপাশে কাত হয়ে যেতে চাইল। কাত হওয়ার কারণে কাপ থেকে একটু চা ছলাৎ করে পড়ে গেল, তবে আমি কাপটা সামলে নিলাম। আলম সাহেব বইয়ের একটা পাতা ছিঁড়ে টিস্যু পেপার বানিয়ে পড়ে যাওয়া চাটুকু মুছে নিতে নিতে বললেন, সরি, ভাই! টেবিলের একটা পা কয়েক দিন আগে সামান্য ভেঙে গেছে। অতঃপর বইটা সেই ভাঙা পায়ের নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে আপাতত টেবিলের হেলে যাওয়া থামালেন।
আমি আস্তে আস্তে চা শেষ করে আলম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাবির সঙ্গে ঝগড়া কী নিয়ে?
তিনি বললেন, সামান্য ব্যাপার, বুঝলেন। গত রাতে ছোট ছেলেটা হিসু করে বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছিল। কোনো কিছু না পেয়ে গোটা সাতেক মোটা মোটা বইকে বালিশ বানিয়ে শুতে গেছি। সে নিয়েছে তিনটা বই আর আমি চারটা। আমি কেন চারটা নিলাম, এ ইস্যুতে কথাকাটাকাটি। তারপর ফাটাফাটি, মানে মারামারি।
আমি বললাম, তার মানে আপনি ভাবিকে মারলেন?
আলম সাহেব বললেন, আরে না ভাই, ও-ই আমাকে বই দিয়ে আচ্ছামতো পেটাল। তারপর নিজেই রাগ করে চলে গেল।
আমি অবাক হলাম, ভাবির সঙ্গে পারলেন না! ছি! বাজারে এই কথা ছড়ালে আপনার মান-ইজ্জত কোথায় যাবে, একবার ভেবে দেখেছেন?
আলম সাহেব কিছুটা লজ্জিত হলেন। মাথাটা নিচের দিকে রেখে আস্তে আস্তে বললেন, আসলে ও যে বইটা নিয়ে আক্রমণ করেছিল, সেটা পাতলা ছিল। আমার হাতে ছিল মোটা বই। মোটা বইয়ের কারণে আমি আসলে ফাইটিংয়ে সুবিধা করতে পারিনি। ব্যাপারটা দেখে ছেলে-মেয়েরাও লজ্জা পেয়েছিল। কিন্তু কী করব বলেন, বাস্তবতা তো মেনে নিতে হবে।
আমি আর কিছু বললাম না। আলম সাহেবের বাসায় বইয়ের বহুবিধ ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এবারও কি আপনি বলবেন যে, পড়ার পর বই কাজে লাগে না?
ফিরোজ হার মানলেন, আচ্ছা ঠিক আছে। বই যখন এত কাজের জিনিস, চল তাহলে বইমেলায় যাই।