এঁকেছেন মাসুম
ফার্মগেটের ব্রিজের নিচে এক ল্যাংড়া নিয়মিত ভিক্ষা করে। তার একটা পা নাই, হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়েছে।
একদিন সেই ল্যাংড়া ভিক্ষুক সকালে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এসে দেখে, তার জায়গায় বসে ভিক্ষা করছে এক কানা। কানার দুই চোখই নষ্ট। পিচ্চি নাতনি তাকে হাত ধরে নিয়ে এসেছে।
ল্যাংড়া তো রেগেমেগে ফায়ার। সে উত্তেজিত হয়ে বলল, রে কানা, তোর সাহস তো কম না! তুই আমার জায়গা দখল করছোস! আমার জায়গা ছাইড়া দে! ফোট কইলাম!
কানাও রেগে গিয়ে বলল, কেন রে ল্যাংড়া, এই জায়গা কি তোর শ্বশুরের কেনা? আমি যেখানে খুশি সেখানে বসুম। তোর কী?
ল্যাংড়া ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বলল, এই সাবধান শ্বশুর নিয়া কথা কবি না। লাত্থি মাইরা কিন্তু তোর টেংরি ভাইঙা দিমু। জানোস আমি কে? ল্যাংড়া সমিতি যদি জানতে পারে, তোর খবর আছে কইলাম। সমিতির সভাপতি আমার খুবই পেয়ারের মানুষ।
কানাও লাফিয়ে উঠে বলল, আর আমাগো কানা সমিতি বুঝি ঘাস খাইব? সাহস থাকলে লাত্থি মাইরা দেখ, নিজেই উল্টাইয়া চিৎপটাং হইয়া যাবি। আমি অনেক জায়গা ঘোরাঘুরি কইরা শেষমেশ এই জায়গাটা চয়েজ করছি। সহজে ছাড়ুম না। কানা মজিদ যদি জানতে পারে, তুই আমার লগে বেয়াদবি করছোস, তোর অবস্থা কিন্তুক ছেঁড়াবেড়া হইয়া যাইব।
নাতনি কানার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা, কানা মজিদ কে?
কানা নাতনির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, চুপ থাক, ল্যাংড়ারে ভয় দেখাইছি।
ল্যাংড়া লাফিয়ে উঠে বলল, এই ব্যাটা কানা, তুই তো চোখে দেখছ না। এই জায়গা চয়েস করলি কেমনে? বিটলামি করছ আমার লগে? ফোট কইতাছি। সমিতির লোক আইলে দৌড় দেওয়ার টাইম কিন্তু পাবি না।
কানা কিছুতেই যাবে না। দুজনেই কথার যুদ্ধ চালিয়ে গেল। ল্যাংড়া এক ঠ্যাং উঁচিয়ে লাথি দেখায়, কানা আন্দাজে অন্যদিকে ঘুষি পাকায়!
পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এক রিকশাওয়ালা। সে ল্যাংড়ার পরিচিত। ল্যাংড়াকে সে এই জায়গায় বহুদিন যাবৎ দেখছে। একসঙ্গে একদিন দুজনে ভাগাভাগি করে বিড়িও খাইছে। এই ঝগড়ায় অংশগ্রহণ করা কর্তব্য মনে করল।
সে রিকশা থেকে নেমে এসে সব শুনে কানাকে ঘাড় ধরে সরিয়ে দিয়ে ল্যাংড়াকে বসিয়ে দিল।
দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে এগিয়ে এলো এক সিএনজিওয়ালা। সিএনজিওয়ালা রিকশাওয়ালা থেকে মর্যাদার দিক দিয়ে কিছুটা হলেও ওপরে। সে এই মানহানিকর কাজ মেনে নেয় কীভাবে? সে আবার কানার মামাবাড়ির প্রতিবেশীর আত্মীয়। সিএনজিওয়ালা এসেই রিকশাওয়ালাকে হুমকি দিয়ে বসল, ব্যাটা মাস্তানি করস? সিএনজি দিয়া তোর রিকশারে এমন ধাক্কা দিমু না! বাঁচতে চাইলে দৌড় দে।
তুই দৌড় দে হালার পো...
তবে রে হমুন্দির পো...
রিকশাওয়ালা সিএনজিওয়ালা দুজনেই লেগে গেল তুমুল হাতাহাতি, মারামারিতে।
দূর থেকে এই দৃশ্য দেখল এক টেম্পোওয়ালা। সিএনজি থেকে টেম্পোর বডি শক্তিশালী। সে আবার রিকশাওয়ালার দূরসম্পর্কে ভাতিজার বন্ধু। টেম্পোওয়ালা এসেই সিএনজিওয়ালার ঘাড় চেপে ধরে বলল, টেম্পো দিয়া তোর সিএনজিরে এমন ডলা দিমু, একেবারে ভর্তা বানাইয়া দিমু কইলাম, গেলি?
এবার মারামারি চলছে সিএনজিওয়ালা-টেম্পোওয়ালার মধ্যে।
রাস্তার ওপাশ দিয়ে যাচ্ছিল এক বাসওয়ালা। সে সিএনজিওয়ালার বোনের জামাইয়ের বন্ধুর খালু। বাস ফেলে দৌড়ে এসে সে টেম্পোওয়ালাকে ধুরুম ধুরুম কিলাতে শুরু করল। হুমকি দিয়ে বলল, ব্যাটা রংবাজি করস? বাস দিয়ে তোর টেম্পোরে ডলা দিয়া চানাচুর বানাইয়া দিমু কইলাম!
এখন মারামারি চলছে বাস আর টেম্পোতে।
তুমুল মারামারি চলছে। কানা আর ল্যাংড়া একপাশে বসে ঝগড়া উপভোগ করছে। নাতনি বলল, দাদা, এরা মারামারি করতেছে কেন?
কানা থুহ করে একদলা থুতু ফেলে বলল, কইতে পারি না, মনে লয় হুদাই!
একপর্যায়ে কানা একটা বিড়ি ধরিয়ে দু-এক টান খেয়ে ল্যাংড়ার দিকে এগিয়ে দিল। ল্যাংড়া সেই বিড়ি নিয়ে আয়েস করে খেতে খেতে ঝগড়া দেখতে লাগল।
ঝগড়ার একপর্যায়ে টেম্পোওয়ালার দাঁত একটা হাওয়া। মুখ গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। বাসওয়ালার হাঁটু ছিলেছে, থুঁতনি কেটেছে। দুজনেরই জামাকাপড় ছেঁড়া।
টেম্পোওয়ালা ফোন করেছে টেম্পো মালিককে। বাসওয়ালা আবার ফোন করেছে বাস মালিককে।
দুই মালিক মুহূর্তে এসে হাজির। দুজনেই আবার দুই এলাকায় ডাকসাইটে নেতা।
টেম্পো মালিক বাস মালিককে দেখে হুংকার দিয়ে বলল, এই ব্যাটা আমারে তুই চিনস? চিনস আমারে?
বাস মালিক ততোধিক হুংকার দিয়ে বলল, এই ব্যাটা, তুই গালকাটা ফরিদরে চিনস? আমি কইলাম তার ছোট ভাই।
টেম্পোওয়ালা বুঝল, হুংকার দিয়ে কাজ হবে না। সে গলা নরম করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, না তো ভাই, আমি ফরিদকে চিনি না। আসেন পরিচিত হই!
দুই মালিক মীমাংসা করতে বসল।
কানা আর ল্যাংড়া আবার বিড়ি ধরিয়ে দুইজনে ভাগ করে খেতে খেতে সালিশ দেখতে লাগল।
সালিশে ফয়সালা হলো, কানা এবং ল্যাংড়া দুজনেই বাদ। বাস মালিক এবং টেম্পো মালিক নিজেদের পছন্দের একজন লোককে এখানে বসাবে। সেই লোক মাসে মাসে দুজনকেই বাসায় গিয়ে মাসোহারা দিয়ে আসবে।
ফয়সালার কথা কানা আর ল্যাংড়াকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ল্যাংড়া কানাকে ডেকে বলল, এইটা কী হইল রে কানা?
কানা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, কী আর হইব, আমরা আমাগো শক্তি দেহাইছি। এখন ওরা অগো শক্তি দেখাইতেছে!