নানা অপকর্মের কারণে এবারের নির্বাচনে অর্ধশতাধিক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। তবে বিতর্কিত কয়েকজন সংসদ সদস্য আবার ঠিকই মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন। গতকাল সোমবার মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে তাদের প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে আবারও সংসদ সদস্য হওয়ার পথে অনেকটাই এগিয়ে গেলেন বিতর্কিতরা।
নির্বাচনে বিতর্কিত যেসব সংসদ সদস্য আবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৬ জন হলেন, নাটোর-২ শফিকুল ইসলাম শিমুল, ঢাকা-১৮ হাবিব হাসান, চট্টগ্রাম-১৫ আবু রেজা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী, টাঙ্গাইল-২ তানভীর হাসান ছোট মনির, ঝিনাইদহ-৪ আনোয়ারুল আজিম আনার, রাজশাহী-১ ওমর ফারুক চৌধুরী।
ঢাকা-১৮ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য হাবিব হাসানের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও এলাকাবাসীর অভিযোগের অন্ত নেই। গত ৮ অক্টোবর হাবিব হাসানের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চার পৃষ্ঠার একটি অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। একই অভিযোগপত্র দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যানকেও দেওয়া হয়।
অভিযোগে বলা হয়, ‘হাবিব হাসান এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর জনকল্যাণমূলক কাজে মনোযোগ না দিয়ে সুকৌশলে অবৈধ আয়ের উৎসগুলো চিহ্নিত করেন। এর মধ্যে রয়েছে- ভূমিদস্যুতা, অবৈধ কাঁচাবাজার, পরিবহনে চাঁদাবাজি (লেগুনা/ অটোরিকশা), ডিশ-ইন্টারনেট অ্যান্টেনা, ফুটপাতে চাঁদা সংগ্রহ, ডোনেশনের নামে চাঁদাবাজি, পদবাণিজ্য, সেক্টর কল্যাণ সমিতির নির্বাচন না দিয়ে কমিটি ঘোষণা, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রামে ডেকোরেটরের কাজের টাকা না দেওয়া, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ফার্নিচার মার্কেট, স্কুল-কলেজে চাঁদাবাজি, জামায়াত প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ও অর্থায়ন, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে সিভিল এভিয়েশনের কাজ নিয়ন্ত্রণ এবং ১০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার কাজ ভাগবাঁটোয়ারার মাধ্যমে ভোগ করা।’
উত্তরার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশই হাবিব হাসানের অপকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে হাবিব হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘যারা আমার ক্ষতি চায় তারা এগুলো করে বেড়াচ্ছে। এখনো মুখ খোলার সময় হয়নি। সময় হলে সত্য-মিথ্যা সবই জানতে পারবেন।’
নাটোর-২ আসনের বিতর্কিত সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল এবারও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। জেলার জ্যেষ্ঠ নেতাদের লাঞ্ছিত করা, বিদেশে অর্থ পাচারসহ নানা অভিযোগে গত কয়েক বছর আলোচিত ছিলেন শিমুল। গত বছর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায়ও তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও তার ওপরে ক্ষোভ ঝেড়েছেন। দলের সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকেও বাদ পড়েন শিমুল।
শিমুলের বাবা হাসান আলী রাজাকার ছিলেন বলে ‘নাটোর জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধ’ নামক বইয়ে উল্লেখ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সরকার সুজিত কুমার।
চলতি বছর একাধিকবার জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ওপরে হামলার অভিযোগ ওঠে শিমুলের বিরুদ্ধে। এর আগে ২০২১ সালে জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি আব্দুল কুদ্দুসকে শহরছাড়া করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
চট্টগ্রাম-১৫ আসনে আবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী। তার বিরুদ্ধে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অভিযোগের শেষ নেই। একসময়ে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নদভী আওয়ামী লীগে এসে দলের পুরোনো ত্যাগী নেতাদের কোণঠাসা করে ফেলেছেন। নদভীর শ্বশুর মুমিনুল হক চৌধুরী আমৃত্যু জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ছিলেন।
দলের নেতা-কর্মীদের ওপর জুলুম ও নির্যাতনের বহু অভিযোগ নদভীর বিরুদ্ধে। গত ১০ বছরে দলের বহু নেতা-কর্মী তার অনুসারীদের হামলার শিকার হন। এ বছরের মার্চে আওয়ামী লীগের একজন নেতাকে নদভীর থাপ্পড় দেওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওতে তিনি ওই নেতাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলার হুমকিও দেন।
তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অনিয়মেরও অভিযোগ রয়েছে। এবারের নির্বাচনী হলফনামায় দেখা যায়, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান হিসেবে নদভী এ প্রতিষ্ঠান থেকে বছরে মিটিং ও সম্মানীসহ ভাতা পান ১ কোটি ৩৭ লাখ ৬১ হাজার ৪৪২ টাকা। এর বাইরে প্রতিষ্ঠানটি থেকে ঋণ নিয়েছেন ৪৬ লাখ ২৯ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া তার স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরীসহ নদভীর ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিরা প্রতিষ্ঠানটি থেকে বছরে ৪৪ লাখ ২২ হাজার ৪৪৬ টাকা পান।
নদভী জাতীয় সংসদ থেকে বছরে ২৩ লাখ ১৫ হাজার ৭০৭ টাকা পান। অর্থাৎ জাতীয় সংসদ থেকে তিনি যা আয় করেন তারচেয়েও বেশি আয় করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড থেকে। হলফনামায় তিনি নিজেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারী বলে উল্লেখ করেছেন।
টাঙ্গাইল-২ আসনের এমপি তানভীর হাসান ছোট মনির বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ রয়েছে। এবারও তিনি দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তার চরম বিরোধ রয়েছে।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই খুন হন গোপালপুরের হাদিরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম তালুকদার নিক্সন। তিনি সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনিরের নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দা। নিক্সন হত্যা মামলার প্রধান আসামি সুমনের একটি ভিডিও ফাঁস হয়েছে গত ৪ জুন। ভাইরাল হওয়া ২০ মিনিট ২১ সেকেন্ডের এই ভিডিওতে সুমনের বক্তব্য অনুযায়ী খুনের নির্দেশদাতা হিসেবে টাঙ্গাইল-২ আসনের এমপি তানভীর হাসান ছোট মনির নাম আসে।
আসামি সুমন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার পর আদালতের গারদখানায় রেকর্ড করা এক ভাইরাল ভিডিওতে দাবি করেছেন, টাঙ্গাইলের সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির নিক্সন হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী। পাশাপাশি এমপির পিএস মির্জা আসিফ মাসুদসহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য সবার কথাও বলেছেন তিনি। এই সুমন একসময় এমপি ছোট মনির ঘনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন বলে জানা গেছে।
সংসদ সদস্য হওয়ার আগে ১৬ বছর বিদেশে ছিলেন ছোট মনির। অনেকটা হঠাৎ করেই এমপি হয়ে যান তিনি। দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূলের পোড় খাওয়া নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে হাইব্রিডদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের বিরুদ্ধে দলের নেতা-কর্মীদের ওপরে নির্যাতনের বহু অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের ১৯ মে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাব উদ্দীন কলেজের দুই সহকারী অধ্যাপককে পিটিয়ে সারা দেশে আলোচনায় আসেন আনার। শিক্ষক পেটানোর ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনায় জড়ান আনার।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, আনারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, মাদক চোরাচালন, দলের নেতা-কর্মী খুনসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগে একসময় আনারের বিরুদ্ধে ২০টির বেশি মামলা ছিল। তিনি ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড তালিকায়ও ছিলেন।
বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বারবার আলোচনায় আসা রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী এবারও নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। গত ১৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দিনই আচরণবিধি লঙ্ঘন করে আলোচনায় আসেন ওমর ফারুক চৌধুরী। নির্বাচন কমিশন তাকে সতর্ক করে চিঠি দেয়।
চলতি বছর রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে প্রকাশ্যে কিলঘুষি মারার অভিযোগ ওঠে এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। ১৫ মিনিট ধরে পেটানো হয় শিক্ষককে। এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় সারা দেশে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
গত ১০ বছরে তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলায় ওমর ফারুক চৌধুরীর অনুসারীদের হামলার শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।