বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাচারের তথ্য চেয়ে এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৭১টি চিঠি বা পারস্পরিক আইনি সহায়তার জন্য অনুরোধ (মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল এসিস্টেন্স রিকোয়েস্ট-এমএলএআর) পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে জবাব এসেছে ২৭টির। ১০টি দেশে পাচার হয়েছে সবচেয়ে বেশি টাকা। দেশগুলো হলো- কানাডা, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেম্যান আইল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড।
এমএলএআরের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে দুদক। আইনি ব্যবস্থা নিতে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ অপরিহার্য। তাই প্রয়োজনীয় দালিলিক প্রমাণের অভাবে বছরের পর বছর অনিষ্পন্ন রয়েছে দুদকের ১৫৭টি অনুসন্ধান। এখন সেসব তথ্যের অপেক্ষায় আছেন দুদক কর্মকর্তারা।
এমএলএআরের মাধ্যমে তথ্য পেলে অন্তত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করে অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব। এমএলএআর প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তাদের সেসব দেশ ভ্রমণে পাঠানো হতে পারে। পাশাপাশি পাচারের টাকা ফেরাতে সব রকম চেষ্টা চালানো হবে দুদক সূত্র জানিয়েছে।
অবশ্য পাচারের টাকা ফেরাতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দপ্তর (ইউএনওডিসি), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে দুদক।
গতকাল মঙ্গলবারও রাজধানী সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৪ সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দুদকের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ থেকে পাচার টাকা ফেরত আনতে সহযোগিতা চেয়েছে দুদক। প্রতিনিধিদলটিও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। বৈঠকের পর দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে সেই দেশগুলোর নাম উল্লেখ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। তারা আমাদের সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছে। ইতোমধ্যে পাচারের তথ্য চেয়ে ৭১টি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে জবাব এসেছে ২৭টির।’
পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে আগেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। সবাই সহযোগিতা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। গত ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর দুদক প্রধান কার্যালয়ে দুদকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ শাখার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এফবিআই ও ইউএনওডিসির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে পৃথক বৈঠক হয়েছে। আইএমএফের সঙ্গে কয়েক মাস আগেও দুদকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে পারে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছেন।
দুদকের শীর্ষস্থানীয় একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে-বিদেশে পাচার হওয়া টাকার প্রমাণ সংগ্রহ করতে না পারায় এখনো অর্থ পাচারসংক্রান্ত দেড় শতাধিক অভিযোগের অনুসন্ধান অনিষ্পন্ন রয়েছে। ফলে তদন্ত কর্মকর্তাদের সেসব দেশে পাঠিয়ে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা যায় কি না, তা বিবেচনা করছে কমিশন। এতে বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয়ের সম্ভাবনা থাকায় বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকার চাইলে কমিশন ভবিষ্যতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
দুদকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশ-বিদেশে অর্থ পাচারসংক্রান্ত অন্তত ১৫৭টি মামলা অনিষ্পন্ন রয়েছে। এর মধ্যে গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১৪৮টি মামলা অনিষ্পন্ন ছিল। গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১৭টির অনুসন্ধান শেষে মামলা করা হয়। এ ছাড়া চলতি বছর জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৯ মাসে আরও ২৬টি অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, অর্থ পাচার রোধ ও পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেই আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ ধরনের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়। দুদকের এমএলএআর পাঠানো হয় অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের মাধ্যমে এবং এর জবাবও আসে একই মাধ্যমে। এমএলএআর-এ বলা হয়, অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করে সেসব দেশে অর্থসম্পদ গড়ে তুলেছেন, যা বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। অর্থ পাচারের অভিযোগে সেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুদক আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশে অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে-বেনামে থাকা অর্থসম্পদের দালিলিক তথ্য পাওয়া গেলে বিচারকাজে সহায়ক হবে।
এ প্রক্রিয়ায় ওই সময় (ওয়ান ইলেভেন) কানাডা, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে তথ্যউপাত্ত চেয়ে এমএলএআর পাঠায় দুদক। পরে বাংলাদেশ টাকা পাচারের শীর্ষ ১০ দেশসহ নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, ভারত, লুক্সেমবার্গ, বারমুডাসহ বিভিন্ন দেশের তালিকা করা হয়।
২০১৩ সালে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনিসহ দেশের কয়েকজন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকের পাচার করা টাকা ফেরত আনতে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, হংকং ও কানাডায় এমএলএআর পাঠানো হয়।
ভারতে পি কে হালদারের টাকা পাচারের ঘটনায় হাইকোর্টে দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে দেশে অর্থ পাচার আইনে ৫ বছরে (২০১৬ থেকে ২০২০) কতটি মামলা হয়েছে এবং কতজনকে আসামি করা হয়েছে, সেসবের তালিকা চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। নিদের্শনা অনুযায়ী, সে সময় প্রতিবেদন আকারে একটি তালিকা হাইকোর্টে জমা দেয় দুদক। প্রতিবেদনে ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত অর্থ পাচার আইনে ১৩৫টি মামলা দায়েরের কথা উল্লেখ করা হয়। এতে ৪৭টি মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল এবং বাকি ৮৮টির তদন্ত চলমান থাকার কথা বলা হয়। প্রতিবেদনে অর্থ পাচার মামলায় অভিযুক্তের তালিকায় এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বহিষ্কৃত কর্মচারী আবজাল, বিসমিল্লাহ গ্রুপের কর্ণধার খাজা সোলায়মান ও তার স্ত্রী, বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল আলম, জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ, ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান বাদল, ঢাকা ট্রেডিংয়ের কর্ণধার টিপু সুলতান, শাহরিস কম্পোজিট টেক্সটাইলের এমডি খাজা সোলেমান আনোয়ার, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান, যুবলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, ঠিকাদার জি কে শামিম, যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা সম্রাট, ক্যাসিনো সেলিম, এনটেক্সের কর্ণধার ইউনুস বাদল, এম এম ভেজিটেবলের চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন, এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াহিদুল হক, ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান বাবুল চিশতি ও তার ছেলে, ভোলার সাবেক এমপি হাফিজ ইব্রাহিম, লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক এমপি পাপুল, এনসিসি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান, লর্ড ভিশনের চেয়ারম্যান হোসাইন মাহমুদ রাসেল, সাবেক পুলিশ পরিদর্শক ফিরোজ কবীর, ডিএমপির হুমায়ুন কবীর বাতেন, সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সালাম, ইলিয়াস ব্রাদার্সের এমডি শামসুল আলম, টেলিটকের সাবেক ম্যানেজার শাহ মোহাম্মদ যোবায়ের, প্যারাডক্স ফার্মাসিউটিক্যালসের সাবেক এমডি রকিবুল হাসান রাজন, আমানত স্টিলের এমডি হারুনুর রশীদ, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন, এএমসি টেক্সটাইলের সাবেক চেয়ারম্যান চাঁদ মিয়া, আইন কমিশনের ড্রাইভার শামসুল আলমের নাম উল্লেখ করা হয়। অভিযুক্তরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে টাকা পাচার করেছেন বলে দুদকের প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অর্থ পাচারের অভিযোগে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ বেশকিছু প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী-এমপি, সাবেক আমলা ও রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।