ঢাকা ২ শ্রাবণ ১৪৩২, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

স্বপ্নভুকের চাওয়া

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ১২:১৮ পিএম
আপডেট: ০৪ জুন ২০২৫, ১২:২২ পিএম
স্বপ্নভুকের চাওয়া
অঙ্কন: নিয়াজ চৌধুরী তুলি
অনেক কাঁটার বিষ
সহ্য করে
নৈকটে এসেছি সখা
ও বন্ধু জীবন
মৃত্যুভয় দেখিয়ো না
দোহাই তোমার
আমি হয়তো স্বপ্নভুক
সৃষ্টিছাড়া আধেক বিবাগী
সে কারণে বিষয় চেতনা
কখনো করেনি গ্রাস
মতিভ্রমও হয়নি কখনো
এসেছি গ্রহণ করো
ধন্য হও
আয়ুষ্মতী ঋতুমতী হও...

আবু সাঈদের মৃত্যুই আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১০:৪১ এএম
আবু সাঈদের মৃত্যুই আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

বাংলাদেশে শহিদ আবু সাঈদের নাম বললে তার সঙ্গে আর কিছু যুক্ত না করলেও চলে। কারণ ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর আবু সাঈদ যেন দ্রোহের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ গত বছরের ১৬ জুলাই তার আত্মত্যাগে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। দুই হাত প্রসারিত করে পুলিশের গুলির সামনে তার বুক পেতে দেওয়ার ওই ঘটনা ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়েছিল ছাত্র-জনতার মনে। তারই পথ ধরে কোটা আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আবু সাঈদের আত্মত্যাগের এই দিনটিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আজ ‘জুলাই শহিদ দিবস’ ঘোষণা করেছে। এ উপলক্ষে আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করা হবে। 

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলেন আবু সাঈদ। স্নাতকের সব পরীক্ষা দেওয়া শেষ করেছিলেন তিনি। অপেক্ষায় ছিলেন ফল পাওয়ার। ছয় ভাই-তিন বোনের মধ্যে একমাত্র উচ্চশিক্ষায় ছিলেন তিনি। পরিবারে সবার প্রত্যাশা ছিল, পড়াশোনা শেষে আবু সাঈদ একদিন ভালো চাকরি করবে। পরিবারের হাল ধরবে। কিন্তু আবু সাঈদের কপালে ছিল চিন্তার ভাঁজ। দেশে সরকারি চাকরিতে আবার ফিরেছে কোটা ব্যবস্থা। তখনই বুঝেছিলেন- চাকরি পাওয়ার পথ অনেক কঠিন। তৈরি হলো নানা অনিশ্চয়তা। তখনই কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে তরুণদের মিছিলে যুক্ত হন তিনি। বেরোবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবেও ভূমিকা রাখেন তিনি। জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে প্রতিদিনই সক্রিয়ভাবে অন্যদের নিয়ে বিক্ষোভে অংশ নিতেন আবু সাঈদ। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের আইডিতে আন্দোলনের পক্ষে জনমত তৈরিতে অসংখ্য পোস্ট দেন। কোটাব্যবস্থায় বৈষম্য নিয়ে বিভিন্ন বইয়ের তথ্য দিয়ে গ্রাফ আকারেও তুলে ধরেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে কোটাব্যবস্থার তুলনামূলক তথ্য উল্লেখ করে জনসাধারণকে আন্দোলন সমর্থনের আহ্বান জানান। পাশাপাশি আন্দোলনে অংশ নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্ধুদ্ধ করতেন তিনি। ৫৬ ভাগ কোটাব্যবস্থায় ভবিষ্যতে যে চাকরি মিলবে না সহজে তার বিশদ বর্ণনা দেন আবু সাঈদ। আন্দোলনকারীদের মনোবল বাড়াতে বিখ্যাত ব্যক্তিদের উক্তি শেয়ার করতেও দেখা যায় তাকে। সেরকম একটা উক্তি ছিল বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর। সেটি ছিল এই রকম-‘না লড়তে পারলে বলো। না বলতে পারলে লেখো। না লিখতে পারলে সঙ্গ দাও। না সঙ্গ দিতে পারলে যারা এগুলো করছে তাদের মনোবল বাড়াও। যদি তাও না পারো, যে পারে, তার মনোবল কমিও না। কারণ, সে তোমার ভাগের লড়াই লড়ছে।’

আবু সাঈদকে সরকারের বিভিন্ন বাধার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতেও দেখা যায়। ১১ জুলাই তিনি লেখেন, ‘ছাত্রদের আন্দোলনের কারণে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল। অতএব আঘাত করো না, প্রতিঘাত খুব ভয়ংকর হবে, আমরা আমাদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে জানি।’ একই সঙ্গে সরকারকে আন্দোলনকারীদের ভুল না বুঝে কোটা ১০ ভাগ রাখলেও ছাত্রসমাজ মেনে নেবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

আবু সাঈদ ছিলেন সাধারণ পরিবারের ছেলে। পোশাক-চালচলনে ছিল না কোনো আভিজাত্যের ছাপ। সংগ্রামে ভরা ছিল তার শৈশব, কৈশোর। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সুযোগ পান উচ্চশিক্ষার। শত প্রতিকূলতার মাঝে এসএসসি-এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া আবু সাঈদ ছিলেন তার লক্ষ্যে অবিচল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ভালো চাকরিতে যোগ দেওয়ার প্রত্যয়। ৫ জুলাই আবু সাঈদ লেখেন, ‘এই আন্দোলন শুধু আমাদের জন্য নয়। এটা আপামর জনসাধারণের গণ-আন্দোলন। কেননা আজকে যে ভাই রিকশা চালায় বা সবজি বিক্রি করে সেই ভাইও স্বপ্ন দেখে তার সন্তান বড় হয়ে একটা ভালো চাকরি করবে। কিন্তু এভাবে মেধাবীদের পথ আটকে দিলে আমার মতো এই বাংলার সব সাধারণ মানুষের স্বপ্ন মরে যাবে।’

আবু সাঈদের দুনিয়ার যাত্রা যে শেষ হচ্ছে দ্রুত সেটা নিজেই হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন! তার বেশ কয়েকটি ফেসবুক পোস্টে দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার স্পৃহা দেখা গেছে। মুষ্টিবদ্ধ হাতের স্টিকার দিয়ে আবু সাঈদ লেখেন- ‘সব থেকে যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো আপনি ন্যায়ের পক্ষে না অন্যায়ের পক্ষে। অন্যায়ের পক্ষে থেকে ১০০ বছর বাঁচার চেয়ে ন্যায়ের পক্ষে থেকে মরে যাওয়া অধিক উত্তম, সম্মানের, শ্রেয়।’ 

তার সর্বশেষ পোস্ট ছিল ছাত্রদের জন্য প্রাণ দেওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে নিয়ে। ১৫ জুলাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা করল সেই কঠিন সময়ের কথা স্মরণ করে কী আকুতি! আবু সাঈদ লিখেছেন- স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার! আপনার সমসাময়িক সময়ে যারা ছিলেন সবাই তো মরে গেছেন, কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি, আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত। একজন ‘শামসুজ্জোহা’ হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের।

১৬ জুলাই, ২০২৪ সাল। ঘড়ির কাঁটায় তখন আড়াইটার কাছাকাছি। দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে রংপুর শহরে মিছিল বের করা হয়। যার সর্বাগ্রে ছিলেন আবু সাঈদ। তীব্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ তার স্লোগানে। মিছিল যখন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে আসে, তখনই বাধা দেন পুলিশ সদস্যরা। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। পুলিশের তীব্র আক্রমণের মুখে ছত্রভঙ্গ হন আন্দোলনকারীরা। তবে পুলিশের রাবার বুলেট আর গুলির মুখে লাঠি হাতে প্রতিরোধ করতে থাকেন আবু সাঈদ। কোনোভাবেই পিছু হটছিলেন না। অদম্য মনোবলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন দুই হাত প্রসারিত করে। পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে একপর্যায়ে বসে পড়েন সড়কেই। অন্যরা হাসপাতালে নেওয়ার পথেই নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ।

তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শুরু হয় কোটা আন্দোলনে মৃত্যুর মিছিল। তার মৃত্যুর খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় তীব্র বিক্ষোভ। কাছাকাছি সময়ে চট্টগ্রামে প্রাণ হারান ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম। এদিন সারা দেশে প্রাণ যায় ৬ জনের। এরই মধ্যে আবু সাঈদের গুলিতে আহত হওয়ার ফুটেজ বের হয়ে আসে। টার্গেট করে তার দেহে গুলি করার দৃশ্য সবাইকে নাড়া দেয়। ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। গণদাবিতে রূপ নেয় কোটা ইস্যু। পুলিশের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দেওয়ার দৃশ্য ক্ষোভের আগুন বাড়ায়; যা পরে দাবানলে রূপ নেয়। সরকারের মন্ত্রীদের আবু সাঈদের মৃত্যু নিয়ে নানা মন্তব্যেও ব্যাপক ক্ষুব্ধ হয় আন্দোলনকারীরা। তারা স্লোগান তুলে, আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, আবু সাঈদ শুধু ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার কথা বলেননি, সেটা বাস্তবে প্রমাণও করে গেছেন।

আবু সাঈদের মৃত্যু কোটা আন্দোলনকারীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে যায় পরবর্তী দিনগুলোতে। ধারাবাহিক আন্দোলনে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। আবু সাঈদের মৃত্যুই টার্নিং পয়েন্ট ছিল আন্দোলনের। যা প্রধান উপদেষ্টাসহ বিশ্লেষকদের মূল্যায়নে উঠে আসে। অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে গুরুত্বসহকারে স্মরণ করা হয় আবু সাঈদকে। পাঠ্যপুস্তকে তাকে নিয়ে লেখা যুক্ত করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে আবু সাঈদের নামে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নামকরণ করা হয়।

আবু সাঈদের মৃত্যুর তিন মাস পরেই প্রকাশিত হয় তার স্নাতক পরীক্ষার ফলাফল। যেখানে দেখা যায়, সিজিপিএ-৩.৩০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন আবু সাঈদ। মেধা তালিকায় তার অবস্থান ছিল ১৪। একই সঙ্গে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। বেঁচে থাকলে শিক্ষকতার সুযোগ ছিল এই মেধাবী শিক্ষার্থীর।

আজ ১৬ জুলাই যা ঘটেছিল
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। এই দিন কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হামলা, সংঘর্ষে ৬ জন প্রাণ হারান। রাজধানী ঢাকায় ২ জন, চট্টগ্রামে ৩ জন এবং রংপুরে ১ জন প্রাণ হারান। গুলিবিদ্ধসহ পাঁচ শতাধিক আহত হন। মোতায়েন করা হয় বিজিবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ক্যাম্পাস সংলগ্ন চানখাঁরপুলেও ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ঢাকার সাইন্সল্যাব ও ধানমন্ডিতে সবুজ আলী ও শাহজাহান নামে গুলিতে নিহত হন দুজন। চট্টগ্রামে ওয়াসিম একরাম, ফয়সাল ও ফারুক নিহত হন। রংপুরে প্রাণ হারান আবু সাঈদ। এ দিন মহাখালীতে রেললাইন অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। কিশোরগঞ্জ, ঝিনাইদহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করা হয়।

জুলাই শহিদ দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় শোক পালন আজ
‘জুলাই শহিদ দিবস’ উপলক্ষে আজ ১৬ জুলাই রাষ্ট্রীয় শোক পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় শোক পালন করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সব সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশের বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। আজ শহিদদের মাগফিরাতের জন্য বাংলাদেশের সব মসজিদে বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হবে। অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তাদের আত্মার শান্তির জন্য বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে।

জুলাই শহিদ দিবসে বেরোবিতে যাচ্ছেন ৪ উপদেষ্টা
‎রংপুর প্রতিনিধি জানান, ‎রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ ১৬ জুলাই পালিত হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহিদ আবু সাঈদের শাহাদতবার্ষিকী ও ‘জুলাই শহিদ দিবস’। দিনটি উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন অন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টা। দিনটি ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও এ উপলক্ষে আজ রংপুরের পীরগঞ্জে যাচ্ছেন। দলগুলোর সেখানে ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। 

‎বেরোবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন আবু সাঈদের বাবা। যে চার উপদেষ্টা অতিথি হিসেবে থাকবেন তারা হলেন- আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা প্রফেসর ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম। এ ছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের এবং বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. তানজীমউদ্দীন খান।

‎কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- বেরোবি ক্যাম্পাস থেকে সকাল ৬টায় আবু সাঈদের গ্রামের বাড়ি পীরগঞ্জ উপজেলার জাফরপাড়ার বাবনপুর গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা, সকাল সাড়ে ৭ টায় শহিদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত, সকাল সোয়া ৯টায় কালোব্যাজ ধারণ ও শোক র‌্যালি, সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শহিদ আবু সাঈদ তোরণ ও মিউজিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, সোয়া ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন শহিদ আবু সাঈদ চত্বরে আবু সাঈদ স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, সাড়ে ১০টায় আলোচনা সভা, বেলা সাড়ে ৩টায় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং বাদ আসর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল।

‎বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকাত আলী জানান, আবু সাঈদের শাহাদতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে থাকবেন চার উপদেষ্টা। এ ছাড়া আরও ২১ শহিদ পরিবারের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। 

এ ছাড়া আজ পীরগঞ্জের জাফর পাড়ার বাবনপুরে শহিদ আবু সাঈদ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ওই এলাকার সকল মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
জুলাই ঘোষণাপত্র ও উন্নয়ন বঞ্চিত রংপুরকে এগিয়ে নিতে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে রংপুর মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জেলার বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা পদযাত্রা করবেন।

জুলাইযোদ্ধা সিয়াম আহসান আয়ান সাঈদ ভাইকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করি

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১০:১১ এএম
আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১০:২১ এএম
সাঈদ ভাইকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করি
গত বছরের ১৬ জুলাই আবু সাঈদকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন সহযােদ্ধা সিয়াম হাসান আয়ান। (ফাইল ফটো)

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বুক চিতিয়ে দিয়ে পুলিশের গুলিকে বরণ করেছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহিদ আবু সাঈদ। তাকে যখন গুলি করা হচ্ছিল, তখন নিজের জীবন বাজি রেখে এগিয়ে গিয়েছিলেন জুলাইযোদ্ধা সিয়াম আহসান আয়ান। নিজে গুলি খেয়ে হলেও আবু সাঈদকে বাঁচাতে হবে এমন প্রতিজ্ঞা নিয়েই এগিয়ে গিয়েছিলেন অকুতোভয় আয়ান।

সিয়াম আহসান আয়ান রংপুর সদরের আলমপুর পীরপুরের মো. আহসান উল হক তুহিন ও সঞ্চিতা পারভীন দম্পতির প্রথম সন্তান। তিনি রংপুরের আরসিসিআই পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী।

ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে আয়ান বলেন, “১১ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত আন্দোলনটা ছিল ক্যাম্পাসভিত্তিক। ১৫ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অ্যাটাক হওয়ার পর আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে আন্দোলনের ডাক দিই। এতে রংপুরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেন আন্দোলনে যোগ দেওয়ার। পরে জেলা স্কুল থেকে মিছিল নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা হই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানাতে। এ সময় পুলিশ আমাদের লাঠিপেটা করে। এরপর আমরা খামার মোড়ে গেলে দেখি ছাত্রলীগের কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের ওপরে আক্রমণ করতে। আত্মরক্ষার জন্য আমরা গাছের ডালপালা হাতে নিই। এ সময় পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের ছেলেপেলেরা আমাদের ধাওয়া দেন। একপর্যায়ে সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে মারে পুলিশ। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ছেলে লাঠি নিয়ে বুক চিতিয়ে আছেন। পুলিশ তাকে গুলি করল দুবার। আমি মনে করেছিলাম রাবার বুলেট। কিন্তু বেরোবির গেটের ভেতর থেকে তখন এক পুলিশ বলছিল ‘এত ক্লোজ শুট করিয়েন না মারা যাবে।’ আমি বুঝলাম এটা অন্য কিছু। পরে মনে হলো কিছু হোক আর না হোক, ছেলেটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। আমি সাইদ ভাইয়ের ১৫ থেকে ২০ হাত দূরে। ভাইয়ের হাত ধরা মাত্রই দেখলাম পুলিশ আবার বন্দুক আমাদের দিকে তাক করছে। আমি সাঈদ ভাইকে তুলে আমার ডান পাশে নিলাম যদি গুলি লাগে আমার গায়ে লাগুক। পরের গুলিটা আমার গায়েই লেগেছে। দেখলাম সাঈদ ভাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। ভাই তখন আমার গলা ধরেন এবং বলার চেষ্টা করেন যে ভাই আমাকে বাঁচাও। কিন্তু তার গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছিল না। পরে ভাইয়ের বডিটা রিকশা করে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।”

আয়ান বলেন, ‘আবু সাঈদ ভাইয়ের মৃত্যুর পর বিভিন্ন জায়গায় বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয় যে মাথায় লাঠি লেগেছিল বলে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু এটা সঠিক তথ্য নয়। ১৮ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত আন্দোলন ছিল শিক্ষার্থীদের। তারপর থেকে ছাত্র-জনতার আন্দোলন হয়ে গেছে। সাইদ ভাইকে নিয়ে যাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট হঠাৎ করে খুলে যায়। ছাত্রলীগের ৫০ থেকে ৬০ জন ছেলেপেলে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বের হলেন। আমাদের হাতে ছিল গাছের ডালপালা আর ওদের হাতে ছিল অস্ত্র। এভাবেই ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলেছে। আমরা যখন বেশি এগিয়ে আসছি তখন পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়েছে। এর মধ্যেই কারমাইকেল কলেজ ও পলিটেকনিক্যাল থেকে ছাত্ররা মিছিল ঢুকে আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। আমাদের টার্গেট ছিল গেট ভেঙে ঢুকে ছাত্রলীগকে কিভাবে শায়েস্তা করা যায়। এ সময় খবর আসে আবু সাঈদ মারা গেছেন। খবর শুনে কেউ নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। পরে বেরোবির গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ি। ততক্ষণে ছাত্রলীগ পালানো শুরু করেছে।’

আবু সাঈদকে কেন বাঁচাতে গেলেন জানতে চাইলে আয়ান খবরের কাগজকে বলেন, ‘মানুষ একবার জন্ম নেয়, মৃত্যুও হয় একবার। মৃত্যু আসবেই এটা কনফার্ম। সামনে একটা ছেলে মারা যাচ্ছেন কেউ তাকে বাঁচাতে আসছেন না। আমার এইটুকু চিন্তা ছিল হয়তো মারা যেতে পারি। তাই শেষ চেষ্টা করি যাতে বাঁচানো যায় আবু সাঈদ ভাইকে। মারা গেলে দুজন মিলেই যাই। আমি সাঈদ ভাইয়ের জায়গায় হয়তো থাকতে পারতাম। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই আমি আবু সাঈদ ভাইকে বাঁচাতে এগিয়ে যাই।’

‘ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছি না, এটাই দুঃখ’

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১০:০৪ এএম
আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১০:০৫ এএম
‘ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছি না, এটাই দুঃখ’
শহিদ আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম। ছবি: খবরের কাগজ

‘এক বছর হয়ে গেল আমার ছেলেটা নেই। যারা জড়িত তাদের সরকার ধরুক। এক বছরেও তো বিচার হলো না। আর কবে ধরবে?’ কথাগুলো বলছিলেন গত বছর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম।

গত রবিবার (১৩ জুলাই) রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার জাফরপাড়ার বাবনপুরে শহিদ আবু সাঈদের বাড়িতে কথা হয় মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে। 

মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘শুনেছি এ ঘটনার সঙ্গে অনেকে জড়িত। তারা টার্গেট করে আমার ছেলেকে মেরেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে শেখ হাসিনা যেভাবে বলেছিলেন, তিনি সেভাবেই কাজ করেছেন। কারণ তার নিজের চাকরি যাওয়ার ভয় ছিল। এখন তার (প্রক্টর) বাবা-মা আমার কাছে এসে বলেন, তাদের ছেলের কোনো দোষ নেই। তিনি কিছু জানেন না। কিন্তু আসলেই কি প্রক্টর কিছুই জানতেন না? শেখ হাসিনাকে তিনি কেন চিঠি দিয়ে জানাননি যে আবু সাঈদ আমার দেশের সন্তান। হাসিনাকে তো বলতে পারতেন, সে (আবু সাঈদ) আমার দেশের সন্তান- তার সঙ্গে আমরা এমনটা করতে পারব না। এমনটা বললে হয়তো আমার ছেলে বাঁচত। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। তিনি ভেবেছিলেন, আবু সাঈদের বাবা-মা গরিব। ওকে মারলে কিছু হবে না। উনি একটু সাহায্য করলে আমার ছেলে বেঁচে যেত।’

তিনি বলেন, ‘প্রক্টরের দোষ আছে বলেই তিনি এখন জেলে আছেন। দোষ না থাকলে কী আর কেউ জেলে থাকে? আমার ছেলেকে বাঁচালে উনিও বাঁচতে পারতেন। এখন প্রক্টরের বাবা-মা এসে আমার হাতে-পায়ে ধরেন। কিন্তু আমি কী করব? ১৬ জুলাই আমার ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দিলে ও বেঁচে যেত। আমার ছেলে যে দাবি করেছিল, শেখ হাসিনা যদি তা মেনে নিতেন তাহলে আমার ছেলেও বাঁচত, শেখ হাসিনাও থাকতেন। আমার ছেলেকে মেরে ফেললেন। আল্লাহ যেন আমার ছেলেকে জান্নাত নসিব করেন।’

আবু সাঈদের মা বলেন, ‘এখন আমার একটাই দুঃখ, ছেলেটাকে দেখতে পারছি না। কোটা আন্দোলনে ছেলে আমার যেগুলো বলেছিল, গতকাল সেগুলো মোবাইলে দেখেছি। শুধু দেখতে পেয়েছি। ওর কণ্ঠ শুনতে পাইনি। কত ভদ্র ছিল আমার ছেলে। আমার এই ছেলের জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। আমার কথা একটাই, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, আমার ছেলের স্মৃতি যেন ততদিন থাকে। আবু সাঈদ জীবন না দিলে দেশটা ঠাণ্ডা (স্বাভাবিক) হতো না। ও জীবন দিয়ে সবাইকে বাঁচিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ছেলেটা বেঁচে থাকলে আজ আমার সামনে ঘুরে বেড়াত। যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সবাই আছে, কেবল ও নেই। বেঁচে থাকলে আজ নিশ্চয় ও একটা চাকরি পেত। কত আনন্দ করত! কিছুই হইল না আর। আবু সাঈদ মেধাবী ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। ছেলের কণ্ঠ শুনতে মনটা ছটফট করে। আল্লাহ নিয়ে গেছে। তাই ধৈর্য ধরেছি। আল্লাহর কাছেই বিচার দিই। কপালে লেখা ছিল, তাই এটাই হয়েছে।’

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দেশ তো এখনো শান্ত হয়নি। শুনছি এখনো গণ্ডগোল হয়। এখনো মারামারি হয়। সরকার হিসেবে যেই আসুক, আমার মতো আর কোনো মায়ের কোল যেন খালি না হয়।’ 

তিনি বলেন, ‘সবখানে টাকার খেলা। গরিবের ঘরে মরণ আর ধনীর ঘরে জয়, এমনটা যেন আর না হয়। আমার একটাই কথা, মানুষ যেন টাকা ছাড়া চাকরি পায়। যে উপযুক্ত, চাকরিতে যেন শুধু তাকেই নেওয়া হয়। মেধার মূল্যায়ন করা হয়। আবু সাঈদ সত্যের জন্য জীবন দিয়েছে, মিথ্যার জন্য নয়।’

‘আবু সাঈদ ছিলেন দায়িত্ববান, মহানুভব ও উদার মানসিকতার অধিকারী’

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ০৯:৫৪ এএম
আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১০:০৫ এএম
‘আবু সাঈদ ছিলেন দায়িত্ববান, মহানুভব ও উদার মানসিকতার অধিকারী’
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বেরোবির শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পর তার বাড়িতে স্বজনদের আহাজারি (বামে) একই দিনে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে পুলিশের টিয়ার শেল নিক্ষেপ। খবরের কাগজ ফাইল ফটো

‘আবু সাঈদের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, সে ছিল দায়িত্ববান। তার ছিল উদার মানসিকতা ও মহানুভবতা। কেউ বলতে পারবে না তার কাছ থেকে কোনো কিছু চেয়ে ফেরত এসেছে। আবু সাঈদ ছিল সবার ভরসাস্থল।’

কথাগুলো বলছিলেন আবু সাঈদের সহপাঠী ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সোনিয়া বিনতে সিদ্দিক।

গত সোমবার কথা হয় সোনিয়া সিদ্দিকের সঙ্গে। তিনি আরও বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সবাইকেই ডাকত সাঈদ। চিন্তা-ভাবনায় ও দূরদর্শীসম্পন্ন ছিল আবু সাঈদ। কেউ কঠিন কোনো কিছু করতে গেলে মেলাতে না পারলে প্রথম ভরসা ছিল আবু সাঈদ। সে ছিল আপসহীন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। যার কারণে সে পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়িয়েছিল।’

সহপাঠীদের কাছ থেকে জানা যায়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্কের মোড় এলাকার চক বাজারে পপি ছাত্রাবাসের ৩ নম্বর কক্ষে থাকতেন আবু সাঈদ। সাদামাটা জীবনযাপন করতেন আবু সাঈদ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। 

আবু সাঈদের কক্ষে থাকতেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতিদিন আন্দোলন শেষে ঘরে ফিরে কোটা আন্দোলন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতেন তিনি। কোনো কিছু ঘটলে আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক সুমনের মোবাইল নম্বর দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলতেন।

আশরাফুল বলেন, ‘আবু সাঈদ ভাই সব সময়ই পড়াশোনার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতেন। সারাক্ষণই শান্তশিষ্ট থাকতেন।’

তিনি বলেন, ‘১৬ জুলাই ঘুম থেকে উঠে দেখি বের হয়ে গেছেন আবু সাঈদ। আমি বাইরে গিয়ে দেখি পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হচ্ছে। আমার মেসের একজন আহত হলে পরে মেসে নিয়ে আসি।’

ছাত্রাবাস এলাকার মুদি দোকান টিটু স্টোরে নিয়মিত বসতেন আবু সাঈদ। ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে দোকানের মালিক টিটু বলেন, ‘আন্দোলনের আগের দিন রাত ২টা পর্যন্ত এই দোকানেই বসে খুব কষ্ট প্রকাশ করছিল আবু সাঈদ। ছাত্রলীগ সভাপতি পোমেল বড়ুয়া তাকে চড় মেরেছিলেন। এ জন্য মন খারাপ ছিল তার। আবু সাঈদ জানিয়েছিল, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে মডার্ন মোড়ে অবস্থান নিতে চাইলে পোমেল বড়ুয়া আন্দোলনকারীদের ঢুকতে দেননি। এ নিয়ে বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে পোমেল বড়ুয়া চড়-থাপ্পড় মারেন আবু সাইদকে। ওই ক্রোধ থেকেই পরদিন আন্দোলনে যায় সে।’ 

টিটু বলেন, “আবু সাঈদ যখন ১৬ জুলাই আন্দোলনে যাচ্ছিল, তখন আমি জানতে চাই কোথায় যাচ্ছ, উত্তরে আবু সাঈদ বলে, ‘ভাই আন্দোলনে যাচ্ছি যদি ফিরে আসি দেখা হবে, না আসলে দোয়া করবেন।’ আমি বলি সাবধানে থাকিও। শেষ দিন না খেয়েই আন্দোলনে গিয়েছিল আবু সাঈদ।”

 ছাত্রলীগের অত্যাচারে মৃত্যু হতে পারে অথবা গুম হওয়ার ভয়ে নিজের ও আন্দোলনে যাওয়া অন্য সহপাঠীদের মোবাইল নম্বর ওই কক্ষে থাকা আশরাফুলকে দিয়ে রাখতেন, যাতে বড় কিছু ঘটলে স্বজনদের কাছে খবর পৌঁছে দিতে পারে।

আবু সাঈদের সহপাঠী ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক শামসুর রহমান সুমন বলেন, ‘আবু সাঈদ তার রুমমেটকে আমার নম্বর দিয়েছিল। আমিও আবু সাঈদের নম্বর দিয়েছিলাম আমার পরিচিতজনদের, কেউ মিসিং হলে যাতে সংবাদ পায় মানুষ। এতটাই দায়িত্ববান ছিল আবু সাঈদ। তার প্রতি প্রথম থেকেই ছাত্রলীগের আক্রোশ ছিল। ১৬ জুলাই তাকে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটা হত্যাকাণ্ড ছিল।’

আবু সাঈদ ছিলেন পরিবারের বাতিঘর

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ০৯:২৯ এএম
আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৫, ০৯:৩১ এএম
আবু সাঈদ ছিলেন পরিবারের বাতিঘর
জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ আবু সাঈদের কবর ছুঁয়ে কথা বলছেন তার বাবা মকবুল হোসেন। ছবি: খবরের কাগজ

পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে গত বছরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নতুন মোড় এনেছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তার মৃত্যুতে এখনো শোকাহত তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা। তবে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে তারা হতাশায় ভুগছেন।

আবু সাঈদের মৃত্যুর সাড়ে ১১ মাস পর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও প্রক্টর, গুলি করা দুই পুলিশ সদস্য, ছাত্রলীগ নেতাসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগপত্র আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ তৎকালীন প্রশাসনের যারা জড়িত, তদন্ত সাপেক্ষে সবাইকে আইনের আওতায় আনার দাবি পরিবার ও প্রতিবেশীদের।

মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) কথা হয় আবু সাঈদের পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসীর সঙ্গে। আবু সাঈদের বোন সুমি খাতুন বলেন, ‘ভাইয়ার সাহসিকতা দেখে অন্য ছাত্ররা দেশ স্বাধীন করল, ফ্যাসিবাদী সরকারকে বিদায় করল। তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ যে ভাইয়ার জীবন বৃথা যেতে দেয়নি। ফ্যাসিবাদ সরকার এই দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো। আমরা চাই এ রকম ফ্যাসিবাদী সরকার যেন আর দেশে না আসে। এ রকম সরকার গঠন করার সাহস যেন আর কেউ না করে। ছাত্রসমাজ যেন সব সময় সজাগ থাকে। প্রত্যেক মানুষ যেন তাদের মৌলিক অধিকারগুলো আদায়ের ব্যাপারে সোচ্চার থাকে। তবে কোনো ন্যায্য দাবি নিয়ে বুলেটের সামনে যেন আর কোনো মায়ের সন্তানকে দাঁড়াতে না হয়। তাদের তাজা প্রাণ দিয়ে যেন এই অধিকার আদায় করতে না হয়।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে সুমি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের হত্যার বিচারটা এখনো আমরা পাই নাই। আমার চাওয়া, এ হত্যাকাণ্ডের বিচারটা যেন তাড়াতাড়ি হয়। আমার ভাইকে যেভাবে প্রকাশ্যে গুলি করে মারা হয়েছে, সেভাবে প্রত্যেকটা আসামিকে যেন সাজা দেওয়া হয়। প্রত্যেককে যেন সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি দেওয়া হয়। আমরা চাই যে ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে, তার বাইরে যদি কেউ এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাদেরও বিচারের আওতায় আনা হোক। সেই সঙ্গে এটাও চাই, কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির যেন সাজা না হয়।’

আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলেকে যারা হত্যা করছে তারা যেন কোনোভাবেই পার না পায়। ছাত্রদের সাক্ষীতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরসহ ৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আমার চাওয়া, আমার ছেলে হত্যার ন্যায্য বিচার।’

এলাকাবাসী জানান, এলাকার মানুষের উপকারে কাজ করতেন আবু সাঈদ। বাড়িতে এলেই দিনভর মানুষের সমস্যা খুঁজে সমাধানের চেষ্টা করতেন। সেই সঙ্গে তরুণসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতেন পড়াশোনা করতে।

শহিদ আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম

শহিদ আবু সাঈদের বাল্যবন্ধু রাশেক কবির কনক বলেন, ‘বাড়িতে এলেই বন্ধু আবু সাঈদ ব্যাগ রেখেই আমার কাছে আসতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হলো, আগামীতে কী হবে, কীভাবে নিজেকে গড়তে হবে, সেই সঙ্গে সমাজকে কীভাবে এগিয়ে নিতে হবে, এ বিষয়গুলো নিয়ে সারাক্ষণই কথা হতো তার সঙ্গে। এক বছর অতিক্রম হয়ে গেল, আর কারও মুখে শোনা যায় না এমন কথা।’

আবু সাঈদ ফাউন্ডেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল আমিন বলেন, ‘এক বছর পার হলেও চোখের সামনে ঘুরছে আবু সাঈদ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেই এলাকার মানুষের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন। আর সারাক্ষণ সবাইকে পড়ালেখায় উদ্বুদ্ধ করতেন। এখন আর এমনটা করার কেউ নেই।’ 

আবু সাঈদ হত্যার বিচার নিয়ে তিনি বলেন, ‘এক বছর পার হয়ে গেল, এখনো এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। এ ঘটনায় যাদের আসামি করা হয়েছে, শুধু এরাই নন, এদের বাইরেও অনেকে জড়িত ছিলেন। তাদেরও তদন্ত সাপেক্ষে আইনের আওতায় আনা উচিত। দিনের আলোর মতো দেখা যাচ্ছে পুলিশ গুলি করে মারল। সেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি।’

আবু সাঈদ হত্যা মামলার বাদী এবং বড় ভাই রমজান আলী বলেন, ‘ছয় ভাইয়ের মধ্যে আবু সাঈদ সবচেয়ে ছোট ছিল। একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আবু সাঈদ ছিল আমাদের পরিবারের বাতিঘর। সেই বাতি পরিবার থেকে নিভে গেছে, আলো চলে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘গত বছরের ১৬ জুলাই নির্মমভাবে পুলিশ আমার ভাইকে হত্যা করেছে। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যারা জড়িত, তাদের অনেককেই শাস্তির আওতায় আনা হয়নি এবং এক বছরে কোনো ফল দেখতে পাইনি। যার কারণে আমরা অনেক হতাশ। সরকারের কাছে আবেদন এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে জড়িতদের সবাইকে যেন শাস্তির আওতায় আনা হয়।’