
‘রাত হলেই চোখ দিয়ে পানি পড়ে, চোখ জ্বালাপোড়া করে, অতিরিক্ত চুলকায়। আলোতে তাকাতে কষ্ট হয়। মোবাইল, টিভির দিকে তাকাতে পারি না। কবে যে এই দুর্দশার শেষ হবে জানি না। এই চোখ কি আদৌ ভালো হবে?’
কথাগুলো বলছিলেন মো. মারুফ (২৭)। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার এই বাসিন্দা চট্টগ্রাম মহানগরের নিউমার্কেট মোড়ে গত ৪ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন। শিক্ষার্থীদের ওই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা চালায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা।
আত্মরক্ষার্থে কয়েকজন শিক্ষার্থী দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নেন পাশের একটি গলিতে। তাদের সঙ্গে ছিলেন মারুফও। সেদিন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাকে ধরে ফেলে এলোপাতাড়ি কিল ও ঘুষি মারতে থাকে। এ সময় তাদের হাতে পরা চুরির আঘাত লাগে তার ডান চোখে। একপর্যায়ে তারা মারুফের নিতম্বে ছুরিকাঘাত করে।
গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা শেষে তিনি বর্তমানে সীতাকুণ্ডের গ্রামের বাড়িতে আছেন। কিন্তু ডান চোখে দেখতে পাবেন কি না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের শঙ্কা মারুফ চান উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে। কিন্তু অর্থসংকট তার সেই প্রত্যাশাকে ম্লান করে দিচ্ছে।
মারুফ জানান, যারা তাকে মারছিল তাদের সবার হাতে চুরি ছিল। তারা যখন তার মুখে, চোখে আঘাত করছিল তখন ওইসব চুরির আঘাত লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তাকে নেতৃত্বদানকারী ভেবে নিতম্বে ছুরিকাঘাত করে তারা।
তিনটি ঘাই মেরে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে পালিয়ে যায় তারা। সেদিন তাকে কয়েকজন মিলে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করে। এর পর থেকে কয়েক ঘণ্টা বোধহীন ছিলেন তিনি। পরে জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারেন তিনি চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
মারুফ আরও জানান, তাকে ওইদিন রাতেই চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অন্য হাসপাতালে পাঠায়। কেননা তার ডান চোখের অবস্থা ছিল শোচনীয়। তাকে মহানগরের মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চোখের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
কিন্তু কিছুতেই তার চোখের উন্নতি হচ্ছিল না। কয়েক দিন পর লায়ন্স হাসপাতাল, চিটাগাং আই ইনফারমারি, বাংলাদেশ আই হসপিটালে চিকিৎসা নেন তিনি। তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসার পরও তার চোখের কোনো উন্নতি নেই। আঘাতের ২৩ দিন পরও তিনি ডান চোখে দেখছেন না। সীমাহীন এক যন্ত্রণা নিয়ে তিনি দিন গুনছেন। কবে তার এই দুর্দশা শেষ হবে তা জানা নেই।
মারুফ বলেন, চিকিৎসকরা তার চোখ পুরোপুরি ভালো হওয়ার ব্যাপারে বার্তা দিচ্ছেন না। এতে তিনি হতাশ। তারা বলছেন, তার চোখের পেছনে কালো রক্ত জমে গেছে। সেগুলো দূর করতে হবে। তাকে শুধু ড্রপ দেওয়া হয়েছে। এটি ব্যবহারেও কোনো ফল পাচ্ছেন না তিনি।
এদিকে তার বাবা নুরুল আক্তার দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে যেতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভাগ্য ফিরে তাকাচ্ছে না। মারুফ মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানে কাজ করে পরিবার চালাতেন। এখন চোখেই দেখতে পারছেন না। তাই কাজ করতে পারছেন না। ফলে পরিবারে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার।
মারুফের বাবা জানান, এই পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে পরীক্ষা, নিরীক্ষায় তার জন্য অর্ধ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এর পরও তার ছেলের চোখ ভালো হয়নি।
মারুফদের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের হাশেম নগর (নতুন পাড়া) গ্রামে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মারুফকে তার এলাকার বন্ধুরা মিলে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা মোটেও যথেষ্ট নয়। তিনি কর্মহীন হয়ে পড়ায় তাদের সংসারে ছন্দপতন ঘটেছে। আমরা তার সুস্থতার পাশাপাশি তাকে একটি সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।