পানি আছে। নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-জলাশয়ও আছে। পাইপলাইনে সরবরাহকৃত পানি আছে নগর-শহরে। দেশজুড়ে আছে গভীর-অগভীর নলকূপ। এর বাইরে আরও অনেক উৎস আছে পানির জন্য। এত পানির মাঝেও বড় সংকট সুপেয় পানির। পানীয়জল বলে সহজে চেনা খাওয়ার পানির দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় মানুষকে। ঘরে-বাইরে পানির জন্য রীতিমতো লড়াই করতে হয় প্রতিনিয়ত।
শুকনো মৌসুমে যেমন পানীয়জলের চাহিদা বেড়ে যায়, তেমনি খরা হলে কিংবা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে চলে যাওয়ায় সুপেয় পানির জোগান পেতে অস্থির থাকেন মানুষ। অন্যদিকে ভরা বর্ষায় বিপদ হয়ে আসে বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের দূষিত পানি। দুই মৌসুমেই নিরাপদ পানির জন্য থাকতে হয় উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তায়।
সুপেয় পানির যতটুকু জোগান মেলে, তার বিনিময় মূল্য সংস্থানেও দেশের বড় জনগোষ্ঠীকে উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়। শহরে কেনা ফিল্টারড বা বোতলের পানিও কতটা নিরাপদ, তা নিয়েও মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন ওঠে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানি সরাসরি পান করা গেলেও বাংলাদেশে সরবরাহকৃত পানি না ফুটিয়ে বা ফিল্টারে না দিয়ে কেউ পান করতে সাহস পান না। খাবার ও অন্যান্য পণ্যের মতোই সুপেয় পানির খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে অনেকের জন্য। ব্যয়বহুল ফিল্টার কেনাও সবার পক্ষে সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইডের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ডা. খাইরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, এবারের পানি দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘শান্তির জন্য পানি’। এখানে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ঘরে-বাইরে পানির জন্য যে লড়াই চলে, তা থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়া। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির সংকট প্রচণ্ড। নারীরা পানির জন্য দীর্ঘ পথ ছুটছেন। অনেকে সেচের পানির জন্য অপেক্ষা করেন। কোথাও কোথাও মানুষ লবণাক্ত পানিতে অতিষ্ঠ। সুপেয় পানি তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন। তারা প্রতিনিয়ত লড়াই করেন। এখন যদি মানুষের ঘরে ঘরে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা যায়, সেটিই হবে শান্তি ও স্বস্তির সংবাদ।
বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে এমনিতেই সরাসরি সুপেয় পানির উৎস কম, তার ওপর যে উৎসগুলো আছে, তাও বিষাক্ত করে ফেলা হয় নানাভাবে। আবার সরাসরি পানীয়জল হিসেবে ব্যবহৃত পানিও নানা ধরনের রাসায়নিক, অনুজীব-জীবাণুতে দূষিত হয়ে থাকে।
রোগতত্ত্ববিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা খবরের কাগজকে বলেন, আমাদের দেশে দুইভাবে মানুষ পানিবাহিত রোগের কবলে পড়েন। একটি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি, আরেকটি তাৎক্ষণিক। প্রাকৃতিক বা মানুষের সৃষ্ট কিছু ভারী রাসায়নিক ধাতুর মিশ্রণে নদী-নালা, খাল-বিল-জলাশয়ের পানি বিষাক্ত হয়, যা নানা প্রক্রিয়ায় মানবদেহে ঢুকে ক্যানসার, লিভারের সমস্যা, কিডনির সমস্যা, স্নায়ুর সমস্যাসহ আরও জটিল দীর্ঘমেয়াদি রোগের সৃষ্টি করে। অন্যদিকে কিছু ভাইরাস ও জীবাণু থেকে পানীয়জল দূষিত হয়ে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, গুলেনব্যারি, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, জন্ডিসসহ আরও কিছু রোগের জন্ম দেয়।
২০২১ সালের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুসারে দেশে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান দুটি কারণ হচ্ছে জন্ডিস ও ডায়রিয়া।
বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালে এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্যক্তিগত পাইপবাহী পানির ট্যাপের ৮০ শতাংশের এবং সব ধরনের উন্নত পানির উৎসে ৪১ শতাংশের মধ্যে ই. কলি ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
সুপেয় পানির লড়াই কেবল বাংলাদেশেই চলছে, তা নয়। জাতিসংঘের হিসাবমতে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশই সুপেয় পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। পানিসংশ্লিষ্ট স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত ৪৬ শতাংশ মানুষ। ওই সূত্র অনুসারে গত ৪০ বছরে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ১ শতাংশ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ২০৫০ সাল পর্যন্ত একই ধারায় এগোবে। এই বৃদ্ধির সিংহভাগ মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে, বিশেষ করে উদীয়মান অর্থনীতিতে কেন্দ্রীভূত।
সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য অনুসারে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপ্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিরাপদভাবে বা সুপেয় পানি এবং স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। একদিকে সুপেয় পানির উৎসগুলো দ্রুত প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃস্ট নানা ধরনের ভারী ধাতুর দূষণে বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে অপরিকল্পিত পয়োবর্জ্যের নিরাপদ ব্যবস্থাপনা প্রধান ও জরুরি চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কিছু নগর ও শহরে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও তা পর্যাপ্ত হচ্ছে না। আবার নিরাপদ বা সুপেয় পানির জন্য অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা ধরনের বৈষম্য-বিড়ম্বনা।
আরও পড়ূন
>রাজধানীতে ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরতা নিয়ে সংশয়
>প্রতিবছরই কমছে তিস্তার পানির প্রবাহ
>পানিদূষণ বেড়েই চলেছে
ওয়াটারএইড বাংলাদেশের তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনে বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বরাদ্দ আশ্চর্যজনকভাবে কমে গেছে, যা নিরাপদভাবে ব্যবস্থাকৃত পানীয়জল এবং নিরাপদভাবে ব্যবস্থাকৃত স্যানিটেশনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। চর ও উপকূলীয় এলাকায় পানিসংকট নিরসনে উদ্যোগ তুলনামূলক কম।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ খাওয়ার পানিসংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুসারে দেশে জাতীয়ভাবে ১৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ পরিবারে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহের সুযোগ আছে। ৭৬ দশমিক ৮১ শতাংশ নাগরিক গভীর ও অগভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করেন। বাকি ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ অন্যান্য উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশ বোতলজাত পানি, শূন্য দশমিক ৬৮ শতাংশ পুকুর বা নদীর পানি, শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ পাতকুয়ার পানি, শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ ঝরনার পানি, শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ বৃষ্টির পানি, ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ অন্যান্য উৎসের পানি পানের জন্য ব্যবহার করে থাকেন।
বছর কয়েক আগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বার্ক) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বাসাবাড়ি বা দোকানপাটে ব্যবহৃত জারের পানিতে মারাত্মক দূষণ রয়েছে। ওই গবেষণার তথ্য অনুসারে ঢাকায় পাঁচ শতাধিক কোম্পানি জারের পানি সরবরাহের ব্যবসা করছে। এর মধ্যে সরকারের লাইসেন্স আছে মাত্র ৩০০টির। ঢাকার ২৪টি পয়েন্টের ২৫০টি জারের পানির নমুনা সংগ্রহ করে তা ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা গেছে, টোটাল কলিফর্ম প্রতি ১০০ মিলিলিটারে সর্বনিম্ন ১৭ ও সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬০০ মোস্ট প্রব্যাবল নম্বর (এমপিএন) এবং ফেকাল কলিফর্ম প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে সর্বনিম্ন ১১ ও সর্বোচ্চ ২৪০ এমপিএন। অথচ এর সহনীয় মানমাত্রা ‘০’ (শূন্য) থাকার কথা (কলিফর্মের মাত্রাপ্রতি ১০০ মিলিলিটারে ২-এর নিচে থাকলেও তাকে শূন্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়)। গবেষণার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল গুলশান, বনানী, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, এলিফ্যান্ট রোড, নিউ মার্কেট, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা, মহাখালী, মিরপুর, গাবতলী, আমিনবাজার, আশুলিয়া, সাভার, চকবাজার, সদরঘাট ও কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে।
এদিকে নদ-নদীর পানি থেকেও মানুষের শরীরে যে বিষাক্ত উপাদান ঢুকছে, তা শনাক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক এক গবেষণার মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের নরউইচ ইউনিভার্সিটির কেমিক্যাল ও বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেথ এইচ ফ্রিজবি খবরের কাগজকে বলেন, ‘ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএইড) উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে প্রথমে ১৯৯৭ সালে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। তখনই আমি বিষয়টি নিয়ে প্রথম বিশদ কাজ শুরু করি। এটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাবগুলো তখনই তথ্য-উপাত্ত থেকে উঠে এসেছিল। ২৭ বছর আগের ফলাফল আর পরবর্তী তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নদ-নদীর পলির সঙ্গে আর্সেনিকের প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি আর্সেনিক ঘনত্বের মানচিত্র সংযুক্ত করার কাজ করতে গিয়েও আমি সে চিত্র দেখতে পাই।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কয়েকটি কমিটির কারিগরি বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, বেশ কিছু ভারী ধাতু পানির মাধ্যমে খাদ্যচক্র হয়ে মানবদেহে ঢুকতে পারে। যেগুলো মাত্রাতিরিক্ত হলে লিভার বা কিডনি থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না। দীর্ঘ মেয়াদে সেগুলো জমে গিয়ে ক্যানসারের সৃষ্টি করে।
মতামত
>চাহিদা, প্রাপ্যতা, মানের লড়াই চলছে
>সরবরাহ করা পানি নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে
>সংকট কাটাতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি