গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কিংবা ভবিষ্যতের গণতন্ত্র বিনির্মাণে সেটাই হবে কার্যকর সাফল্য যদি মানুষের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। এখানে কূটকৌশলের দোলাচলে অভ্যন্তরীণ পটপরিবর্তন ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার ভয় দেখিয়ে বা ভয় পাইয়ে দিয়ে গণতন্ত্রকামী মানুষের মধ্যে টেকসই সম্পর্ক উন্নয়ন করা যাবে না।…
সারা বিশ্বে দেশে দেশে অঞ্চলভেদে গণতন্ত্রের বোধন ও উদ্বোধন উভয়ই চলছে। যুক্তরাজ্য, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ইরান, আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ও অঞ্চলে ভারত ও পাকিস্তানে, বাংলাদেশে পটপরিবর্তন ওলট-পালট চলছেই। আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভূ-রাজনীতির ভায়রা ভাইদের কর্মতৎপরতা বাড়ছে, মতিগতিতে বিভ্রম-বিভ্রাট কাটিয়ে ওঠার লক্ষণ স্পষ্ট হচ্ছে। ২০২৩ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ভাষণ দেওয়ার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গণতন্ত্রকে ভারত ও আমেরিকার আরাধনা ও চিন্তাচেতনার মূলমন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বয়সে এবং ভারত ব্যাপ্তিতে বৃহৎ গণতন্ত্র। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আরও বলেন, ‘আমরা বর্তমান বিশ্বে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটিয়ে উন্নত বিশ্ব এবং এর উন্নত ভবিষ্যৎ উপহার দেব’ [নরেন্দ্র মোদি: emphasized that democracy is one of the sacred and shared values between India and the US. Now US is the oldest and India the largest democracy. Our partnership augurs well for the future of democracy. Together we shall give a better future to the world and a better world to the future] গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এবং ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক বিশ্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের স্বঘোষিত ও স্বপ্রণোদিত দুই মোড়লের মননে ও মেধায় চানক্য পণ্ডিত (কৌটিল্য খ্রিষ্ট পূর্ব ৩৭৫-২৮৩) এবং আব্রাহাম লিংকন (১৮০৯-১৮৬৫) যে ধারণা বা আদর্শের বীজ বপন করেছিলেন, তার কী ধরনের চর্চা ও প্রয়োগের দ্বারা গণতান্ত্রিক বিশ্বের ভবিষ্যৎ নির্মাণ কোনো পর্যায়ে কার্যকর আছে কিংবা নেই, সর্বোপরি খোদ গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবয়বগত কোনো ধারণা তারা পোষণ করেন কিনা, তা বিস্তারিত বলার প্রাসঙ্গিকতা প্রধানমন্ত্রী মোদির সেই বক্তৃতায় ছিল না। বিশ্ব কূটনীতির ক্যানভাসে ভূ-রাজনীতির রংতুলিতে যে ভবিষ্যৎ পৃথিবী বাঙ্ময় হয়ে উঠবে তার রূপরেখা দুই দেশেরই পক্ষে খোলাসা করা হয়নি, বলা যায় সম্ভবও নয়। গণতন্ত্রের ধারণা এবং এর বিকাশ ও বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য-বিধেয়ের মধ্যে রয়ে গেছে যে গলদ, কার্যকরণে বিস্তর ফারাক, তা গণতন্ত্র লালনপালনে গণতন্ত্রের অপয়ার প্রতি ‘অন্ধ সমর্থন’ এবং ‘স্যাংশনের ভয়’ দেখানো সংস্কৃতির মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে।
২০২৩-এর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের ৭৮তম সাধারণ পরিষদ অধিবেশনের ‘বিশেষ বিতর্ক’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শংকর যেমনটি বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের নীতি হবে ‘শুধু’ পূর্বে তাকানো নয়, প্রাচ্যের দেশগুলোতে কার্যকরভাবে করণীয়তে তা রূপান্তর করা। জয়শংকর আরও বলেছিলেন, ‘আমরা এখন থেকে জোটনিরপেক্ষ প্লাটফর্মের পরিবর্তে ‘বিশ্ব মিত্র’র মূল্যবোধে ও দর্শনে আচারী হব।’ [জয়শংকর: announced the evolution of India’s foreign policy from the era of non-alignment to that of Viswa Mitra, a friend to the world] জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রদানের ক্ষমতাধর পাঁচ পরাশক্তির কারও বা তাদের মোর্চার মঞ্চের প্রতি না ঝোঁকার বা তাদের ক্রীড়নকে পরিণত না হওয়ার প্রত্যয়ে দীপ্ত হয়েই ভারতের জওহরলাল নেহরু, ইন্দোনেশিয়ার আদম মালিক, যুগোশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটো প্রমুখ ১৯৬০-৬১ সালে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের যে মঞ্চ তৈরি করেছিলেন, ৬০-৬২ বছরের মাথায় তা ভারতের বিশ্ব মিত্রর দর্শন স্বার্থের টানে পাঁচ পরাশক্তির সঙ্গে খাতির জমানোর এই অভিলাসের মধ্যে ভেঙে বা ভেস্তে যেতে বসেছে।
গত ৬ মার্চ ২০২৪ দ্য ডেইলি ব্যাংকক পোস্ট-এ প্রকাশিত টিটিপল ফাকদিওয়ানিস-এর রচনা ‘ইন্ডিয়াস বুড্ডিস্ট ডিপ্লোমেসি ইন অ্যাকশন’ [https://www.bangkokpost.com/opinion/2753734/ib‡ndias-buddhist-diplomacy-in-action]-এ বৃহৎ গণতন্ত্র ভারতের গণতন্ত্র আরাধনার সাম্প্রতিকতার স্বরূপ নির্ণয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রদত্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকরের উপরোক্ত মনোভাব উৎকলিত হয়েছে। এ নিবন্ধ রচনার পটভূমিতে টিটিপল থাইল্যান্ডের রাজার ২০২৩-এ ৭২তম জন্মদিন (জুলাই ২৮) এবং মাখা বুচা দিবস (২৪ ফেব্রুয়ারি) পালন উপলক্ষে ভারত তাদের দেশে সংরক্ষিত গৌতম বুদ্ধ এবং তার প্রধান শিষ্য সারিপুত্রের দুটি মূর্তি থাইল্যান্ডকে প্রদর্শনের জন্য ‘ধার’ দিয়েছিল, যা তখন থাইল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে প্রদর্শিত হয়েছিল। গৌতম বুদ্ধের অনুসারীদের দেশ থাইল্যান্ডে মূর্তি দুটির প্রদর্শনী বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। ভারত তাদের দেশে থ্রি-এ ক্যাটেগরিভুক্ত (অতি নিরাপদ সংরক্ষণযোগ্য এবং ভারতের বাইরে না পাঠানোর কড়া নির্দেশনা সত্ত্বেও) মূর্তি দুটি থাইল্যান্ডকে ফেরতযোগ্য ‘কর্জ’ দেওয়াকে টিটিপল ভারতের বৌদ্ধ কূটনীতির উদ্দেশ্য অভিসারী সফল প্রয়োগ বলে আখ্যায়িত করেন। কেননা, টিটিপল মনে করেন, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের অভ্যন্তরে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা চর্চার যে চরিত্র বিদ্যমান, সেখানে থাইল্যান্ডে বৌদ্ধদের ধর্মীয় সহানুভূতি অর্জনের অভিপ্রায়কে বিশেষ বিচেনায় নিতেই হয়। টিটিপল-এর আরও ধারণা- ভারত-থাইল্যান্ডের ধর্মীয় বন্ধনের এই প্রয়াসের পেছনে লোয়ার মেকং বেসিনে ভারতের প্রতি তাদের মিত্রতার বন্ধন জোরদারের অভীপ্সা উৎসারিত হতে পারে [whilst, this Buddhist diplomacy has enhanced Thai-India relations, the question arises whether it can elevate India’s position in the lower Mekong Basin] দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় প্রতিবেশী দেশ বা ইন্দো-প্যাসিফিকের প্রভাব ভাগাভাগির প্রশ্নে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র যখন একান্ত আলাপচারিতায় বসে তখন তাদের উভয়ের অভিন্ন প্রতিপক্ষ চীনের আঞ্চলিক আধিপত্য গ্রহণের কূটকৌশলের অসাফল্য কামনা এবং বে-অব বেঙ্গল, ওপর ও নিচের মেকং অঞ্চলে এমনকি সুদূর দূরপ্রাচ্যে (এশিয়া প্যাসিফিকে) কীভাবে চীনের প্রাগ্রসরমানতায় বাধ সাধা যায় তা তাদের মাথায় সব সময় রাখতেই হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে ভূ-রাজনীতির ভায়রা ভাইদের এভাবে বৈরিতার মধ্যে বন্ধুত্বের বাণী এবং ‘নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গের’ কূটকৌশল অবলম্বন করতে দেখা যায়। ভারতীয় কূটনীতিতে তাদের দীক্ষাগুরু চানক্য বা কৌটিল্যের ফতোয়া মাথায় থাকে। চানক্য একটু সামান্য ট্যারা ছিলেন। চিত্রকররা কৌটিল্যের যে অবয়ব এঁকেছেন, সেখানে তাকে কূটনৈতিক হাসিতে এবং একই সঙ্গে বিদ্রূপাত্মক রাজনৈতিক হাসিমাখা মুখ দেখা যায়। জোট নিরপেক্ষতার প্লাটফর্ম মাড়িয়ে বিশ্ব মিত্রর যে দর্শন, তা তো চানক্যীয় পলিটির মুখ নিঃসৃত ভাষা। চীনের রাগ জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, চীনের ব্যবসায়ী অনুরাগ মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের রাগ চীনের সঙ্গে দৃশ্যত সীমান্ত বিরোধের কারণে হলেও তাদের সিল্ক রুটে ভারতের কাটা বা কটাক্ষ হাসি পরিষ্কার করার মহৎ (?) চিন্তাভাবনার ফসল। চীন, ভারত, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের সীমানা রয়েছে মায়ানমারের। ‘আসিয়ান’-এর দুর্বল সদস্য মায়ানমারের জন্য মায়াকান্না জোড়া কার দরকার? মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি, যা এই মুহূর্তে চীনের মায়া মায়ানমারের প্রতি যেমন।
চানক্য ওরফে কৌটিল্য ঠাকুর যতই বিশ্বমানবতার স্বপক্ষে কথা বলেন- পাশের বা প্রতিবেশীর সঙ্গে আচরণে কখনো বড়ভাই, কখনো চিরশত্রুর সঙ্গে রাগ-অভিমান দেখানোয় কার্পণ্য না করতে পরামর্শ দিয়েছেন। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সমন্বয়ক জওহরলাল নেহরুর ডকট্রিন ছিল জন্মগত দোষে দুষ্ট। প্রতিবেশীর ঘরের কলা খাওয়ার বেলায় সম্পর্ককে অতি উচ্চে নেওয়ার বাহাস তার যেমন, তেমনি নিত্যপ্রার্থনা থাকে প্রতিবেশীর শক্তি-সামর্থ্য ও শান্তির বিরুদ্ধে সদা চঞ্চল থাকাটাও তার আরাধ্য উপাসনা।
মেকং অঞ্চলে ভারত তার ‘সহানুভূতি’ বা ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান ও সমীহের আশ্রয় নিয়েছে- পিপল টু পিপল’ সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য। ব্যাংকক পোস্টের নিবন্ধকার মন্তব্য করেছেন- মেকং অঞ্চলের দেশগুলোতে মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, দুর্বল গণতন্ত্রকে হরণ অর্থনৈতিক সমস্যার জালে জড়ানো জনগণকে শুধু ধর্মীয় অনুভূতি দিয়ে কতটা বাঁধা যাবে, তা দেখার বিষয়। খোদ ভারতের যেখানে স্বদেশি স্বগোত্রের মধ্যে রেষারেষি (ধর্মীয় কারণে বৈষম্য বিদ্যমান), সেখানে মেকং অঞ্চলে কীভাবে বিশ্বমিত্রতার বাস্তবে রূপ নেবে? নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ভারত তার নিজ সংসারে বসবাসকারী বৌদ্ধ সম্প্রদায়, যারা এশিয়ায় বৌদ্ধদের চাইতে সংখ্যায় বেশি তাদের সঙ্গে বিরোধ ও বিড়ম্বনা তুঙ্গে তুলে যে মোগল যুগে ভারতের স্থাপত্য শিল্প, আর্থিক প্রশাসন ও সামরিক বিদ্যা বিকাশ লাভ করেছিল সেই ৪ শতাধিক বছরের ইতিহাসকে মুছে ফেলার উদ্যোগ নিচ্ছে ধর্মীয় উগ্রবাদী ভারত। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে প্রচণ্ড স্ববিরোধী রাষ্ট্র ভারত প্রতিবেশী দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে বা কী অবস্থান নিয়েছে বা নিচ্ছে তাতে মেকং অঞ্চলেও বিশেষ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। নিবন্ধকার আরও স্পষ্ট করেছেন ‘Nevertheless, India can not entirely rely on the Buddhist and Hindu spiritual connections in order to “give a better future to the world, and a better world to the future’’ as Mr. Modi highlighted. Therefore, to be a friend to the lower Makong countries means being a friend to the local people, not just governments. ‘প্রকৃত প্রস্তাবে নিকট প্রতিবেশী এবং মেকং অঞ্চলে (আসিয়ানভুক্ত দেশ) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, চর্চা ও বিকাশে পরাশক্তিদের আন্তর্দ্বন্দ্ব বিসংবাদ যতই থাকুক না কেন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে অবশ্যই আরও পরিশীলিত নীতিকৌশলে ব্রতী হতে হবে এ জন্য যে, এসব দেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে না। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কিংবা ভবিষ্যতের গণতন্ত্র বিনির্মাণে সেটাই হবে কার্যকর সাফল্য যদি মানুষের গণতন্ত্র (মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর সাফল্যকে সবার সাফল্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির অবয়ব হিসেবে পাওয়া) প্রতিষ্ঠা পায়। এখানে কূটকৌশলের দোলাচলে অভ্যন্তরীণ পটপরিবর্তন ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার ভয় দেখিয়ে বা ভয় পাইয়ে দিয়ে গণতন্ত্রকামী মানুষের মধ্যে টেকসই সম্পর্ক উন্নয়ন করা যাবে না।
লেখক: আঞ্চলিক উন্নয়ন ও কূটনীতি বিশ্লেষক, সরকারের সাবেক সচিব