
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিলকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন এখন অতি ব্যস্ত সময় পার করছে। কারণ চলতি নভেম্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহেই তাদের তফসিল ঘোষণা করার কথা রয়েছে। ওই তফসিলের দিকে নজর রেখেই বিএনপি তার পরবর্তী আন্দোলনের ছক সাজাচ্ছে। তফসিল ঘোষণার পরই নির্বাচনে মাঠে নামার পাশাপাশি রাজনীতির মাঠও দখলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। এ কারণে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাজনৈতিক আসল ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হবে তফসিল ঘোষণার পরপরই।
ফলে সরকার ও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি, সুধীসমাজ ও সচেতন জনগোষ্ঠীসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলের নজর এখন নির্বাচনের তফসিলের দিকে। তাদের মতে, তফসিলকে কেন্দ্র করেই দেশে নির্বাচনপূর্ব তথা আগামী দিনের রাজনীতির মেরূকরণ তৈরি হবে এবং স্পষ্ট অবয়ব পাবে।
একাদশ সংসদের সর্বশেষ অধিবেশন শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর)। সংসদে এর পরের অধিবেশনটি বসবে দ্বাদশ সংসদের। দ্বাদশ এই সংসদ নির্বাচনের জন্য ইসি ও সরকারের পক্ষ থেকে একদিকে তোড়জোড় চলছে। অন্যদিকে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলো ওই নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। তবে এমন জটিল পরিস্থিতির মধ্যেও নির্বাচন অনুষ্ঠানের যাবতীয় প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে ইসি। নির্বাচনের জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে ইসি। চলছে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আগামীকাল দুই দফায় নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রস্তুতি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক বিভিন্ন স্তরের কমর্তাদের সঙ্গেও দফায় দফায় আলোচনা চলছে ইসির। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা করা হবে।
তবে তফসিলের পরে একদিকে দেশের রাজনীতিতে সহিংসতা তৈরির আশঙ্কা যেমন রয়েছে, তেমনি কোন দল কী অবস্থান নেয়, নির্বাচনে কে অংশ নেয় বা বর্জন করে, দলগুলোর মধ্যে কোনো ভাঙন পরিস্থিতি তৈরি হয় কি না- এসবই নির্ধারিত। আবার ঘোষণা অনুযায়ী বিএনপির এক দফার আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতাও নির্ধারিত হবে তফসিলের পরে। কারণ, বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত বা শেষ ধাপ শুরু হবে তফসিল ঘোষণার পরপরই। দলটি ওই আন্দোলন কতদূর পর্যন্ত টেনে নিতে পারে, সেটিও তফসিল ঘোষণার পরপরই বোঝা যাবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে তফসিল ঘোষণার পরেও বহুবার তারিখ পরিবির্তিত হয়েছে। এমনকি নির্বাচন বাতিল পর্যন্ত হয়েছে, এমন উদাহরণও আছে। সুতরাং সরকার নির্বাচন তফসিল ঘোষণা করল কি না, তাতে বাংলাদেশের জনগণের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন থেমে থাকবে না।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর পরবর্তী পদক্ষেপ বা পরামর্শও তফসিলের পরেই জনমনে স্পষ্ট হবে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন দমনে সরকারকে আপাতত হার্ডলাইনে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর এই অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটে কি না, তাও দেখার অপেক্ষায় রয়েছে দেশের সচেতন মহল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো; বিএনপির নেতৃত্বাধীন দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য হয়, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলতে শুরু করবে তফসিল ঘোষণা পরবর্তী পরিস্থিতিতে। ওই সময়ের আন্দোলনের গতিবেগ এবং বড় দুই দলের কর্মকৌশলের সফলতা-ব্যর্থতার ওপর নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে নির্ভর করছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিলতর হবে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার কোনো পথই আর খোলা থাকছে না। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিক কাঠামোকে অস্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা বোঝা যাবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুলউল্লাহ মনে করেন, তফসিল ঘোষণার পর দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অনেকটা শিথিল বা ঠাণ্ডা হতে পারে। জাতীয় রাজনীতির অনেক স্পেকুলেশন কেটে যাবে। তার মতে, তফসিল ঘোষণা মানে নির্বাচনের ঘণ্টা বেজে গেল। নির্বাচন যারা করবে, তাদের মাঠে নেমে যেতে হবে। তাদের অবস্থানও স্পষ্ট হবে। এমনকি বিএনপিরও মনোভাবের পরিবর্তন হতে পারে। কারণ দলটি ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে। দলটির চেয়ারপারসন অসুস্থ। ভারপ্রাপ্ত যিনি দল চালাচ্ছেন, তারও তো একটা বিবেচনা করতে হবে। নেতা-কর্মীদের ধরে রাখা খুব কঠিন।
বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনের বাইরে থাকলে সহিংসতা কীভাবে কমবে এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, সব দল অংশ নিলে টেনশন কমে যাবে।
এদিকে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বাইরেও যত বেশিসংখ্যক দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসা যায়, সেই চেষ্টা করছেন ক্ষমতাসীনরা। এজন্য পর্দার আড়ালে ছোট ছোট বেশকিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে আওয়ামী লীগ। নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি একাধিক সংস্থার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ চলছে। তবে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে ওই প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে রূপ লাভ করবে না। কারণ দলগুলো এ বিষয়ে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করছে। এমনকি সরকারের মিত্র বলে পরিচিত জাতীয় পার্টিও এ প্রশ্নে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছে।
একটি সূত্রের দাবি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিএনপির সঙ্গে থাকা সমমনা কয়েকটি দলকে কেন্দ্র করেও এমন আলোচনা আছে। তবে ওই দলগুলোও কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করে এখন বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনের মাঠে আছে। তবে তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা দেখে তারাও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মওলানা আবদুল হালিম খবরের কাগজকে জানান, তফসিল ঘোষণা হলেও জামায়াত নির্বাচনে যাবে না। বরং দাবি আদায়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, আমরা এখন তফসিল ঘোষণা না করার জন্য আন্দোলন করছি। তবে এটি ঠিক, সরকার বাড়াবাড়ি করলে তফসিলের পরে আন্দোলনের নতুন মাত্রা যোগ হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামায়াতকে নিয়ে যারা সংশয় সন্দেহে ভোগেন, তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করেন। যথাসময়েই সব স্পষ্ট হবে।
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি খবরের কাগজকে বলেন, নির্বাচন ঘনিয়ে এলে এমন অনেকের কথা শোনা যায়। তবে এমপি হওয়ার জন্য কেউ চেষ্টা করছেন কি না, তা আমার জানা নেই। আমি আশা করব, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সব দলের রাজনৈতিক অবস্থান অটুট থাকবে।