গত ছয় মাসে বন্দর থেকে আমদানি নিষিদ্ধ মদ, মাদক ও যৌন উত্তেজক সামগ্রীর ১৯টি চালান আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এসব চালান শিল্পের কাঁচামাল, জরুরি ওষুধ এবং চিকিৎসা সামগ্রীর নামে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদন থেকে এসব জানা যায়।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা যায়, এসব চালানে প্রায় ৬১২ কোটি টাকার রাজস্ব জড়িত ছিল। এসব চালানের বেশির ভাগ এক সময় চালু থাকলেও এখন বন্ধ রয়েছে অথবা কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে অস্তিত্ব নেই এমন সব প্রতিষ্ঠানের নামে আমদানি করা হয়েছে। এ ছাড়া, দেশের নামিদামি হাসপাতাল, ওষুধ কোম্পানি, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামেও আনা হয়েছে। অথচ মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির বিষয়ে এসব প্রতিষ্ঠান কিছুই জানে না।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি নিষিদ্ধ মদ, মাদক ও যৌন উত্তেজক আমদানিতে দেশের মধ্যে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত। এসব ব্যক্তি বিদেশি একাধিক সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশে মাদকের এ কারবার চালাচ্ছেন। আমদানি করা মদ, মাদক ও যৌন উত্তেজকের চালান ধরা পড়লেও আমদানিকারকদের সন্ধান মেলেনি। সারা দেশের কিশোর-কিশোরীদের টার্গেট করে এসব আমদানি নিষিদ্ধ মদ, মাদক ও যৌন উত্তেজক সামগ্রী আমদানি করা হয়েছে। চালান আটকের পর কেউ তা ছাড় করাতে আসেননি।
দলের নেতারা আড়ালে থেকে মদ, মাদক, যৌন উত্তেজক সামগ্রীর কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। আমদানিকারক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সারা দেশে বিক্রি করা হচ্ছে। আমদানি নিষিদ্ধ মদ, মাদক ও যৌন উত্তেজক সামগ্রী বহনকারীরা এককালীন আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন।
কিছু ব্যক্তি এসব পণ্য বন্দর থেকে ছাড় করিয়ে বন্দরের বাইরে এনে অন্যদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। বন্দরের বাইরে পণ্য হাতে পেয়ে দেশের মধ্যে নির্দিষ্ট ঠিকানায় নিয়ে গিয়ে অন্য কাউকে দিয়েছেন। এক্ষেত্রেও পরিবহনের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক লেনদেন হয়েছে। নির্দিষ্ট ঠিকানা থেকে অন্য কেউ সারা দেশে বিভিন্ন ঠিকানায় বিক্রির জন্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছে। এসব ব্যক্তিদের কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। এসব কাজে একই ব্যক্তিকে বারবার ব্যবহার করা হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নতুন ব্যক্তি নেওয়া হয়। এদের কেউই দলের মূল নেতাকে চেনেন না বা তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হয় না। আবার অনেকে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেননি। কাজের বিনিময়ে এসব ব্যক্তির সাধারণ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ দেওয়া হয়
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, এসব কারবারি দেশি-বিদেশি এজেন্ট দিয়েও বিদেশ থেকে মদ, মাদক ও যৌন উত্তেজক সামগ্রী আনছেন। এসব ব্যক্তি সাধারণ যাত্রী হয়ে আসেন। তাদের সঙ্গে ব্যাগেজে কৌশলে গোপনে এসব পণ্য রাখেন। পরে বন্দরের বাইরে নিয়ে গিয়ে অন্য কারও কাছে দিয়ে দেন। এ কাজে তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন।
আমদানি করা মদ, মাদক, যৌন উত্তেজক সামগ্রী রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে নামিদামি এলাকাতে বাসা ভাড়া করে রাখা হয়। এখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, কোচিং সেন্টারের আশপাশের অনেক ফাস্টফুডের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ, স্টেশনারি বিক্রির দোকানসহ অন্যান্য দোকানে পৌঁছে দেওয়া হয়। এসব দোকানপাট, হোটেল রেস্তোরাঁতে গোপনে নিষিদ্ধ এসব পণ্য বিক্রি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের মালিক নিষিদ্ধ এসব কারবারের বিষয় জানেনই না। অনেক ক্ষেত্রে বিক্রয়কর্মীরা জড়িত থাকেন। অনেকে আবার ব্যাগে করে নিয়ে এসে বিক্রি করেও চলে যান।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নির্বাচন সামনে রেখে দেশের মধ্যে সরকারকে বিতর্কিত করতেও অনেক অসাধু ব্যক্তি এসব নিষিদ্ধ পণ্য এনেছেন। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দেশের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এই সুযোগে সারা দেশে এসব নিষিদ্ধ পণ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু মিথ্যা ঘোষণায় আনা হয়েছে তা নয়, ব্যক্তি বিশেষকে বিশেষ সুবিধা দিয়েও ব্যাগেজে খুব কৌশলে গোপনে মাদক আনা হয়েছে। অন্যদিকে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই পুরোপুরি প্রস্তুতি না নিতেও অনেক নিষিদ্ধ এসব পণ্য এনেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমদানি নিষিদ্ধ মদ, মাদক ও যৌন উত্তেজকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণে এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। এনবিআর চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ সামনে রেখে বিভিন্ন বন্দরে নজরদারি বাড়াতে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। বিশেষভাবে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে কোনো কার্টনে বা প্যাকেটে মিথ্যা ঘোষণায় মদ, মাদক ও যৌন উত্তেজক আনছে এমন সন্দেহ হলে জব্দ করে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। শুধু তাই না, কোনো যাত্রীর ব্যাগেজে আমদানি নিষিদ্ধ এসব পণ্য আছে কিনা তাও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে বলা হয়েছে। যাত্রী যত প্রভাবশালীই হোক না তাকে তল্লাশি করতে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্কুল-কলেজ, কোচিং বা বাসা-বাড়ির কাছাকাছি একই রেস্তোরাঁয় কিশোর-কিশোরী একা, বন্ধু-বান্ধবী বা পরিচিতজনদের নিয়ে ফাস্ট ফুড বা মজাদার দামি খাবার খেতে এলে মূলত সংশ্লিষ্ট রেস্তোরাঁ থেকে ওই কিশোর-কিশোরীদের টার্গেট করা হয়। এক্ষেত্রে রেস্তোরাঁয় খাবার সরবরাহকারীরা এসব পণ্য কৌশলে বিক্রি করে থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিশোর-কিশোরীরা এসবের ভয়াবহতা সম্পর্কে না জেনেই কিনে থাকে। একবার দুইবার খেলে বা ব্যবহার করলে আকর্ষণ তৈরি হয়। পরে আসক্ত হয়ে পড়লে কিশোর-কিশোরীরা জেনে-শুনে উচ্চ মূল্যে কিনে সেবন করে থাকে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এখনো আমদানি করা সব কার্টনের মধ্যে কি আছে তা দেখে ছাড় করা সম্ভব হয় না। এর মূল কারণ এনবিআরের লোকবলের সংকট। বিকল্প হিসেবে প্রযুক্তির সাহায্যে কার্টনের মধ্যে কী আছে তা নিশ্চত হওয়া সম্ভব। কিন্তু এখনো এনবিআর সেই সক্ষমতা অর্জন করেনি। এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে। তাহলে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি অনেক কমে যাবে।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিটউ অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর খবরের কাগজকে বলেন, ‘এনবিআরের সক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে এখনো সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি যে মিথ্যা ঘোষণায় আনা সব পণ্য আটকানো সম্ভব হবে। এ বিষয়ে এনবিআরকে আরও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফখরুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘শুল্ক গোয়েন্দারা জনগণের জন্য ক্ষতিকর পণ্য আমদানি ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে আছে। আমরা সব বন্দরে তৎপরতা বাড়িয়েছি।’