ঢাকা ২৩ কার্তিক ১৪৩১, শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪

গ্যাসসংকট থেকে মুক্তি নেই মার্চের আগে

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬:০০ এএম
আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:০২ এএম
গ্যাসসংকট থেকে মুক্তি নেই মার্চের আগে
ছবি : খবরের কাগজ

মহেশখালিতে ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) জাহাজ নষ্ট হওয়ায় আমদানি করা লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) পাইপ লাইনে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ফলে দেশে গ্যাসের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সংকট থেকে মুক্তি মার্চের আগে মিলবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্রমতে, মহেশখালী এলএনজি টার্মিনালে দুটি বিশেষায়িত জাহাজ এফএসআরইউ কাজ করে থাকে। এসব জাহাজে আমদানি করা এলএনজি গ্যাসে পরিণত করে পাইপ লাইনে দেওয়া হয়। যা সরাসরি চট্টগ্রামে পৌঁছায়। এই পাইপ লাইন ব্যবহার করে আগে দৈনিক ৮০০ থেকে ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত এলএনজি সরবরাহ করা হতো। এর মধ্য থেকে চট্টগ্রামে প্রয়োজনীয় গ্যাস রেখে বাকি গ্যাস জাতীয় গ্রিডে দেওয়া হয়। কিন্তু একটি এফএসআরইউ সংস্কারের জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানোর পরই চট্টগ্রামে গ্যাসের যোগানে ধস নামে। যার প্রভাব পড়েছে জাতীয় গ্রিডেও। বর্তমানে একটি জাহাজ দিয়ে ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আসছে পাইপ লাইনে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের জন্য ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রেখে বাকি গ্যাস নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা অঞ্চলে। এর ফলে গ্যাসের সরবরাহ চেইন ঠিক রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে। 

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি জানায়, গ্যাসের প্রবাহ কমে যাওয়ায় চট্টগ্রামে গ্যাসের চাপ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এতে হাজার হাজার গ্রাহক ভয়াবহ ভোগান্তিতে পড়েছেন। গ্যাসের যোগান না বাড়লে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। সংস্কারাধীন এফএসআরইউ থেকে এলএনজি সরবরাহ শুরু করা সম্ভব হলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। সিঙ্গাপুরে সংস্কারে থাকা একটি এফএসআরইউ এ সপ্তাহে মহেশখালির এলএনজি টার্মিনালে সংযুক্ত করার কাজ চলছে। এটি সংযুক্ত হয়ে গ্যাস সরবরাহ করা হলে অপর জাহাজটি আবার পাঠানো হবে সিঙ্গাপুরে। ফলে আরও কিছুদিন সরবরাহ চলবে একটি জাহাজ দিয়েই। 

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আবু সাকলায়েন খবরের কাগজকে বলেন, ‘কিছু টেকনিক্যাল কারণে গ্যাসের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তবে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে কিছুটা স্বাভাবিক হবে। সংস্কার শেষে এফএসআরইউ জাহাজ আমদানি করা লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনালে সংযুক্তির কাজ চলায় সরবরাহ কমে গেছে। তাই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।’ 

কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস) প্রকৌশলী মো. শফিউল আজম খান বলেন, ‘চট্টগ্রামে চাহিদার তুলনায় গ্যাস সরবরাহ না থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মূলত এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস না পাওয়ায় সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো এবং আবাসিকে সংকট বেশি দেখা দিয়েছে। তবে বর্তমানে সংস্কার হওয়া একটি জাহাজের সংযুক্তির কাজ চলছে। অপর জাহাজও সংস্কারের জন্য যাবে। সেটি সংস্কার শেষে ফিরলে পুরোপুরি ঠিক হবে গ্যাসের সংকট। যা আগামী মার্চের আগে হয়ত সম্ভব হবে না।’ 

কেজিডিসিএলের সূত্রমতে, চট্টগ্রামে গ্যাসের চাহিদা ৩১২ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে চট্টগ্রামের দুটি সার কারখানায় দেওয়া হচ্ছে ৯০ মিলিয়ন ঘনফুট, বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৩৭ মিলিয়ন ঘনফুট এবং সিএনজি ফিলিং স্টেশনে ১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বাকি গ্যাস আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের দেওয়া হয়। সৃষ্ট সংকটে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। 

কেজিডিসিএল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৃহত্তর চট্টগ্রামে আগে আশুগঞ্জ-বাখরাবাদ গ্যাস পাইপ লাইনের মাধ্যমে সিলেট এবং কুমিল্লা অঞ্চল থেকে যে গ্যাস আসত তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র এলএনজি দিয়েই চট্টগ্রামের শিল্প কারখানা থেকে রান্নাঘরের চুলা পর্যন্ত সবকিছু সামাল দেওয়া হয়। বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি পর্যাপ্ত থাকলেই কেবল চট্টগ্রামে গ্যাসের স্বাভাবিক যোগান থাকে। এলএনজি আমদানি সরবরাহ কমে যাওয়া কিংবা কোনোভাবে বিঘ্নিত হলেই চট্টগ্রামে গ্যাস থাকার সুযোগ নেই।

অযৌক্তিক খরচে সরকারের আপত্তি

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩০ পিএম
আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৫ পিএম
অযৌক্তিক খরচে সরকারের আপত্তি
নরসিংদী জেলা কারাগার

‘নরসিংদী জেলা কারাগার নির্মাণ’ প্রকল্পের নকশা তৈরি করতে খরচ ধরা হয়েছিল ১০ লাখ টাকা, স্টেশনারি খাতে ১০ লাখ ও স্থাপত্য নকশা ছাপানোর জন্য ১০ লাখ টাকা। কিন্তু পাঁচ বছরে এসব খাতে এক পয়সাও খরচ হয়নি। অন্যান্য খাতেও বেশি করে খরচ ধরা হয়েছিল। কিন্তু তেমন খরচ হয়নি। বাধ্য হয়ে প্রকল্পটি সংশোধন করে দুই বছর সময় বাড়ানো হচ্ছে। তাতে মোট খরচ কমানো হলেও কিন্তু আগামী দুই বছরে এসব খাতে বেশি করে খরচ ধরা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনে সম্প্রতি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হলে এসব ধরা পড়ে। সভায় বিভিন্ন খাতে অযৌক্তিক খরচ ধরা হয়েছে বলে আপত্তি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। 

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের গণপূর্ত অধিদপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারা অধিদপ্তর। সার্বিক ব্যাপারে জানতে প্রকল্প পরিচালক ও যুগ্ম সচিব মোকতার আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে গত দুই দিনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু সাড়া না দেওয়ায় তার কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

তবে কারা অধিদপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) মো. জান্নাত-উল ফরহাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৮৩ শতাংশ। মাটি ভরাট, সাবস্টেশন নির্মাণসহ কিছু কাজ বাকি রয়েছে। তাই সংশোধন করা হচ্ছে। সময় বাড়ানো হচ্ছে দুই বছর। এসব কাজে দুই বছর লাগবে?

এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর সরকার পরিবর্তন হলে মাটি ভরাটের কাজ থমকে যায়। প্রশাসনিক ভবনের কাজও ৫০ শতাংশ বাকি রয়েছে। এসব কাজ করতে দুই বছর সময় লাগবে।’

পরিকল্পনা কমিশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নরসিংদী কারাগার প্রথম চালু হয় ১৯৮৩ সালে (মহকুমা কারাগার হিসেবে); যা ১৯৮৮ সালে জেলা কারাগার হিসেবে উন্নীত হয়। আশির দশকে দেশের সব মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে অবকাঠামোর কোনো পরিবর্তন ছাড়াই গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সাব-জেলকে জেলা কারাগার হিসেবে উন্নীত করা হয়। জেলা কারাগার হিসেবে ঘোষণার সময় এখানকার অনুমোদিত ধারণক্ষমতা ছিল মাত্র ২৪৪ জন। নরসিংদীকে জেলায় উন্নীত করার পর জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রতিষ্ঠিত হলে জেলা কারাগারে বন্দির সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে এই কারাগারে গড়ে ৮০০ থেকে এক হাজার জন বন্দি অবস্থান করছেন। ধারণক্ষমতার চার গুণ বেশি বন্দি কারাগারে থাকছেন।

খালি জায়গা না থাকায় বন্দিদের জন্য ব্যারাক নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে কারা অধিদপ্তর রাজস্ব বাজেট থেকে ৬০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা খরচ করে ঢাকা-নরসিংদী মহাসড়কের পাশে ২০ একর বা ৬০ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করে। যেখানে নতুন কারাগার নির্মাণের পরিকল্পনা করে কারা অধিদপ্তর। আটক বন্দিদের বসবাসের সুষ্ঠু পরিবেশ দেওয়ার জন্য এই পরিকল্পনা করা হয়।

তারই অংশ হিসেবে নরসিংদী সদরে ২০১৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সরকার কারাগার নির্মাণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রের দেওয়া তথ্যমতে, এ প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছিল ৩২৭ কোটি টাকা। বাস্তবায়নকাল ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু সে সময়ে কাজের কাজ কিছু হয়নি। পরে খরচ না বাড়িয়ে সময় বাড়ানো হয় দুই বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু তাতেও কাজের অগ্রগতি হয়নি। গত মার্চ পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৬৫ শতাংশ। 

তাই বাকি কাজ শেষ করতে এবার দ্বিতীয়বারের মতো প্রকল্পটি সংশোধন করা হচ্ছে। অনেক খাতে কোনো টাকা খরচ হয়নি। তাই খরচ কমানো হচ্ছে ২৮ কোটি টাকা বা ৮ শতাংশ অর্থাৎ মোট খরচ ধরা হয়েছে ২৯৯ কোটি টাকা। কিন্তু সময় বাড়ানো হচ্ছে দুই বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের জুনে শেষ হবে আধুনিক জেলখানার নির্মাণকাজ। তা যাচাই করতে গত ৮ অক্টোবর পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। 

সরকার পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টার নির্দেশে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক প্রকল্প পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত দেওয়া হয়েছে। তার পরও এ প্রকল্পটিতে অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিক খরচ ধরা হয়েছে। সভায় জানানো হয়, মোটরযান খাতে ৭ লাখ টাকার বেশি খরচ ধরা হয়েছে। কারণ দীর্ঘ পাঁচ বছরে এ খাতে কোনো টাকা খরচ হয়নি।

এ ছাড়া যানবাহনের জ্বালানি খাত ও গ্যাসের জন্য অনেক টাকা রাখা হলেও তা খরচ হয়নি। তার পরও এই দুই খাতে আগামী দুই বছরের জন্য ১২ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। মোটরযান রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ৪৫ লাখ টাকা রাখা হলেও ২৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। প্রকল্পের নকশা প্রস্তুত, স্টেশনারি, স্থাপত্য নকশা প্রস্তুত ও ছাপানো খাতেও ১০ লাখ করে ৩০ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। যেখানে দীর্ঘ সময়ে এসব খাতে কোনো টাকা খরচ হয়নি।

এ ছাড়া ভ্রমণ খাতে ১২ লাখ টাকা, মনোহারী খাতে ২৪ লাখ টাকা রাখা হলেও তেমন খরচ হয়নি। আসবাবপত্র খাতে আগে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা খরচ ধরা হলেও সংশোধনীতে বাড়িয়ে ২ কোটি ৭ লাখ, বনায়ন খাতে ৩০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪০ লাখ, বহিঃবিদ্যুতায়নে ৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। এভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি করে খরচ ধরা হয়েছে। এসব খরচ অযৌক্তিকভাবে ধরা হয়েছে। খরচ যৌক্তিক করার জন্য পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে। এসব সংশোধন করে সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে বাকি কাজ শেষ করে সংশোধনের জন্য একনেক সভায় উপস্থাপন করা হবে বলে সূত্র জানায়।

প্রকল্পের প্রধান যেসব কাজ ধরা হয়েছে, সেগুলো হলো ৩ লাখ ২৪ হাজার ৭৮৯ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়ন, পুরুষ বন্দিদের জন্য দুটি ছয়তলা ভবনের ব্যারাক নির্মাণ, সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য একটি ছয়তলা ভবনের বন্দিশালা নির্মাণ, পুরুষ বন্দিদের জন্য একটি চারতলা ভবনের ব্যারাক, একটি ১০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ, মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত বন্দিদের জন্য একটি দোতলা ভবনের ব্যারাক নির্মাণ। সেই সঙ্গে কারাগারটিতে বিচারাধীন ও সাজাপ্রাপ্ত নারী বন্দিদের জন্য একটি পাঁচতলা ভবন নির্মাণ ও একটি দোতলা ভবনের সেল নির্মাণ। নারী শ্রেণিপ্রাপ্ত ও কিশোরী বন্দিদের জন্য একটি চারতলা ভবন নির্মাণ, স্বজনদের সঙ্গে বন্দিদের দেখা করার জন্য একটি তিনতলা ভবন নির্মাণ করা হবে।

অন্যদিকে কারাগারের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় একটি তিনতলা ভবন, ব্যাচেলর অফিসার্সদের জন্য একটি তিনতলা ভবন, ১ হাজার ২৫০ বর্গফুট, ১ হাজার বর্গফুট ও ৮০০ বর্গফুট আয়তনের একটি করে পাঁচতলা কোয়ার্টার এবং ৬৫০ বর্গফুট আয়তনের ১০ তলার দুটি আবাসিক কোয়ার্টার নির্মাণের ব্যবস্থা থাকবে। বন্দিদের দেখতে আসা দর্শনার্থীদের অপেক্ষা করার ঘর নির্মাণসহ আরও বেশ কিছু কাজ করা হবে। 

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, নতুন এ কারাগারে থাকবে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। যার মাধ্যমে কারাবন্দিদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে বন্দিদের গতিবিধি, কারাগারের ভেতর ও বাইরে পর্যবেক্ষণ করা হবে। এখন যে কারাগার রয়েছে, সেখানে কারারক্ষীদের জন্য তেমন আবাসনব্যবস্থা নেই। নরসিংদী জেলার নতুন এ কারাগারটি হলে বন্দির ধারণক্ষমতা বাড়বে। 

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। পালিয়ে যান এর কয়েদিরা। তার পর থেকেই বেশি আলোচনায় আসে কখন হবে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধার আধুনিক এই কারাগার।

পুলিশের স্বাভাবিক কাজে ধীরগতি

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩০ পিএম
পুলিশের স্বাভাবিক কাজে ধীরগতি
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়া বড় মসজিদের মোড়। ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে প্রতি রাতে ওই মোড়ে পুলিশের একটি টহল গাড়ি এক থেকে দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকত বলে জানালেন এলাকাবাসী। এলাকার নিরাপত্তা ও সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ওই গাড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু ৫ আগস্টের পর মাঝে মাঝে টহল পুলিশের গাড়িটি দেখতে পাওয়া গেলেও এখন আর তারা কাউকে তল্লাশি বা জিজ্ঞাসাবাদ করছেন না।

স্থানীয় দোকানি সবুজসহ ওই এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা খবরের কাগজকে জানান, পুলিশের টহল ও তল্লাশি কমে যাওয়ার কারণে ওই এলাকায় ছিনতাই ও কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত অনেক বেড়েছে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। এলাকার লোকজন একাধিকবার থানায় অভিযোগ দেওয়ার পরেও কোনো সুরাহা মেলেনি। শুধু পাইকপাড়া নয়, ঢাকার অন্যান্য স্থান থেকেও এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, জনরোষের আতঙ্কে পুলিশের টহল কার্যক্রম কমেছে। পুলিশের পিকেট পার্টি, হাঁটা পার্টি ও মোবাইল পার্টির কার্যক্রম সীমিত হয়ে গেছে। এতে বাড়ছে অপরাধ। এ ছাড়াও থমকে গেছে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম। এতে অপরাধীদের প্রকৃত তথ্য পাচ্ছে না পুলিশ। পাশাপাশি পুলিশে নানামুখী অস্থিরতা বিরাজ করছে। চিড় ধরেছে মনোবলে। সরকার পতনের পর পুলিশের হারানো মনোবল ফেরাতে চোখে পড়ার মতো কার্যকর কোনো উদ্যোগও নেই। বিশেষ করে যারা নতুন পুলিশে যোগদান করেছেন তাদের মধ্যে মনোবল ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে। 

আন্দোলন পরবর্তী পুলিশের চেইন অব কমান্ড শক্তিশালী করা ও পুলিশের মাঠপর্যায়ে অপারেশনে গতি আনার ক্ষেত্রেও এক ধরনের ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে। পুলিশের হারানো মনোবল ফিরিয়ে আনতে কার্যকর উদ্যোগ নেই। 

সূত্র জানায়, ছাত্র জনতার আন্দোলনের পর পুলিশের অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ মেলাচ্ছে। কোনো কোনো কর্মকর্তা পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন। কেউ কেউ আবার খোলস পাল্টে সুবিধা আদায়ের চেষ্টাও করছেন। আবার কেউ কেউ নড়াচড়া না করে চুপচাপ দিন পার করছেন। 

এ বিষয়ে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম খবরের কাগজকে জানান, ‘আন্দোলন পরবর্তী সময়ে পুলিশের সমস্যাগুলো আমরা দূর করার চেষ্টা করছি।’

পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে নানা কারণে পুলিশের কর্মকাণ্ড কমে গেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশ কর্মকর্তারা সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন গুলি চালাতে। আর তা বাস্তবায়ন করেছেন মাঠপর্যায়ের দায়িত্ব পালন করা পুলিশ সদস্যরা। আবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য নিহত হয়েছেন। 

অবশ্য আন্দোলন পরবর্তী সময়েও বিভিন্ন স্থানে অভিযানে গেছেন পুলিশের সদস্যরা। তখন ওই এলাকার লোকজন একজোট হয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। এতে পুলিশ মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করতে ভয় পাচ্ছে। কেউ এখন আর বড় টিম ছাড়া আসামি ধরতে যাচ্ছেন না। অন্যদিকে বিগত সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন স্থানে দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা পুলিশ কর্মকর্তারা রয়েছেন বদলি আতঙ্কে। তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে বদলি হয়েছেন, আবার কেউ কেউ বদলির অপেক্ষায় রয়েছেন। এ জন্য মাঠপর্যায়ে যে শক্তিশালী পুলিশের অপারেশন কার্যক্রম থাকার কথা সেটি এখন আর নেই। এতে পুলিশের কাজে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। 

সূত্র জানায়, অতীতে জেলা ও বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক অপরাধীকে ধরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কমিউনিটি পুলিশ ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কমিউনিটি পুলিশের কমিটি ছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর ওই সব কমিটি আর তেমন কার্যকর নেই। অনেক জনপ্রতিনিধি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কারও কারও নামে রয়েছে মামলা। এতে পুলিশের প্রথাগত সোর্স ব্যবহার করে অপরাধীদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেওয়ায় পুলিশের তৎপরতা কমেছে। 

সূত্র জানায়, এসব কারণে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের মনোবলে চিড় ধরেছে। অনেকেই গাড়ি নিয়ে উল্টো পথ দিয়ে চলে যাচ্ছেন। আগে কেউ সিগন্যাল অমান্য করলে ট্রাফিক পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা নিলেও এখন তারা ঢিলেঢালা ডিউটি করছেন। 

জানা গেছে, ঢাকাসহ সারা দেশে ১৭০ জন পুলিশ এখনো পলাতক রয়েছেন। ইতোমধ্যে পুলিশের ৯ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন। ১৭ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া সরকার পতনের পর ডিএমপিতে ১৩ জন কর্মকর্তা কাজে যোগ দেননি। চাকরিচ্যুত ও বাধ্যতামূলকভাবে অবসরে পাঠানো কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অত্যন্ত প্রভাবশালী বলে পরিচিত ছিলেন। বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে এখনো কেউ প্রভাবশালী বা দাপুটে হয়ে ওঠেনি। ফলে মাঠপর্যায়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। 

সূত্র জানায়, যেসব পুলিশ কর্মকর্তা পলাতক বা আত্মগোপনে আছেন তাদের গ্রেপ্তার করতে উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় আছেন। কারও কারও কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। পলাতক কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদায়ন পেয়ে বিরোধী দলের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে পুলিশ। 

এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে জানান, পুলিশে মনোবল ফেরাতে নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। পরিকল্পনা মতো পুলিশের রুটিন কাজ করতে হবে। বদলি ও পদোন্নতি যোগ্যতার ভিত্তিতে হতে হবে। তাহলে পুলিশ তার মতো করে পারফরম্যান্স করতে পারবে।

মায়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল দুই উপজেলা

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৮ এএম
আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৯ এএম
মায়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল দুই উপজেলা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও চাঁদপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার নির্বাচনি এলাকায় সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করত নির্দিষ্ট দুটি বাহিনী। একটি বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করত মতলব উত্তর উপজেলা এবং আরেক বাহিনীর হাতে ছিল মতলব দক্ষিণ। সরকারি উন্নয়নমূলক কাজের কমিশন, মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলন, মাদক ব্যবসা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়ার কাজগুলো তাদের মাধ্যমে হয়ে আসছিল।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মায়া চৌধুরীসহ তার বাহিনীর লোকজন এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। তবে মতলব উত্তর উপজেলায় মেঘনা থেকে বালু উত্তোলন এখনো বন্ধ হচ্ছে না।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মায়ার দুটি বাহিনী আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে। মতলব উত্তর উপজেলার বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কুত্তা মামুন, রিয়াদ, রিয়াজুল ইসলাম, শরীফ ও ইউপি চেয়ারম্যান ছোবহান সরকার শুভা। দক্ষিণে বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন মেয়র আওলাদ হোসেন লিটন, উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শওকত আলী বাদল এবং জেলা পরিষদ সদস্য ও ছাত্রলীগ নেতা আল-আমিন ফরাজি।

সরকারি উন্নয়নমূলক কাজের কমিশন-বাণিজ্য
মতলব উত্তর সেচ প্রকল্পের আওতাধীন বেড়িবাঁধ নিয়ন্ত্রণে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্লক নির্মাণকাজ থেকে মায়া চৌধুরী নিয়েছেন ১০ শতাংশ কমিশন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এই কমিশন-বাণিজ্য শুরু করেন বলে অভিযোগ আছে। স্থানীয় ঠিকাদার আলাউদ্দিন সরকার, বাতেন চেয়ারম্যান এবং লধুয়া গ্রামের রিপন পাটওয়ারী যৌথভাবে এই কাজের ঠিকাদার ছিলেন। তাদের কাজ আটকে দিয়ে তিনি এই টাকা নিয়ে নেন।

স্থানীয় সরকারের অধীন দুই উপজেলার সরকারি গ্রামীণ উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্পের প্রায় ৭০০ কোটি টাকার কাজ চলমান ছিল। সেখান থেকে কাজের ধরন হিসেবে মায়া চৌধুরী নিয়েছেন ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত তিনি এই কমিশন আদায় করেন।

মতলব উত্তরে নির্মাণাধীন হাইটেক পার্কের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে মায়া চৌধুরী ৩ কোটি টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এটির নির্মাণকাজ এখনো চলমান। তবে এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল প্রকৌশলীসহ কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ৫ আগস্টের পর এই প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী নামফলক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন ভেঙে ফেলেছেন।

ঠিকাদার আলাউদ্দিন সরকার জানান, তিনি ব্লকের কাজ করেছেন সংস্কারমূলক। তার কাজ ছিল ছোট। তাকে এমপির লোকজন তেমন বিরক্ত করেননি। তবে মতলব দক্ষিণের আওয়ামী লীগ সভাপতি এইচ এম কবিরের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়েছেন। এইচ এম কবির বলেন, ‘আমি সরাসরি কাজ করিনি। আমার ছোট ভাইসহ কয়েকজন ব্লকের কাজের ঠিকাদার।’ এমপির লোকজন কমিশন নিয়েছেন সরাসরি স্বীকার না করলেও তিনি বলেন, কাজ করলে লাভ-লোকসান হবেই।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কমিশন-বাণিজ্য
২০১৪ থেকে ২০১৮ সালে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন এবং সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রত্যেক চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই কাজে যুক্ত ছিলেন তার ছেলে দীপু চৌধুরী। ২০১৪ সালের ইউপি নির্বাচনে প্রত্যেক চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে মনোনয়ন দেওয়া বাবদ নিয়েছেন ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা। উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের কাছ থেকে নিয়েছেন ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মনোনয়নবঞ্চিত একাধিক প্রার্থী বলেন, মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়া এবং নির্বাচনে বিজয়ী করার চুক্তিতে এই টাকা নিতেন।

মতলব উত্তরের মোহনপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান প্রার্থী হাফিজ মাস্টারের কাছ থেকে তিনি নিয়েছেন ২ কোটি টাকা। সাংবাদিক পরিচয়ে এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি ওই ইউনিয়নে উপনির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হওয়ার জন্য চেষ্টা করেছেন বলে জানান। তবে তিনি যে ২ কোটি টাকা দিয়েছেন সে ব্যাপারে সত্যতা জানতে চাইলে বলেন, ‘আপনি আমার সামনে আসেন তখন বলব।’ এই বলে ফোন কেটে দেন।

এ ছাড়া সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে মতলব উত্তর উপজেলার গজরার ইউনিয়নের মফিজুল ইসলাম, বাগান বাড়ির নান্টু মিয়া, সাদুল্যাপুরের লোকমান মুন্সী, কলাকান্দার ছোবহান সরকার শোভা, ফতেপুর পূর্ব ইউনিয়নের আজমল চৌধুরী, ফতেপুর পশ্চিম ইউনিয়নের দেলোয়ার সরকারসহ অনেকের কাছ থেকে মায়া চৌধুরী নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা।

মতলব দক্ষিণ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এইচ এম কবির বলেন, ‘সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মায়া চৌধুরী আমাকে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে সমর্থন করেননি। বরং উল্টো তার লোকজন দিয়ে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছেন। এ বিষয়ে ওই সময় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। আমি যাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি সেই সিরাজুল মোস্তফা তালুকদারকে তিনি মনোনয়ন দিয়েছেন।’

একই উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী রিপন মির বলেন, ‘আমি কখনো টাকা দিয়ে নৌকার মনোনয়ন পাইনি। দল থেকেই আমাকে দিয়েছে। তবে আমাদের ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরসহ কয়েকজন টাকা দিয়ে নৌকার প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করেছেন।’

মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ
২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মায়া চৌধুরী ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী। ওই সময় তার ছেলে দীপু চৌধুরী, স্ত্রীসহ পরিবারের একাধিক সদস্যের নামে ড্রেজার দিয়ে মেঘনা থেকে বালু উত্তোলন হয়েছে। প্রতিদিন বালু তোলা হতো ২০ লাখ ঘনফুট। এলাকাভিত্তিক এই কাজ করতেন তার আত্মীয় আহার খালাসি, বোরহান খালাসি ও ইউপি চেয়ারম্যান ছোবহান সরকার শুভা। আর স্থানীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন মোহনপুর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান বালু মিজান, সাবেক মেয়র রফিকুল ইসলাম জজ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর মাস্টার।

চলতি বছরের ৫ জানুয়ারির পর আবারও বালু উত্তোলনের কাজটি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা অব্যাহত ছিল। কারণ ২০১৮ সালে এই আসনের সংসদ সদস্য পদ হারান মায়া চৌধুরী। এই আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন রুহুল।

এ বিষয়ে মতলব উত্তর উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা বিল্লাল মৃধা বলেন, মায়া চৌধুরী যতবারই এমপি এবং মন্ত্রী হয়েছেন, তিনি অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে জড়িত ছিলেন। তার প্রভাবের কারণে কেউ মুখ খুলতে পারেনি। আর বালু উত্তোলনকাজের মূল হোতা ছিলেন আহাদ খালাসি, বোরহান খালাসি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর ও পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম।

তিনি আরও বলেন, ‘মায়া চৌধুরী প্রতিহিংসার রাজনীতি করেছেন। তার মতের বিরুদ্ধে কিংবা কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করা যায়নি। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন, মামলা ও হামলা করেছেন। মামলা দিয়ে শত শত লোককে এলাকা ছাড়া করেছেন। তার লোকজন বহু মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করেছেন। তার অত্যাচারের কারণে পাঁচ মাস বিভিন্ন জায়গায় থেকে ৫ আগস্টের পর বাড়িতে এসেছি।’

উন্নয়নমূলক কাজ ও বদলি-বাণিজ্য
বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন ব্যক্তিগত সহকারী বেলাল ও মতলব উত্তর উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর এবং মেয়র রফিকুল ইসলাম জজ। তারা সারা দেশে ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে নির্মাণ করা ব্রিজের কমিশন উত্তোলন করতেন। প্রত্যেক ব্রিজ থেকে নেওয়া হতো ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন। আর সারা দেশে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বদলি-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন বেলাল। এই কাজে যুক্ত ছিলেন মায়া চৌধুরীর প্রয়াত ছেলে দীপু চৌধুরী।

ক্ষোভ প্রকাশ করে মায়া চৌধুরীর নির্বাচনি এলাকার একাধিক সাবেক জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘তিনি আমাদের দুই উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের মধ্যে বিভাজন করেছেন। অনেকের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে দমন করেছেন। হুমকি-ধমকি দিয়ে সাংগঠনিক কাজগুলো থামিয়ে দিয়েছেন।

মায়া চৌধুরীর নিজ ইউনিয়ন মোহনপুর। ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন তার চাচাতো ভাই বাবুল চৌধুরী। তিনি মারা যাওয়ার পর ২০২৩ সালে উপনির্বাচন হয়। সেখানে নৌকা প্রতীক পান কাজী মিজানুর রহমান। তিনি মায়া চৌধুরীর মতের বিরুদ্ধের লোক হওয়ায় তার নৌকা বাদ করে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাইকে নৌকা এনে দেন। এরপর শুরু হয় কাজী মিজানের বিরুদ্ধে অত্যাচার, হামলা ও মামলা।

কাজী মিজান বলেন, ‘মায়া চৌধুরী তার লোক দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা হত্যা মামলা দিয়েছেন। এলাকায় লুটপাট করেছেন। বেশ কয়েকটি মামলা দিয়ে লোকজনকে বাড়ি ছাড়া করেছেন। আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মোহনপুর পর্যটনকেন্দ্র ভেঙে সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে গেছে তার লোকজন। আমার ২০ কোটি টাকার ক্ষতি করেছে। এ বিষয়গুলো প্রশাসন, পুলিশ ও চাঁদপুরবাসী জানে। এসব ঘটনায় আমি তার লোকজনের বিরুদ্ধে আদালতে দুটি মামলা দিয়েছি। মামলাগুলো চলমান।’

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মায়া চৌধুরীর মোহনপুর ছাড়াও কানাডা, আমেরিকা ও সিঙ্গাপুরে বাড়ি আছে। তিনি গত ৩ আগস্ট ঢাকা থেকে বাড়িতে আসেন। একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ওই দিন রাতে আর ঢাকায় ফেরেননি। পরদিন ৪ আগস্টও বাড়িতে ছিলেন। সারা দেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ঢাকায় যাননি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হন। কিন্তু উপজেলা থেকে বের হতে পারেননি। পরে নিজের গাড়ি ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়ে অন্য গাড়ি করে কুমিল্লা হয়ে ভারতে চলে যান।

চাঁদপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মতলব উত্তর উপজেলার বাসিন্দা তানভীর হুদা বলেন, ‘বিগত ১৫ বছর চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর-মতলব দক্ষিণ) নির্বাচনি এলাকায় বিএনপি নেতা-কর্মীরা বহু মামলা ও হামলার শিকার হয়েছেন। মামলা দিয়ে নেতা-কর্মীদের বাড়ি ছাড়া করা হয়েছে। মায়া চৌধুরীর লোকজন আমার ব্যক্তিগত গাড়ি ভাঙচুর করেছে একাধিকবার। আমি নিজেই বারবার তাদের হামলার শিকার হয়েছি।’

এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়ায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। আর দুই উপজেলায় তার বাহিনীর লোকজন সরকার পতনের পর আত্মগোপনে আছেন।

শাস্তি বহাল রেখেই সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধনের প্রস্তাব

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৯ এএম
আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২০ পিএম
শাস্তি বহাল রেখেই সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধনের প্রস্তাব
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়

মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের শাস্তি বহাল রেখেই সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো এবং কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার সিস্টেমে বে-আইনি প্রবেশের বিধানসহ ১০টি ধারা বাতিল করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সংশোধনের পরও ওই ধারায় দায়ের করা মামলার বিচার চলবে বলে সুপারিশ করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার আইনের সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে। 

বিগত সরকারের সময়ে আইনটি প্রণয়ন করা হয়। তারপর থেকেই এটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তি, পাল্টাযুক্তি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন মহলে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই এই আইনটি বাতিল করার ঘোষণা দেয়। তবে, বিভিন্ন মহলের সঙ্গে পরামর্শ করার পর সাইবার সিকিউরিটি আইন-২০২৩ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। 

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার মনে করে বিতর্কিত ধারাগুলো বাতিল বা রহিত করলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার পাশাপাশি এই আইনের অপপ্রয়োগ ও হয়রানি থেকে রক্ষা পাবে গণমাধ্যমসহ সর্বস্তরের মানুষ। 

গণমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সরকার গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করতেই আইনটি করে। এ আইনে গণমাধ্যমের অনেক কর্মীকে হয়রানি করা হয়েছে। আইনটির অপপ্রয়োগের মাধ্যমে তথ্যের নিরাপত্তার জন্য ব্যবহৃত না হয়ে মূলত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন মত প্রকাশ এবং সর্বোপরি মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। 

তথ্য মন্ত্রলয়ের পাঠানো সংশোধনী প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেহেতু সংসদ কার্যকর নেই এবং রাষ্ট্রপতির কাছে সন্তোষজনভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান আছে। এই আইনের কিছু ধারা রহিত করার জন্য পরিস্থিতি অনুকূল রয়েছে। তাই অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যেসব ধারার প্রতি সাধারণের বিরূপ মনোভাব রয়েছে, সেসব ধারা বাতিল করা সম্ভব। অন্তর্বর্তী সরকারের এমন মনোভাবের কারণেই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের জন্য আইনের এই খসড়া উপস্থাপন করছে তথ্য মন্ত্রণালয়। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের পর সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি এই অধ্যাদেশ জারি করবেন। প্রস্তাবিত খসড়া অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পর ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ-২০২৪ নামে অভিহিত হবে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৩৯ নং সাইবার নিরাপত্তা আইন অতপর এই আইন (‘সাইবার নিরাপত্তা আইন (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪) বলিয়া উল্লিখিত ও এতদ্বারা রহিত করা হলো। 

তবে প্রস্তাবিত আইনের সংশোধনীতে দুইটি দফা যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, (ক) উক্ত আইন রহিত করা সত্ত্বেও- রহিতকরণের পূর্বে, সরকার মামলা প্রত্যাহার না করলে, মূল আইনের ১৭, ১৮, ১৯, ২০,২২, ২৩, ২৭, ৩০, ৩২ এবং ৩৫ এর অধীন অনিষ্পন্ন মামলাগুলো সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে বিচার, আদেশ, রায় বা শাস্তির বিরুদ্ধে এমনভাবে মামলা পরিচালনা ও নিষ্পত্তি হবে, যাতে মনে হবে আইনটি রহিত হয় নাই।

দফা (খ)-এ বলা হয়েছে, দফা (ক) এ উল্লিখিত ধারাগুলোর অধীন যেসব মামলার তদন্ত প্রতিবেদন বা অভিযোগ করা হয়েছে বা তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে বা মামলা তদন্তাধীন আছে, সেই সব মামলা সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা বলে গণ্য হবে।

পদ্মা সেতু রেল প্রকল্প ঢাকা-খুলনার যাত্রা হবে ৪ ঘণ্টায়

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১২ এএম
আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৮ এএম
ঢাকা-খুলনার যাত্রা হবে ৪ ঘণ্টায়
পদ্মা রেল সেতু

পদ্মা রেল সেতু প্রকল্প পূর্ণাঙ্গরূপে চালু হতে যাচ্ছে চলতি নভেম্বরে। নতুন রেলপথ চালু হলে পদ্মা সেতু হয়ে ট্রেনগুলোকে ফরিদপুর-কুষ্টিয়া-দর্শনা দিয়ে খুলনা যেতে হবে না, ভাঙ্গা-মধুমতী সেতু-যশোর হয়ে খুলনা যাবে। 

ঢাকা থেকে ফরিদপুর-কুষ্টিয়া হয়ে বর্তমানে খুলনার দূরত্ব ৪১২ কিলোমিটার, পৌঁছতে সময় লাগে ১০ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু রেল প্রকল্প চালু হলে এই দূরত্ব ১৭৫ কিলোমিটার কমে গিয়ে হবে ২৩৭ কিলোমিটার। সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা। অন্যদিকে ঢাকা থেকে যশোর হয়ে বেনাপোল পর্যন্ত  বর্তমান দূরত্ব ৩৫৬ কিলোমিটার, পৌঁছতে সময় লাগে ৮ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু দিয়ে ১৭২ কিলোমিটার নতুন রেলপথের কারণে ১৮৪ কিলোমিটার কবে যাবে। সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘণ্টা।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. আফজাল হোসেন গতকাল বুধবার খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা আগামী ২০ নভেম্বরের মধ্যে একটা তারিখ নির্ধারণ করে ফেলছি। পদ্মা রেল সেতু প্রকল্প পুরোদমে চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এ মাসে। স্টেশনে এখন সিগন্যাল সিস্টেমের কাজ চলছে। এ সপ্তাহের মধ্যেই সেটি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। নতুন রেলপথ এ মাসেই উদ্বোধন হবে।’

নতুন রুট চালু হওয়ার পর যশোরের পদ্মবিলা রেল জংশন দিয়ে ট্রেন চলাচলের পরিকল্পনা রয়েছে রেলওয়ের। তবে বাঘারপাড়া উপজেলার এই স্টেশনটি যশোর মূল শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে। এ কারণে পদ্মবিলা জংশনের পরিবর্তে যশোর জংশন হয়ে ট্রেন চলাচলের দাবি জানিয়েছে বৃহত্তর যশোর রেল যোগাযোগ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি।

মো. আফজাল হোসেন বলেন, যেসব ট্রেন বেনাপোল যাবে সেগুলো তো যশোর স্টেশন হয়েই চলাচল করবে। যাত্রীরা বঞ্চিত হবেন না। আর যে ট্রেনগুলো খুলনা যাবে সেগুলো পদ্মবিলা জংশন ঘুরে যাবে। এর কারণ খুলনার ট্রেনগুলো যশোর স্টেশন গেলে ইঞ্জিন ঘুরিয়ে খুলনা যেতে হবে। এতে ৪০ মিনিট থেকে কখনো কখনো এক ঘণ্টা সময় বেশি সময় লাগবে। এতে যাত্রাপথে সময় বাড়বে। সেদিক বিবেচনায় পদ্মবিলা হয়েই খুলনার ট্রেনগুলো চলাচল করবে। এ ছাড়া এখন যশোর থেকে খুলনার দিকে নতুন রেলপথ নির্মাণ করতে গেলে অনেক মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙতে হতো, জমি ক্ষতিগ্রস্ত হতো। 

২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর উদ্বোধন হয় পদ্মা রেলসেতু প্রকল্পের। তখন ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটারের রেলপথ চালু করা হয়। এখন ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত রেলপথ চালু হওয়ায় ঢাকা থেকে যশোরের ১৬৯ কিলোমিটারের রেলপথে সরাসরি যোগাযোগ চালু হতে যাচ্ছে। নতুন রেলপথে ভাঙ্গা থেকে যশোরের দূরত্ব ৯৫ কিলোমিটার, যশোর থেকে খুলনার দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার।

২০১৬ সালের ৩ মে একনেক সভায় পদ্মা সেতুর ওপর রেললাইন স্থাপনে ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকায় এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তখন এ প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পটির জন্য প্রস্তাবিত ৩১৩ কোটি ডলারের চীনা ঋণের চূড়ান্ত চুক্তি করতে বিলম্ব হওয়ায় সময়মতো কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। চীন প্রকল্পে সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার কথা জানায়। ২০১৮ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) চীনের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ২৬৭ কোটি ডলার ঋণচুক্তি করে।

২০১৮ সালের ২২ মে একনেক সভায় প্রকল্পটির ব্যয় ৪ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা বাড়িয়ে প্রায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা করা হয়। মূলত জমি অধিগ্রহণে জমির দাম তিন গুণ হয়ে যাওয়ায় ব্যয় বেড়ে যায়। আর মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এরপর করোনাভাইরাস মহামারিতে কাজের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হলে দুই বছর মেয়াদ বাড়িয়ে এই সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ২০২৪ সাল পর্যন্ত।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে পদ্মা সেতু দিয়ে মাত্র চারটি ট্রেন চলছে। পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে তিন আন্তনগর ট্রেন—খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস, বেনাপোলগামী বেনাপোল এক্সপ্রেস ও রাজশাহীগামী মধুমতী এক্সপ্রেস চলছে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে খুলনাগামী কমিউটার ট্রেন নকশিকাঁথা এক্সপ্রেসও পদ্মা সেতু দিয়ে চলে। বর্তমানে ঢাকা থেকে ট্রেন পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুর-কুষ্টিয়া-দর্শনা হয়ে খুলনায় যায়। এখন রেলওয়ে বলছে, এসব ট্রেন পরিচালনায় আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে না রেলওয়ে। তাই পদ্মা সেতু দিয়ে চার রুটে চলতি বছরেই নতুন আট জোড়া ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই চার রুট হচ্ছে ঢাকা-যশোর-খুলনা, ঢাকা-যশোর-বেনাপোল, ঢাকা-ভাঙ্গা-গোপালগঞ্জ এবং ঢাকা-ফরিদপুর-দর্শনা। 

নতুন রেলপথের সময় কমে যাওয়ায় খুলনা-ঢাকা রুটে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি (এক জোড়া) একটা রেক দিয়ে সুন্দরবন প্রভাতী ও গোধূলি নামে চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে রেলওয়ের। ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে চলাচলকারী চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেনটিও এক রেক দিয়েই চিত্রা এক্সপ্রেস প্রভাতী ও গোধূলি নামে চলতে পারে। পদ্মা সেতু হয়ে চলাচলকারী ঢাকা-বেনাপোল রুটের বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটিও এক জোড়ার পরিবর্তে দুই জোড়া পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও চিত্রা এক্সপ্রেসের রুট পরিবর্তন করা হলে ঢাকা থেকে ফরিদপুর-কুষ্টিয়া-দর্শনা রুটে কোনো ট্রেন থাকছে না। তাই এ রুটে নতুন একটি রেক দিয়ে দুই জোড়া ট্রেন চালানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে রেলওয়ে। এ ছাড়া ঢাকা-কলকাতা রুটের আন্তর্জাতিক ট্রেন মৈত্রী এক্সপ্রেসও রুট পরিবর্তন করে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় চলাচল করবে। 

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী গতকাল বিকেলে বলেন, ‘নভেম্বরের মধ্যেই পদ্মা রেলসেতু সংযোগ প্রকল্প পুরোদমে চালু হচ্ছে। এতে ঢাকা-খুলনা পথের দূরত্ব কমে যাচ্ছে। এতে শুধু যাত্রীরা লাভবান হবেন তা নয়, রেলওয়ে লাভবান হবে। যাত্রার সময় কমে গেলে এ রেলপথের ট্রেনগুলো আমরা দুবার করেও পরিচালনা করতে পারব দিনে। এ বিষয়টি পরিকল্পনায় রয়েছে।’ 

নতুন রেলপথ চালু হলে ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহের যাত্রীদের রেলসেবা বিঘ্নিত হবে। এ বিষয়ে রেলওয়ের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, এখন রেলওয়ের ইঞ্জিন, রেক, বগির সংকট রয়েছে। ফরিদপুর-দর্শনা রুটে এখন কোনো নতুন ট্রেন দেওয়ার পরিকল্পনা রেলওয়ের নেই।