
নানামুখী চাপের মধ্যে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপ হচ্ছে মূল্যস্ফীতির। সরকার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এমন পরিস্থিতিতে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট তৈরি করছে সরকার। যা আগামী জুনের প্রথম সপ্তাহে ঘোষণা করতে পারেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সভায় আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় একই সঙ্গে অর্থনীতির হালনাগাদ পরিস্থিতি উঠে আসে।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, মূল্যস্ফীতি এখন অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ। তাই মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে চায় সরকার। এ জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে।
নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। তার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে মাত্র ৫ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সাধারণত আগের বছরের মূল বাজেট থেকে ১০ থেকে ১২ শতাংশ বেশি প্রাক্কলন করে নতুন বাজেট করা হয়। কিন্তু এবার হয়েছে তার ব্যতিক্রম। বাজারে যাতে অর্থের জোগান কম থাকে, সে জন্য সম্ভাব্য বাজেটের আকার ছোট করা হচ্ছে। অর্থাৎ বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচননীতির পথে হাঁটছে সরকার। উদ্দেশ্য মূ্ল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা।
জানা যায়, নতুন অর্থবছরে বাজেটে দশটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন, বাজেট ঘাটতি সীমিত রাখা, প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সরবরাহ ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন রাখা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো, ডিজিটাল শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় জোর দেওয়া, মেগাপ্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় কৌশল গ্রহণ ইত্যাদি।
এদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ যে আছে তা নিজেও স্বীকার করেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াশিকা আয়শা খান। বৈঠকের পর সচিবালয়ে তার দপ্তরে খবরের কাগজকে তিনি বলেন, ‘তুরস্কসহ অনেক দেশে মূল্যস্ফীতির হার আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। আমরা চেষ্টা করছি এটি নিয়ন্ত্রণে আনার। আগামী ছয় মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে আশা করছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। কারণ, এটি এখন অর্থনীতির বড় ইস্যু। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদ হার বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর বিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী ছয় মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।
সূত্র বলেছে, কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে আনতে চায় সরকার। সে জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হচ্ছে সাড়ে ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু এটি ধরে রাখা যায়নি। গত দুই বছর ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই। এখন এটিকে কমিয়ে আনাই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের ঊর্ধ্বতন পরিচালক ড. জায়েদ বখত খবরের কাগজকে বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। সে বিষয়ে বাজেটে পদক্ষেপ থাকতে হবে। উন্নয়ন ব্যয়ের গুণগত মান বাড়াতে হবে। বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ব্যয় কমাতে হবে অণু-উন্নয়ন খাতের। বাজেটে এসব উদ্যোগের প্রতিফলন দেখতে চায়।
ব্যয় সংকোচন বাজেট প্রসঙ্গে খ্যাতনামা এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, সাধারণভাবে মুদ্রা সরবরাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়ে। সরকারি ব্যয় বাড়লে চাপ আরও বাড়বে। সে জন্য সরকার ব্যয় কমানোর চিন্তা-ভাবনা করছে। আমি একে সমর্থন করি।
সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলনের প্রস্তাব করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির প্রৃবদ্ধির হার ধরা হয় সাড়ে ৭ শতাংশ।
সরকার নিজেও জানে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না। তাই সংশোধন করে কমানো হয়েছে এবং লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় সাড়ে ৬ শতাংশ। যদিও এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফ। গত মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত হালনাগাদ বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট প্রতিবেদনে এ বছর বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাস পর্যন্ত অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো বেশ চাপে থাকায় সরকারের ব্যয়ে বড় ধরনের কাটছাঁট করে সম্প্রতি বাজেট সংশোধন করা হয়েছে। প্রায় দুই বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। মূলস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানোসহ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এবার একই উদ্দেশ্যে সরকারি ব্যয় কমানো হচ্ছে।
জানা গেছে, নতুন বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৩১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ২ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১ লাখ কোটি টাকার বিদেশি ঋণ পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার। বাকি ১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা দেশের ব্যাংকিং খাতসহ অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে।
সংশোধিত বাজেট : চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট দেয় সরকার। তবে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় চলতি বাজেট বাস্তবায়নের শুরুতেই টাকা খরচের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ওপর কয়েকটি বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। তা ছাড়া জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। এসবের প্রভাবে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মোট বাজেটের মাত্র ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ৭ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ ।
ভার্চুয়াল সভায় নতুন অর্থবছরের বাজেটের সম্ভাব্য রূপরেখা উপস্থাপন করেন অর্থ সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার। সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সভায় অংশ নেন পরিকল্পনামন্ত্রী, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআর চেয়ারম্যান ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।