ঢাকা ১৭ কার্তিক ১৪৩১, শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪

পানিদূষণ বেড়েই চলেছে

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৪, ০২:৫০ পিএম
আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৪, ০২:৪১ পিএম
পানিদূষণ বেড়েই চলেছে
ছবি : সংগৃহীত

সমুদ্র কিংবা নদীর পানিতে পাওয়া যাচ্ছে বিষাক্ত প্লাস্টিক। একইসঙ্গে কলকারখানার তরল বর্জ্যও দূষণ বাড়াচ্ছে দিন দিন। ফলে রাজধানীর নদীগুলোর পানি ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ার পাশাপাশি বহুমুখী সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই পানির ইকোসিস্টেম ঠিক রাখতে এখনই সম্মিলিত প্রচেষ্টার দরকার মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘নদীর পানি দূষণের জন্য এককভাবে কাউকে দায়ী করা যাবে না। কলকারখানার মালিক, নাগরিক এবং সরকারি সংস্থার যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত আমরা সবাই দায়ী। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই দূষণ বন্ধ করা সম্ভব নয়।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্ষাকালে নদীতে পানির প্রবাহ বাড়ে এবং শীতকালে নদীতে ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। কখনো নদী একেবারে শুকিয়ে যায়। নদীতে পানির প্রবাহ নির্ভর করে ঋতু, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও উজানের প্রবাহের ওপর। পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৭৩ সাল থেকে ভূপৃষ্ঠস্থ পানির মান পরিবীক্ষণ করে আসছে। নদীর পানির গুণগত মান পরিবীক্ষণ কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি করে ৩০টি নদীর ৯৯টি স্থানের পানির গুণগত মান নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। 

পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ঢাকা শহরের চারপাশের নদীগুলো শুষ্ক মৌসুমে চার থেকে পাঁচ মাস খুব দূষিত থাকে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে তিন মাস (জানুয়ারি-মার্চ) পর্যন্ত দ্রবীভূত অক্সিজেন (DO) প্রায় শূন্য। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩ অনুসারে, মৎস্য চাষে ব্যবহার্য পানির DO≥ ৫। বর্ণিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, নদীর পানির গুণগত মান পরিবেশগত মানমাত্রার মধ্যে নাই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীর পানি দূষণের পেছনে কলকারখানার তরল বর্জ্য অনেকাংশে দায়ী। এখনো ট্রিটমেন্ট ছাড়াই সরাসরি সুয়ারেজের লাইন নদীতে পড়ছে। ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের কণা পানি দূষণের পাশাপাশি মাছের দেহে ঢুকছে। যা খাবার চেইনের মাধ্যমে মানবদেহে চলে আসছে। 

অন্যদিকে নদীর পানির পাশাপাশি সমুদ্রের পানিতেও দূষণ বাড়ছে। সমুদ্র নিয়ে গবেষণায় যুক্তরা জানান, সমুদ্রের পানি যদি দূষিত হয়, সেখানে যে জীববৈচিত্র্য আছে সেটা ধ্বংস হবে। ফলে মানুষের ভূমিতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ ৬০ ভাগ অক্সিজেন আসে সমুদ্র থেকে। সমুদ্রের পানি যে দূষণ হচ্ছে সেটা অক্সিজেনের স্বল্পতা তৈরি করছে। কার্বন দূষণের মাধ্যমে যে গরম তৈরি হচ্ছে সেটা এই পানিগুলো শুষে নিত। এখন সেটি নষ্ট হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কেএম আজম চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘সমুদ্রের পানির মান ধরে রাখা আমাদের দরকার। কিন্তু আমরা ইচ্ছামতো ময়লা ফেলছি, শিল্পকারখানার ময়লা সরাসরি ছেড়ে দিচ্ছি। গরম পানি ছেড়ে দিচ্ছি। মাইক্রো প্লাস্টিক দিচ্ছি। সবগুলো বৃষ্টির মাধ্যমে ভূমি থেকে নদী হয়ে সমুদ্রে যাচ্ছে। সমুদ্রের বিশাল এলাকা দূষিত হয়ে পড়ছে। এটা যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে ২০৫০ সালে গিয়ে দেখা যাবে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বেশি হয়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাচ্ছে। ফলে ভূমি ধসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। একইসঙ্গে দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে। পানির যে চক্র বাষ্প থেকে মেঘ হবে, মেঘ হয়ে বৃষ্টি পড়বে আবার প্রাকৃতিকভাবে ফিল্টারিং হয়ে পাতালে জমা হবে। পাতাল থেকে আবার আমরা পানি তুলে নিচ্ছি। এই চক্রও ধ্বংস হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং (বৈশ্বিক উষ্ণতা)সহ নানা কারণে। পানির ইকোসিস্টেম নষ্ট হওয়া মানে সকল প্রাণী, উদ্ভিদের জীবন ব্যাঘাত হওয়া। এটা হলে গোটা পৃথিবী ধ্বংসের পথে যাবে। এ জন্য আমাদের সব ধরনের পানির উৎস দূষণমুক্ত রাখতে হবে।’

থেমে নেই পলিথিন উৎপাদন

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫০ পিএম
আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫১ পিএম
থেমে নেই পলিথিন উৎপাদন
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ইসলামবাগ ঈদগাহ মাঠ। এর উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে বামে একটি সড়ক। সেই সড়কে ঢুকে একটু সামনে এগোলে আবার বামে ঢুকেছে খুব সরু গলি। গলির মুখ থেকে সামান্য হাঁটলেই বামের বিল্ডিংয়ের নিচ থেকে কানে আসে মেশিনের ঘস ঘস শব্দ। মেইন গেট লাগানো। সামান্য একটু জানালা খোলা। ভেতরে তাকাতেই দেখা যায়, মেশিন থেকে একের পর এক বেরিয়ে আসছে পলিব্যাগ। কারখানাটি বেশ বড়ই। 

আরেকটু সামনে এগোতেই চোখে পড়ে আরেকটি কারখানা। একটিই গেট। গেটটি খোলা। সামনে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছেন। গেট বরাবর। ভেতরে দাঁড়িয়ে কাজ করছেন কমবয়সী একটি ছেলে। মেশিন থেকে তার সামনে এসে পড়ছে পলিব্যাগ। একটু বেশি হলে তিনি সেগুলো নিয়ে গেটের বাম পাশে বসানো আরেক ছোট মেশিনে রেখে একটা অংশ কেটে পলিব্যাগের হাতল বা হ্যান্ডেল বের করছেন। ভেতরে আছেন আরেক যুবক। পলি তৈরির কাঁচামাল অর্থাৎ দানাগুলো তিনিই মেশিনে দিচ্ছেন। তারপর সেগুলো পলিব্যাগ হয়ে বেরিয়ে আসছে। 

মেশিনে দানা দেওয়ার পর পিছে ফিরে এ প্রতিবেদককে দেখে তিনি কাছে এসে বলেন, ভেতরে আসা নিষেধ। আপনি কিছু বলতে চাইলে বাইরে একটু অপেক্ষা করেন। আরেকটু কাজ করে আসি। এ প্রতিবেদক বাইরে গেলে তিনি গেটটি লাগিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর বাইরে আসেন ওই যুবক।

বুধবার বেলা ১২টার দিকে সরু গুলির এক খাম্বার পাশে দাঁড়িয়ে কথা হয় ওই যুবকের সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই যুবক জানান, তিনি এখানে কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন। ৩০ হাজার টাকা বেতন পান। এই টাকা দিয়েই তার সংসার চলে। শুনেছেন সরকার পলি নিষিদ্ধ করেছে। তাতে যদি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তার পেশা বদল করতে হবে। কোন পেশায় যাবেন, তা তিনি এখনো ঠিক করেননি। শুধু তিনিই নন, আরও বহু মানুষকে পেশা বদলাতে হবে। তার বক্তব্য পলি তৈরির কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে তার মালিকের অটোরিকশা চালানো ছাড়া আর উপায় থাকবে না। 

কারখানার মালিকের নম্বর চাইলে তিনি জানান, মোবাইল নম্বর দিতে নিষেধ আছে। মালিক সন্ধ্যায় আসবেন। দিনে থাকেন না। কাউকে ভেতরে ঢুকতে না দিতেও মালিকের নিষেধ আছে। দিন-রাত মিলিয়ে তারা চারজন কর্মচারী কাজ করেন। ২৪ ঘণ্টাই এই কারখানায় পলিথিন উৎপাদন হয়। ৫ ইঞ্চি থেকে শুরু করে ১২ ইঞ্চি সাইজের সাদা টানা ওয়ালা পলিব্যাগ উৎপাদন করা হয়। 

আজ ১ নভেম্বর থেকে দেশে পলিব্যাগ নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। কিন্তু ৩০ অক্টোবর রাজধানীর ইসলামবাদ, চকবাজার, লালবাগ, দেবিদাসঘাট লেন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, পলিথিন সংশ্লিষ্ট সব কারখানায় ব্যস্ত সময় কাটছে কারখানার শ্রমিকদের, উৎপাদন হচ্ছে আগের মতোই। সরকারের ঘোষণায় কোনো প্রভাব পড়েনি। তারা বলছেন, সরকার চাইলেই হুট করে বন্ধ করে দিতে পারে না। কারণ এর সঙ্গে অনেক মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে আছে। তাদের বিকল্প ব্যবস্থা না করে সরকার এটা করতে গেলে স‌ংশ্লিষ্ট সবাই রাস্তায় নেমে আসবেন। এই সেক্টরের পরিসর অনেক বড়। সরকারকে সবার বিষয়েই ভাবতে হবে। পরিবেশ রক্ষার কথা বলে এত মানুষের জীবন-জীবিকা তো ঝুঁকিতে ফেলতে পারে না।

দেবিদাসঘাট লেন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি কারখানার সামনে ইজিবাইকে পলিব্যাগভর্তি কয়েকটি বস্তা এনে রাখছেন এক শ্রমিক। কিসের পলি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো অর্ডারের। আপনার কোন ধরনের ব্যাগ লাগবে? একেক কারখানায় একের ধরনের পলি। আপনার কোন ধরনের লাগবে? আর সব জায়গায় আপনি পলি পাবেন না। কোনো কারখানায় রিসাইক্লিং করে দানা তৈরি করা হয়। আবার কোনো কারখানা সেই দানা থেকে চাহিদামতো পলিব্যাগ বানায়। একেক কারখানা একেক রকম পলি বানায়।

একটু সামনে চায়ের দোকান। পাশেই রয়েছে একটি রিসাইক্লিং কারখানা। চায়ের দোকানে বসে কথা হয় একটি রিসাইক্লিং কারখানার মালিক মো. সেন্টুর সঙ্গে। তিনি ২২ বছর ধরে এই ব্যবসা করে আসছেন। তিনি জানান, এই ব্যবসার টাকায় তিন ছেলে ও এক মেয়েকে লেখাপড়া করিয়েছেন। অথচ নিজে নামও লিখতে পারেন না। প্রথমে তিনি একটি কারখানায় কাজ করতেন। কাজ শিখে নিজে কারখানা করেন। 

মো. সেন্টু বলেন, বিদেশ থেকে আমদানি করা দানা থেকে পলি বানানোর সময় যেগুলো নষ্ট হয় সেগুলো বিভিন্ন কারখানায় আবার রিসাইক্লিং করে দানা তৈরি করা হয়। টোকাই বা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা মানুষের ব্যবহৃত পলি যেগুলো কুড়িয়ে বিক্রি করেন ওগুলোও রিসাইক্লিং করে দানা তৈরি করা হয়। যদি পলি নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েক লাখ মানুষ মারাত্মকভাবে সমস্যার সম্মুখীন হবেন। তাই সরকারকে বিকল্প কিছু ভাবতে হবে। যেমন এমন কোনো মেডিসিন তৈরি করা যায়, যা পলি বানানোর সময় দিয়ে দিলে নির্দিষ্ট সময় পর তা মাটিতে মিশে যাবে।

বিদেশ থেকে আমদানি করা দানা বিক্রি করা হয় রাজধানীর উর্দু রোডে। সেখানে সাইদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবু সাইদ বলেন, আমরা যে দানা বিক্রি করি তা সৌদি আরবের। পলি নিষিদ্ধ করা হলে এর প্রভাব সংশ্লিষ্ট সবার ওপর পড়বে। তাই সরকারের এই বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবা উচিত।

এখানকার আরেক ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন বলেন, সরকারকে সবার আগে চিন্তা করতে হবে পলি তৈরির কারখানাগুলোতে কত মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। আমার ধারণা পলির সঙ্গে সারা দেশে ১৫-১৬ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। জেলা পর্যায়েও কারখানা আছে। সেসব কারখানায় বহু শ্রমিক কাজ করেন। একজন মালিক, যিনি অনেক টাকা ইনভেস্ট করেছেন। আপনাকে তার কথাও ভাবতে হবে। শুধু তার কথা নয়; রাস্তার যে টোকাই পলিথিন কুড়িয়ে বিক্রি করে, তার কথাও ভাবতে হবে। সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির পেছনে যে বস্তা থাকে, কখনো চিন্তা করেছেন কেন থাকে? কারণ তিনি ওই বস্তায় আলাদা করে পলি এবং প্লাস্টিকের বোতলগুলো রাখেন। সেগুলো বিক্রি করে তার কিছু অতিরিক্ত আয় হয়। তারা ভাঙাড়ির দোকানে বিক্রি করেন, সেখান থেকে বিভিন্ন হাতবদল হয়ে, বাছাই হয়ে, ওয়াশ হয়ে চলে আসে রিসাইক্লিং কারখানায়।

যে জিনিস রিসাইক্লিং হয়, তাতে পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, যখন আপনি বন্ধ করে দেবেন তখন তো তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এগুলো তারা কুড়াবে না-গাড়িতেই নিয়ে ডাম্পিংয়ে ফেলবে। বারবার রিসাইক্লিংয়ের কারণ ওই পলিগুলোর টেম্পার কমে যায়। ফলে ওগুলো থেকে ক্ষতির আশঙ্কা কমে যায়। একসময়ে অল্পতেই মাটিতে মিলে যায়।

এখানকার আরেক দানা ব্যবসায়ী জামাল বলেন, পলি উৎপাদন বন্ধ হলে কাঁচামাল আমদানিকারক থেকে শুরু করে টোকাই-সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পলি কোথায় না লাগে? গার্মেন্টস সেক্টর থেকে শুরু করে সবখানেই বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজিংয়ে পলি ব্যাগ লাগে। একটা হোটেলে যাবেন, লিকুইড জাতীয় খাবার আনতে পলি লাগবে। মাছ-মাংস বা ডাল কি আপনি পাটের ব্যাগে নিতে পারবেন? হ্যাঁ এ জন্য সরকার পলির ফুড গ্রেড নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু হুট করে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক না।

গুলিতে খাদ্যনালি ঝাঁঝরা, বিপাকে মুন্সীগঞ্জের মঞ্জিলের পরিবার

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৭ পিএম
গুলিতে খাদ্যনালি ঝাঁঝরা, বিপাকে মুন্সীগঞ্জের মঞ্জিলের পরিবার
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে খাদ্যনালি ঝাঁঝরা হয়ে গেছে মঞ্জিল মোল্লার। পরিবারের ভরণপোষণ ও চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে গুলিতে খাদ্যনালি ঝাঁঝরা হয়ে গেছে মঞ্জিল মোল্লার (৫৩)। বন্ধ হয়ে গেছে পায়ুপথের স্বাভাবিক কার্যক্রম। বর্তমানে তার দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে।

একদিকে ১০ সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ, অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে রয়েছেন দুশ্চিন্তায় মঞ্জিল মোল্লা। দুই দফা অপারেশনের পর প্রাণে বাঁচলেও অর্থসংকটে বন্ধ রয়েছে পরবর্তী চিকিৎসা। তার স্বজনরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তার চিকিৎসার পূর্ণ ব্যয় বহন করার এবং পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন।

গত ৪ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ সুপার মার্কেটের কাছে পিঠ, হাত ও পেটে গুলিবিদ্ধ হন মঞ্জিল মোল্লা। ওই দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা মুন্সীগঞ্জ শহরের সুপার মার্কেটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক দফা দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেন। খবর পেয়ে তা প্রতিহতের ঘোষণা দেন মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফয়সাল বিপ্লব এবং তার অনুসারী আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। পুলিশও কঠোর অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে।

ওই দিন সকাল সাড়ে ৯টায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা শহরের সুপার মার্কেটসংলগ্ন পাতাল মার্কেটের সামনে এলে তাদের ওপর চড়াও হন ফয়সাল বিপ্লবের অনুসারীরা। তারা শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করেন ও তাদের লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করেন। আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ কর্মীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে শহরের মূল কেন্দ্র ‘অঙ্কুরিত যুদ্ধ ১৯৭১’ ভাস্কর্যের সামনে চলে এলে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের শত শত নেতা-কর্মী পিস্তল-রাইফেল, শটগান, দেশি অস্ত্র নিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকেন। এ রকম হামলা-পাল্টাহামলার সময় মঞ্জিলের ডান হাতে প্রথম গুলি লাগে। দ্বিতীয় গুলিটা লাগে পিঠে। এরপর তৃতীয় একটা গুলি পেটে বিদ্ধ হলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

আন্দোলনকারীদের কয়েকজন মঞ্জিলকে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পিঠের গুলি বের করা গেলেও খাদ্যনালিতে আটকে থাকা গুলি বের করা নিয়ে চিকিৎসকদের ভীষণ বেগ পেতে হয়। পরে বিডিআর হাসপাতালে খাদ্যনালির চারটি নাড়ি কেটে গুলি বের করা হয়। সংকট দেখা দেয় ক্ষতস্থানটি শুকানো নিয়ে। এ জন্য ডাক্তাররা পায়ুপথটি বন্ধ করে পেটের একপাশ কেটে একটা ব্যাগ বসিয়ে দেন। দেড় মাস চিকিৎসার পর বাড়ি ফেরেন উত্তর ইসলামপুরের মঞ্জিল মোল্লা। তার আরেকটি অপারেশনের দরকার। সেটি হলে তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারবেন।

তবে তীব্র অর্থসংকটে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি ও তার স্বজনরা। ১০ সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের অন্যতম উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি অসুস্থ থাকায় বিপন্ন অবস্থায় আছে পরিবারটি।

আহত মঞ্জিল মোল্লা বলেন, ‘আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে আমিও তাতে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমার শরীরে ৩টি গুলি লাগে। এরপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। লোকজন আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। কোনোমতে আমার প্রাণটা বেঁচে গেছে। যে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে আমার ওপর গুলি ছুড়েছেন, আমি তাদের বিচার চাই।’

আহত মঞ্জিল মোল্লার বড় মেয়ে রুপা আক্তার বলেন, ‘আমার বাবার পরবর্তী অপারেশনের জন্য ২-৩ লাখ টাকার প্রয়োজন। এই ব্যয় মেটানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারিভাবে বহন করা হবে কি না, তারও কোনো নিশ্চয়তা পাচ্ছি না। আমার এক ভাই বিবাহিত, সেও বেকার। আমাদের দাদা-দাদিসহ ১০ সদস্যের পরিবার। বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার আয়ে সংসার চলে। এভাবে কত দিন চলতে পারব জানি না। সরকারের প্রতি অনুরোধ, আমাদের পরিবারটির দিকে তারা যেন নজর দেয়।’

প্রতিবেশী রবিউল মাস্টার বলেন, ‘ওনার একটা ছেলে আছে। অনেক কষ্ট করে বাড়ির পেছনের জমি বিক্রি করে তাকে এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছেন। কিন্তু ওই ছেলে এখন বেকার। সরকার ছেলেটার একটা চাকরির ব্যবস্থা করলে ওদের সংসারটা বেঁচে যাবে। না হলে কয়েক দিন পর হয়তো তাদের পথে বসতে হবে।’

জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘আহত মঞ্জিলের বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে আহতদের তালিকা করতে আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেখানে মঞ্জিলের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আশা করছি, তিনি সরকারের প্রতিশ্রুত সহায়তা পাবেন। এ ছাড়া তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা সিএমএইচে যোগাযোগ করলে পরবর্তী অপারেশনটি বিনামূল্যে করতে পারবেন বলে আশা করছি।’

এদিকে আন্দোলনে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে আহতের ঘটনায় মুন্সীগঞ্জ সদর থানায় লিখিতভাবে অভিযোগ করার প্রস্তুতি নিয়েছে মঞ্জিলের পরিবার।

মুন্সীগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খলিলুর রহমান বলেন, ‘৪ আগস্টের ঘটনায় এখন পর্যন্ত সদর থানায় ৩টি হত্যা মামলা, একটি ভাঙচুরের মামলা ও আহতের ঘটনায় আরও একটি মামলা দায়ের হয়েছে। আহত মঞ্জিলের ঘটনায় অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পুলিশের দুশ্চিন্তা লুট হওয়া অস্ত্র

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৩০ পিএম
আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৩৬ এএম
পুলিশের দুশ্চিন্তা লুট হওয়া অস্ত্র
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ঢাকাসহ সারা দেশের থানা ও পুলিশের ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্রই এখন পুলিশসহ আইনশৃঙ্ক্ষলা বাহিনীর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই অস্ত্র দিয়েই অপরাধীরা এখন রাজধানীসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে বলে মনে করে পুলিশ। তাদের আশঙ্কা, লুট হওয়া ওই অস্ত্র আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে। আর এ জন্যই এখন অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। 

পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, জুলাই ও আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে মোট ৫ হাজার ৮২৯টি অস্ত্র লুট হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৭৬৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হলেও এখনো উদ্ধার হয়নি ২ হাজার ৬৬টি। অস্ত্র লুটের সময় ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৪২ রাউন্ড গুলিও লুট করেছে দুর্বৃত্তরা। 

জানা গেছে, মোট খোয়া যাওয়া অস্ত্রের মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রায় ১৫১২টি অস্ত্র ও এর সঙ্গে গুলি লুট করা হয়। এ ছাড়াও গণভবন ও সংসদ ভবন এলাকা থেকে ৪৮টি অস্ত্র লুট হয়েছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। অস্ত্র লুটের সময় আতঙ্কে থানা ছেড়ে চলে গিয়েছিল পুলিশ।

লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, অ্যান্টি ড্রোন গানসহ অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে। পুলিশের অস্ত্রের বাইরে ৯৪২টি ব্যক্তিগত অস্ত্রও এখন থানায় জমা পড়েনি; যা নিয়ে পুলিশের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। 

গত ১৫ বছরে যেসব বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল সেই সব অস্ত্রও জমা দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। গত ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে লাইসেন্স করা অস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও এখনো ৯৪২ জনের ব্যক্তিগত লাইসেন্স করা অস্ত্র জমা পড়েনি। পুলিশ খবরের কাগজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। 

অস্ত্র লুটের ঘটনা বেশি ঘটে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ ও নরসিংদীসহ প্রায় ২০টি জেলায়। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ সেপ্টেম্বর অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী। সেনাবাহিনী ছাড়াও পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, আনসারের সদস্যরা এই অভিযানে অংশ নিচ্ছেন। 

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মো. রেজাউল করিম মল্লিক খবরের কাগজকে বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যারা অস্ত্র লুটের ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, মেট্রো রেলস্টেশন, সেতু ভবন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানা, ত্রাণ ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়। এ সময় লুটপাটের ঘটনা ঘটে। আন্দোলন চলার সময় অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। 

সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্টের পর সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে প্রকাশ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ছে খুন। কোথাও কোথাও দুই পক্ষ আবার গোলাগুলিতে জড়াচ্ছে। মাদক কারকারবারিরা ব্যবহার করছে অস্ত্র। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

মাঠপর্যায়ে কর্মরত পুলিশের সদস্যরা জানতে পেরেছেন যে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যে অস্ত্র লুট করা হয়েছিল সেই অস্ত্রগুলো দিয়ে মূলত অপরাধের ঘটনা ঘটছে। এখন লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারেই বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের শঙ্কার কারণ হচ্ছে, এই অস্ত্র যদি আবার আন্ডারওয়ার্ল্ডের হাতে চলে যায় তাহলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। কারণ, ইতোমধ্যে কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছে। কেউ কেউ আবার মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এই সব শীর্ষ সস্ত্রাসীদের চক্রের সদস্যরা মাঠপর্যায়ে সক্রিয় হয়েছে। পুলিশ সেই বিষয়টিও খেয়াল রেখেছে। এ ছাড়াও লুট হওয়া অস্ত্র চোরাকারবারিদের মাধ্যমে সীমান্তের ওপারে চলে যেতে যেন না পারে সেই দিকেও লক্ষ্য রাখছে পুলিশ।

এদিকে, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে গত ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর অভিযানে মোট গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৭৪ জন। এই সময়ের মধ্যে উদ্ধার করা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে রিভলবার ১৯টি, পিস্তল ৭৬টি, রাইফেল ২২টি, শটগান ৩৭টি, পাইপগান ৮টি, শুটারগান ৪৩টি, এলজি ৩১টি, বন্দুক ৪৮টি, একে৪৭ ১টি, এসএমজি ৫টি, গ্যাসগান ৪টি, এয়ারগান ১০টি, এসবিবিএল ১০টি, টিয়ার গ্যাস লঞ্চার ২টি এবং থ্রি-কোয়ার্টার ২টি।

তথ্য সংগ্রহে বাড়ি বাড়ি যাবেন স্বেচ্ছাসেবকরা

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২০ এএম
আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২০ এএম
তথ্য সংগ্রহে বাড়ি বাড়ি যাবেন স্বেচ্ছাসেবকরা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

করযোগ্য আয় থাকার পরও রিটার্ন জমা না দিলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রিটার্নে সম্পদ-আয়-ব্যয়ের তথ্য গোপন করে কর ফাঁকি দিলেও একই শাস্তি পেতে হবে। শাস্তি হিসেবে জরিমানার পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রয়োজনে হিসাব জব্দ এবং রাজস্ব আইনে মামলা করতে পারবে। মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহের জন্য এবার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করবে এনবিআর।

এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

এনবিআর সূত্র জানায়, করযোগ্য হওয়ার পরও কেউ রিটার্ন জমা না দিলে তার কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে নির্ধারিত কর অঞ্চল থেকে নোটিশ পাঠানো হবে। রাজস্ব আইনে মামলা করার আগে রিটার্ন জমা না দেওয়ার বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে রিটার্ন জমা দেওয়ার বিস্তারিত কারণ জানতে প্রয়োজনে এনবিআরে ওই করদাতাকে তলব করা হবে। রিটার্ন জমা না দেওয়ায় জরিমানা করা হবে। প্রয়োজনে হিসাব জব্দের মতো কঠোর সিদ্ধান্তও নিতে পারবে এনবিআর। এ ছাড়া নিয়মিত সময়ের পর রিটার্ন জমা না দিলে রেয়াতের সুবিধা দেওয়া হবে না। করযোগ্য হওয়ার পরও ইটিআইএন গ্রহণ এবং সঠিক হিসাব দিয়ে রিটার্ন জমা দিয়েছে কি না, তা যাচাই করতে বাড়ি বাড়ি পাঠানো হবে স্বেচ্ছাসেবক (ভলান্টিয়ার)।

স্বেচ্ছাসেবকরা রাজধানীসহ সব বিভাগ, জেলা, এমনকি উপজেলা পর্যায়েও রাজস্বসংক্রান্ত সেবা দেবেন। জনপ্রতি সেবাদানের ভিত্তিতে তাদের কমিশন দেওয়া হবে। সংগৃহীত তথ্য স্বেচ্ছাসেবকরা সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলে জানাবেন। 

এনবিআর সদস্য সৈয়দ মুহাম্মদ আবু দাউদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সারা দেশের জন্য স্বেচ্ছাসেবক বা ভলান্টিয়ার নিয়োগ দেওয়া হবে। আমরা চেষ্টা করছি এবারই এসব নিয়োগ শেষ করার। কতটা পারব এখনই বলতে পারছি না। স্বেচ্ছাসেবকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে করদাতাদের রাজস্বসংক্রান্ত সেবা দেবেন। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এনবিআরের কাজে আগের চেয়ে গতিশীলতা বাড়ানো হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা সারা বছরই করদাতাদের সেবা দিয়ে চলছেন। এনবিআর কর্মকর্তারা সততা, দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করছেন। তবে কেউ যদি করদাতাদের হয়রানি করে, অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে বা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকে, তবে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।’

সম্প্রতি এনবিআরের তৈরি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘১৭ কোটি মানুষের এই দেশে ইটিআইএনধারীর সংখ্যা গড়ে ৬ শতাংশ। গত পাঁচ করবর্ষের ইটিআইএনধারী এবং রিটার্ন জমার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ইটিআইএনধারীর ৬০ শতাংশই রিটার্ন জমা দেন না। যারা রিটার্ন জমা দেন তাদের অর্ধেকের বেশি সম্পদ-আয়-ব্যয়ের তথ্য গোপন করে কর ফাঁকি দিয়ে থাকেন। অথচ রিটার্নধারীর সংখ্যা গড়ে পাঁচ কোটি হওয়ার লক্ষ্য থাকলেও এখনো এনবিআর সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। তবে অতীতের এই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কৌশলে কাজ করে করদাতা, করের পরিমাণ এবং রিটার্ন জমার পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এবার প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দেওয়া হয়েছে।’

এরই মধ্যে চার সিটি করপোরেশনে অবস্থিত আয়কর সার্কেলের অধিভুক্ত সরকারি কর্মচারী, সারা দেশের তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তা, মোবাইল প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি, ম্যারিকো বাংলাদেশ, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ, বাটা শু কোম্পানি (বাংলাদেশ), নেস্লে বাংলাদেশের কর্মীসহ কয়েকটি খাতের পেশাজীবীদের অনলাইনে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সঠিক হিসাবে রিটার্ন জমা দিতে এবং অনলাইনে রিটার্ন জমায় উৎসাহিত করতে এরই মধ্যে খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণমাধ্যমে ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এবার নতুন কৌশলে করদাতা এবং রিটার্নধারীর সংখ্যা বাড়াতে কাজ করা হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দেওয়া হয়েছে। অনলাইনে টিআইএন গ্রহণ ও রিটার্ন জমায় উৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে কর পরিশোধে স্বচ্ছতা আসবে।’

এনবিআর সূত্র জানায়, এবার এনবিআর কর্মকর্তাবহির্ভূত স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এসব স্বেচ্ছাসেবক কতসংখ্যক মানুষকে রাজস্বসংক্রান্ত সেবা দিচ্ছেন তার ওপর হিসাব কষে নির্ধারিত হারে ফি দেওয়া হতে পারে। এ কাজে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানো হতে পারে। 

স্বেচ্ছাসেবকরা শুধু যে এসব তথ্য যাচাই করবেন তা না, তারা রাজস্বসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করবেন। অনলাইনে ইটিআইএন প্রদান, রিটার্ন ফরম পূরণ এবং অনআইনে করের পরিমাণ হিসাব কষে বের করতেও সহায়তা করবেন। ঘরে বসেই কীভাবে কর পরিশোধ করা যাবে তার সহায়তাও করবেন। 

এনবিআর সংস্কারসংক্রান্ত কমিটির সদস্য এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সাধারণত বড় মাপের করদাতারা কর ফাঁকি দিয়ে থাকেন। এসব ব্যক্তি আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কর ফাঁকি দিয়ে থাকেন। অনেকে আবার রিটার্নই জমা দেন না। রিটার্ন জমায় কঠোরতা আনা সম্ভব হলে দেশের করের পরিমাণ বাড়বে।’

আয়কর আইন অনুযায়ী, করদাতা ১ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর ২০২৪ তারিখের মধ্যে ২০২৪-২৫ করবর্ষের রিটার্ন দাখিল করবেন। এই সময়ের পর রিটার্ন জমা দিলে আয়কর আইন, ২০২৩-এর ধারা ১৭৪ অনুযায়ী ওই করদাতার যেকোনো ধরনের কর অব্যাহতি বা করমুক্ত আয় করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কোনো ধরনের বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত সুবিধা পাবেন না। এভাবে হ্রাসকৃত হারে কর প্রদানের সুবিধা পাবেন না। শুধু তা-ই না, আয়কর আইন, ২০২৩-এর ধারা ২৬৬ অনুযায়ী তাকে নির্ধারিত হারে জরিমানা পরিশোধ করতে হবে। এই জরিমানার পরিমাণ হবে সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা। প্রয়োজনে প্রতিদিনের জন্য ৫০ টাকা করে জরিমানা করা যাবে। রিটার্ন জমা দিচ্ছেন কিন্তু আরোপযোগ্য কর হয়নি, এমন করদাতাদের সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। 

এনবিআর বিশেষ কারণ দেখিয়ে নিয়মিত কর প্রদানের সময় বাড়াতে পারবে। এবার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে অনেকে রিটার্ন জমার প্রস্তুতি নিতে পারেননি বা ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা গেছে তাই কর জোগাড় করা সম্ভব হয়নি- এমন কারণ দেখিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা থেকে এনবিআর রিটার্ন জমার নিয়মিত সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। 

৩০ নভেম্বরের পর রিটার্ন জমা দিলে জরিমানা যেমন দিতে হবে, তেমনই কোনো কর রেয়াতও মিলবে না। যেমন এতদিন যাতায়াত ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, ইন্টারনেট বিলসহ নানা ধরনের ভাতা পান চাকরিজীবীরা। এসব ভাতার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত। এসব ভাতার অর্থ আর করমুক্ত থাকবে না।

আয়কর আইনে একজন ব্যক্তির প্রথম ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর শূন্য কর। পরবর্তী ১ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। এর পরের ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর কর ১০ শতাংশ। পরবর্তী ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর কর ১৫ শতাংশ। এর পরের ৫ লাখ পর্যন্ত কর দিতে হবে ২০ শতাংশ হারে। অবশিষ্ট যা মোট আয় থাকবে সেটির ওপর ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। নারী এবং ৬৫ বছর বা তারচেয়ে বেশি বয়সীদের জন্য করমুক্ত ব্যক্তি আয়ের সীমা ৪ লাখ টাকা। তৃতীয় লিঙ্গ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা।

আয়কর কর্তৃপক্ষের কাছে একজন করদাতার বার্ষিক আয়, ব্যয় এবং সম্পদের তথ্যাবলি নির্ধারিত ফরমে উপস্থাপন করার মাধ্যম হচ্ছে রিটার্ন।

তারা এখন বঞ্চিতের তালিকায়!

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১০:০৮ এএম
আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১০:২৪ এএম
তারা এখন বঞ্চিতের তালিকায়!
খবরের কাগজ ডেস্ক

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের অপসারণসহ বিভিন্ন দাবির কারণে এই অস্থিরতা। এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত তিন দফা মহাপরিচালক পরিবর্তন করা হয়েছে। বদলি করা হয়েছে অনেককে। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী চিকিৎসক সমাবেশের নামে মহাখালী এলাকার বিভিন্ন বস্তি থেকে লোক এনে প্রতিদিন অধিদপ্তরের সামনে জড়ো করা হচ্ছে।

অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী বলছেন, এসবের পেছনে রয়েছেন চার কর্মকর্তা। যারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। সরকার পতনের পর রং বদল করে নিজেদের সুবিধাবঞ্চিত ঘোষণা দিয়ে অধিদপ্তরে অস্থিরতা সৃষ্টি করছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, এই চার কর্মকর্তা মূলত সুবিধাভোগী। সব সরকারের আমলে সুবিধা পেতে তৎপর। বর্তমানে তারা সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অধিদপ্তরের নিচে সমাবেশ করেন। দুপুরের পর মেতে ওঠেন বদলি বাণিজ্যে। তাদের বিরুদ্ধে সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক এ বি এম খুরশীদ আলমকে অপমান করা, সরকার পতনের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দায়িত্ব দেওয়া অধ্যাপক রোবেদ আমিনকে বের করে দেওয়া, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সামনে টেবিলে দাঁড়িয়ে ধৃষ্টতা দেখানো এবং সরকারি আদেশ অমান্য করার অভিযোগ আছে।

গত রবিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়ে দেখা গেছে, সকাল থেকে তারা অবস্থান নিয়ে আছেন। দাবির পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিচ্ছেন। মাইকের শব্দে কর্মকর্তাদের অফিস করতে অসুবিধা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, আধিপত্য বিস্তার এবং বদলি বাণিজ্যের হোতা এই চার কর্তকর্তা হলেন শাহ আলী আকবর আশরাফী, ডা. মো. ফারুক হোসেন, মাহবুব আরেফিন রেজানুর ও ডা. মো. আবদুল ওয়াদুদ। তাদের ব্যক্তিগত নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শাহ আলী আকবর আশরাফী ১৯৯৪ সালের ২৫ মার্চ সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। ২০১২ সালের পর তিনি চারবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। একবার মন্ত্রণালয়েও দায়িত্ব পালন করেন। 

২০১২ সালের ১ জানুয়ারি তাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ষষ্ঠ গ্রেড নিশ্চিতে ২০১৪ সালের ৩ ডিসেম্বর কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে যোগদান করেন। মাত্র চার মাসের মাথায় ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল আবারও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ফিরে আসেন। 

এক বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে ২০১৬ সালের ২০ মার্চ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। এরপর দুই মাসের ব্যবধানে ২০১৬ সালের ২৬ মে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। এরপর শাহ আলী আকবর আশরাফী ২০২০ সালের ১ নভেম্বর পুনরায় ফিরে আসেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। এরপর থেকে গুরুত্বপূর্ণ এমআইএস বিভাগে কর্মরত আছেন। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই সময়ে তিনি (শাহ আলী আকবর আশরাফী) শুধু উপপরিচালক হিসেবেই ছিলেন না, গোটা এমআইএসের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। তিনি আসার পর পাঁচ দফা এমআইএস পরিচালক পরিবর্তন হলেও আশরাফী ছিলেন বহাল। এই দপ্তরের কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবই ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। কোনো পরিচালক তার কাজে বাধা দিলেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হতো। এই সময় নিম্নমানের ট্যাব ও ডেস্কটপ কিনে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি কোভিডের সময় তিনি টিকা সনদের দায়িত্বে ছিলেন। এ সময় ভুয়া টিকা সনদ বেচাকেনার হিড়িক পড়ে যায়। সরকারের গোয়েন্দাদের জালে নিম্ন পর্যায়ের কর্মীরা ধরা পড়লেও শাহ আলী আকবর আশরাফী থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরই তিনি নিজেকে বৈষম্যের শিকার বলে আন্দোলনে নেমে পড়েন। 

গত ১৭ অক্টোবর শাহ আলী আকবর আশরাফীকে ময়মনসিংহ বিভাগীয় পরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়। তবে সেখানে তিনি যোগদান করেননি। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ আলী আকবর আশরাফী বলেন, ‘‌আমি ১৩তম বিসিএসের। অথচ ২০তম বিসিএসের অধীনে দায়িত্ব পালন করেছি। এর চেয়ে বড় বৈষম্যের উদাহরণ আর কী দেখতে চান। এটাই কি যথেষ্ট নয়?’

চারজনের আরেকজন ডা. মো. ফারুক হোসেন। যার বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার তিলছাড়া গ্রামে। তিনি ১৯৯৮ সালের ২৮ জুন মাগুরার ২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ২০০২ সালের ২৪ অক্টোবর মেডিকেল অফিসার হিসেবে সংযুক্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগ দেন। ২০২১ সালের ৭ মার্চ ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ফিন্যান্স) হিসেবে এবং একই বছরের ২১ ডিসেম্বর প্রোগ্রাম ম্যানেজার (লজিস্টিক অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) হিসেবে সংযুক্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগদান করেন। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ার সুবাদে ডা. মো. ফারুক হোসেন নিজেকে আওয়ামী লীগার পরিচয় দিয়ে অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। এই সময়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের সব ধরনের কেনাকাটা ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। এই দপ্তরের একজন চিহ্নিত ঠিকাদার এবং ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর হয়ে সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত হয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আওয়ামী সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী চিকিৎসকদের ব্যানারে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। 

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘প্রোগ্রাম ম্যানেজার থাকলেও আমাদের কাজে ডাকতেন না। সব লাইন ডাইরেক্টরই করতেন।’ প্রোগ্রাম ম্যানেজার বা ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার থাকলেও বঞ্চিত ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, লাইন ডাইরেক্টরের কথার বাইরে কিছুই করার সুযোগ ছিল না। যেভাবে বলতেন সেভাবেই করতেন। নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ ছিল না। সব সময় ভয়ে থাকতেন কখন আবার ঢাকার বাইরে বদলি করে দেন। সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর সঙ্গে সখ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‌একই এলাকায় বাড়ি হওয়ায় স্যার ভালো জানতেন। সেই দিক থেকে স্যার ঢাকায় আসতে সহযোগিতা করেছিলেন।

মাহবুব আরেফিন রেজানুর ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার রামশীল ইউনিয়ন হেলথ সাব-সেন্টারে মেডিকেল অফিসার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। ২০১৭ সালে তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগ দেন। ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ডিভিশনাল চিফ (ল্যাব অ্যান্ড ফিল্ড) হিসেবে প্রমোশন পেয়ে ইনস্টিটিটিউশন অব পাবলিক হেলথ নিউট্রিশনে (আইপিএইচএন) যোগদান করেন। এই পদায়নের পর তিনি সেখানে নিজের লুটপাটের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। তাকে এই সুযোগ করে দেন বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ গোলাম নবী। তারা দুজনেই রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী। 

মাহবুব আরেফিন রেজানুর বিএনপি-সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) মহাখালী শাখার সদস্যসচিব। জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রদল করেছেন। চাকরি জীবনে ১৭ বছর খুবই বঞ্চিত হয়েছেন। 

তিনি বলেন, ‘আমাকে বদলির পর বদলি করা হয়েছে। কখনো মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা এলাকায় আবার কখনো লক্ষ্মীপুরে, কখনো একেবারেই প্রত্যন্ত এলাকায় বদলি করে রাখা হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা হলেও বসিয়ে রাখা হতো ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে। সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হয়েছি।’ ২০২২ সালে ডিভিশনাল চিফ (ল্যাব অ্যান্ড ফিল্ড) হিসেবে প্রমোশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওই পদে কেউ আসতে চান না। ওখানে কিছুই নেই। যে পদে কেউ আসতে চান না, সেখানে আমাকে দায়িত্ব দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়। বাসা থেকে যেতাম আর আসতাম। আমি ছাত্রদল করার কারণে বৈষম্যের শিকার হয়েছি। আমি ড্যাব করে আসছি প্রকাশ্যে। এর মধ্যে গোপন কিছু নেই।’ 

যদিও বিএনপির হাইকমান্ড দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর কার্যক্রমে বিব্রত। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কড়া নির্দেশনা রয়েছে যাতে কেউ নেতিবাচক কোনো কর্মকাণ্ডে না জড়ান। কিন্তু সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকে। এ পর্যন্ত অন্তত পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে দলটি। বিএনপির কিছু কিছু নেতা-কর্মীর কর্মকাণ্ড অনেকেই ভালোভাবে নিচ্ছেন না। তারা বলছেন, এখনো তারা ক্ষমতায় বসেননি, তার আগেই যদি আওয়ামী লীগের মতো শুরু করেন, তাহলে ক্ষমতায় বসলে এসব লোকজন আওয়ামী লীগের চেয়েও বেপরোয়া হয়ে উঠবেন।

ডা. মো আবদুল ওয়াদুদ ২০০১ সালের ৩১ মে চাকরিতে যোগদান করেন। ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই তিনি ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (সংযুক্তি) হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগ দেন। ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রোগ্রাম ম্যানেজার (এএসপি) হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগদান করেন। এরপর থেকে তিনি ঢাকায় কর্মরত। ডিপিএম ও পিএম হিসেবে তিনি লুটপাটের স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলেন। এ সময় তিনি নিজেকে স্বাচিপ সমর্থক হিসেবে পরিচয় দিয়ে সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামিউল ইসলাম এবং বিএমএর মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরীর আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ডা. মো. আবদুল ওয়াদুদকে ফোন করা হলে তিনি কেটে দেন।

এসব বিষয়ে ড্যাবের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমাদের দাবি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ পদে আওয়ামী ঘরানার কাউকে যাতে না বসানো হয়। কিন্তু পরিচালক (প্রশাসন) পদে যাকে (ডা. এ বি এম আবু হানিফ) বসানো হয়েছে তিনি সব সময় আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন। ডোনেট করেছেন। এখন বলা হচ্ছে তিনি নাকি জামায়াত সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন এনডিএফের লোক। এটা হতেই পারে না। যারা আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলে তো আবার আমাদের এই লোকগুলোই বঞ্চিত হবে। তাই ওরা এদের সরানোর দাবিতে আন্দোলন করলে ওদেরই বদলি করে দেওয়া হয়। তাদের বদলির আদেশ প্রত্যাহার করা হলে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আশা করি, দ্রুত একটা সমাধান আসবে।’

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর সঙ্গে ডা. মো. ফারুক হোসেনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি (ড্যাব সভাপতি ডা. হারুন অর রশিদ) বলেন, তার সেক্টরের হেড ছিলেন সৈয়দ মোদাচ্ছের। তিনি শেখ হাসিনার খুবই আস্থাভাজজন ছিলেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে না চললে তো তার চাকরি থাকার কথা নয়। তাই হয়তো ততটুকুই যোগাযোগ রক্ষা করেছেন।

ড্যাব সভাপতি শাহ আলী আকবর আশরাফী প্রসঙ্গে বলেন, তার ব্যাচের লোকজন ডিজি হয়েছেন। এই দিক থেকে তিনি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। তবে হ্যাঁ, এটা আপনি বলতে পারেন যে তারা কিছু সুবিধা পেয়েছেন। যেমন রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি দেওয়া হয়নি। তারা ঢাকায় কয়েক বছর থাকতে পেরেছেন। এদিক থেকে বলতে গেলে তারা কিছুটা সুবিধা পেয়েছেন। কিন্তু সব মিলিয়ে দেখলে তারা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এরা কখনো পরিচালক প্রশাসনের মতো আওয়ামী লীগের মিটিংয়ে যাননি। তারা অন্দোলনের সময় ছাত্রদের বিপক্ষে যাননি। ছাত্রদের চিকিৎসা দেওয়াসহ সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন।