
আরে! কী হচ্ছে, সামলে! কোলের ওপর উঠে যাবেন নাকি?
বাসে আজ সিরিয়াস ভিড়! সামনে একটা রিকশা এসে পড়ায় বাধল বিপত্তি! ড্রাইভার হার্ডব্রেক কষতেই ঠিক পাশেই দাঁড়ানো লোকটা একেবারে আমার গায়ের ওপর এসে পড়ল।
ওহ! সরি সরি। এক্সট্রিমলি সরি। হেভি চাপে আছি ব্রো।
কথাগুলো কান ছুঁতেই কেমন একটা খটকা লাগল! ভদ্রলোক মনে হয় এ দেশি নন! ডাউট হলো। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই বসলাম, আর ইউ অ্যা ফরেনার? হোয়াটস ইওর নেম?
ইয়েস ইয়েস! ইটস মি ছ্যাঁকাতো খাইয়াছি। অ্যান্ড আই অ্যাম ফ্রম জাপান।
অ্যাঁ, বলে কী রে! জাপানিজ! আমি তো পুরাই ফিদা! জাপান যাব বলে মাঝে ক’দিন জাপানি ভাষা শিখেছিলাম। নাইহুঁশ লার্নিং সেন্টার। এদের এখানে কোর্স করলে নাকি জাপানি বলতে বলতে হুঁশ থাকবে না। পরে অবশ্য আমি বেহুঁশ না হলেও ২০ হাজার টাকা পকেট থেকে ঠিকই ফুস করে বেরিয়ে গিয়েছিল!
বাঙালি মাত্রই বিদেশি দেখলে হামলে পড়ে। গদগদ হয়ে গলায় স্যাকারিন ঢেলে বললাম, ওকে ওকে! সো হোয়াট ডু ইউ ডু?
ওহ! ইয়েস, বেসিক্যালি আই অ্যাম অ্যা ফিল্ম মেকার। ফিল্ম বানাই।
উরি সব্বনাশ! ব্যাটা তো ভালোই বাংলা বলে দেখছি! তাজ্জব কি বাত!
আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে ছ্যাঁকাতো বলে উঠল, ইন ইওর কান্ট্রি লংটাইম আছি ব্রাদার, সামথিং বেঙ্গলি জানি।
আমার কানে যেন তার কথাগুলো ঢুকলই না। আমি আছি আমার ধান্দায়। ফিল্মে অ্যাক্টিং করার ইচ্ছা আমার বহুদিনের। এতদিন কোথায় ছিলে বস! আচ্ছা, নেব নাকি একটা চ্যান্স? ফ্যান্টাস্টিক! হোয়াট ফিল্ম?
ডকুমেন্টারি। মানে আপনাদের ভাষায় যাকে বলে ‘প্রামাণ্যচিত্র’।
আমার তো আক্কেলগুড়ুম! হতভম্ব হয়ে ছ্যাঁকাতোর ঝকঝকে বাংলা শুনছি। আর ধৈর্য থাকলো না। চরম উত্তেজনায় বলে ফেললাম, দিস ইজ রিয়েলি অ্যামাজিং!
ছ্যাঁকাতো বলতে লাগল, অ্যান্ড দিস টাইম আমি বানাচ্ছি একটা কমপ্লিট নিউ স্টোরি! অ্যা ইয়াং ম্যান, যার লাইফে সে ছ্যাঁকা খেয়েছে। বাট ওয়ান বিগ প্রবলেম, পারফেক্ট কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না এই রোলের জন্য।
এবার শিওর আমার ফিল্মে কাজ করার খায়েশ মিটবেই মিটবে। মার দিয়া কেল্লা! টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত দুই গাল প্রসারিত করে চওড়া হেসে বললাম, নো টেনশন, জাস্ট রিল্যাক্স! আই অ্যাম হিয়ার। ইওর মুশকিল আসান!
হোয়াট! হোয়াট ডু ইউ মিন?
অ্যাকচুয়ালি আই মিন, আই অ্যাম দ্যাট ক্যান্ডিডেট যাকে ইউ আর লুকিং। ইন মাই লাইফ, আই মেনি মেনি ছ্যাঁকা খেয়েছি।- উত্তেজনায় আমার ইংরেজি, বাংলা সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে!
ছ্যাঁকাতো আমাকে আপাদমস্তক দেখলেন। পায়ের ছেঁড়া জুতার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন। আমায় তিনি কিছু বলেন তার আগেই আমি দাঁত কেলিয়ে বললাম, টুডে ফাডি গেছে, স্যার।
কথা ননস্টপ চলতেই থাকল। আমার গন্তব্য এখনো আসেনি। তবে এর মধ্যেই সব প্রায় ফাইনাল করে ফেলেছি। ছ্যাঁকাতোর ফিল্মে আমিই কাজ করব। পারিশ্রমিক নিয়েও কথাবার্তা পাক্কা। শুধু অ্যাগ্রিমেন্টে সই করা বাকি আছে। তাকে আমি আর ছাড়ছি না। আজ বাসায় নিয়ে যেতেই হবে। কমসে কম এক কাপ চা তো তাকে খাওয়াতেই হবে। ও হ্যাঁ, ভুলেই তো যাচ্ছিলাম! তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটাও তো নিতে হবে! প্রথমে যেতে না চাইলেও চাপাচাপিতে শেষমেশ বাসায় যেতে রাজি হলেন ছ্যাঁকাতো।
বাস থেকে নেমে সোজা বাসার দিকে হাঁটা দিলাম। ছ্যাঁকাতোও আছে আমার সঙ্গে। এক ধরনের জোর করেই তাকে নিয়ে এলাম বাসায়। তবে তখনো জানতাম না, পিকচার আভি বাকি হ্যায়!
কড়া নাড়তেই বউ দরজা খুলল। আমি ব্যাপক উৎসাহে বলতে লাগলাম, দেখো, কাকে নিয়ে এসেছি! ইনি হলেন ছ্যাঁকাতো খাইয়াছি অ্যান্ড হি ইজ ফ্রম জাপান! ইনি আমাকে নিয়ে একটা ফিল্ম...!
কথাটা শেষ করতে পারলাম না। বউ আচমকা চিৎকার করে উঠল, হায় হায়! কী সাংঘাতিক! এ এখানে কী করছে?
কেন, তুমি ওনাকে চেনো নাকি? অবশ্য চিনতেই পারো, বিখ্যাত মানুষ! ফিল্ম-টিল্ম বানায়!- বলে পেছন তাকাতেই দেখি ছ্যাঁকাতো নেই! গলা ফাটিয়ে হাঁকলাম, ছ্যাঁকাতো স্যার! ছ্যাঁকাতো স্যার! আপনি কই?- কিন্তু কোথায় কে! কোনো সাড়া-শব্দ নেই!
বউয়ের মুখ-চোখ ততক্ষণে লাল হয়ে গেছে। বলল, ফিল্ম বানায় না ছাই! আমার ফারাকো মামাকে মনে আছে তোমার? ওই যে তার মেয়ে মালিয়া তো এই ইডিয়েটটার সঙ্গেই প্রেম করত! পরে মালিয়া ওকে ছেড়ে দেয়। এই ছেলের নাকি মাথা খারাপ! যতসব উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা! জাপান যাবে, ফিল্ম বানাবে! হাবিজাবি! নিজেকে সে জাপানিজ বলত! জাপানিদের মতোই চলত ফিরত! শেষে ছ্যাঁকা খেয়ে বেচারা বড় একা হয়ে যায়! এরপর অবশ্য আর জানি না। তা, তুমি ওকে পেলে কোথায়?
আমার কান বউয়ের বাক্যবাণ ক্যাচ করতেই খ্যাঁচ করে যেন বুকে একটা খোঁচা খেলাম! ছ্যাঁকাতো জাপানি নয় শুনে আমার তো হাঁপানি ওঠার দশা! তাহলে, আমার ফিল্মের কী হবে? আরও খানিকক্ষণ থাকলে ছ্যাঁকাতো হয়তো আরও কত কী দেখাত!