আগামী জুনে শেষ হতে চলেছে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন- ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ। প্রকল্পটি চালিয়ে নিতে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক অনিশ্চয়তায় এর মেয়াদ আগামীতে বাড়বে কি না- তা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠছে। চলমান ইভিএম প্রকল্প ত্রুটিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল মন্তব্য করে প্রকল্পটি নতুন করে এগিয়ে নিতে আগ্রহ নেই ইসির।
সরকারের পক্ষ থেকেও প্রকল্প এগিয়ে নিতে এখনো আর্থিক জোগানের নিশ্চয়তা পায়নি ইসি। এতদিন ইভিএম ইস্যুতে ইতিবাচক অবস্থান দেখালেও এখন প্রকল্প নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব ইসি কর্মকর্তাদের। ইভিএম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোট কারচুপি বন্ধ করে জনসাধারণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য এই পদ্ধতির বিকল্প আপাতত নেই।
২০১৮ সালে কে এম নূরুল হুদা কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে এই প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করে। ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ২৪ লাখ টাকায় কেনা হয় দেড় লাখ ইভিএম। তখন প্রতিটি ইভিএমের দাম পড়েছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, যা ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের প্রায় ১১ গুণ বেশি। নানা পর্যায়ে দ্বিমত থাকার পরও এ প্রকল্প থেকে পিছু হটেননি তারা। যদিও ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৬টি আসনে ইভিএম ব্যবহৃত হয়। সবমিলে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করেছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন।
তবে ৫ বছর না যেতেই দেড় লাখ ইভিএমের ১ লাখ ১০ হাজারই নষ্ট হয়ে যাওয়ার দায় নূরুল হুদা কমিশনের- এমন দাবি করছে বর্তমান ইসি।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ইভিএম নিয়ে তৎকালীন কমিশনের উদ্দেশ্য ভালো থাকলেও প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পটি পরিচালনায় ঘাটতি ছিল। এত উচ্চ দামে কেনা ইভিএম যন্ত্রগুলোর সঠিক ব্যবহার, সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না। এতে যন্ত্রগুলোর কার্যকারিতা ১০ বছর মেয়াদি বলা হলেও ৫ বছর পরই সেগুলোর বেশির ভাগই অচল হয়ে গেছে। কাজেই আমি মনে করি প্রকল্পটি ত্রুটিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল ছিল। এমন ত্রুটিপূর্ণ প্রকল্প আমি থাকলে নিতাম না।
সরকারি নতুন বরাদ্দ ছাড়া ব্যয়বহুল এই প্রকল্প চালিয়ে নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না বলে জানান এই কমিশনার। তিনি বলেন, পুনরায় বাজেট বরাদ্দ পেলে আগামীতে কম খরচে আরও আধুনিক ইভিএম তৈরির পরিকল্পনা বর্তমান কমিশনের রয়েছে। চলমান ইভিএমে অনেক খরচ ছিল। এ খাতে এত বেশি ব্যয় আমরা করতে চাই না। খুব কম অর্থ ও লোকবল দিয়ে চালানো যাবে- এমন ধরনের কোনো ইভিএম তৈরি করা যায় কি না, সেটি দেখা হবে। ইভিএম প্রতি সর্বোচ্চ খরচ ৫০ হাজার টাকার বেশি করা যাবে না। সে লক্ষ্যে ভারতের মতো কম খরচে বিতর্কহীন ইভিএম তৈরি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও বসবে ইসি।
ইভিএমের প্রকল্প পরিচালক কর্নেল রাকিবুল হাসান জনিয়েছেন, দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে আছে ১ লাখ ১০ হাজার ইভিএম। বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য ইভিএম রয়েছে মাত্র ৪০ হাজার। সেগুলো দিয়ে আসছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পর্যায়ক্রমে চার ধাপে ৬৯টি উপজেলায় ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন। এর আগে সংসদের উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকারের সাধারণ ও উপনির্বাচন মিলে প্রায় ১৪ হাজার নির্বাচন হয়েছে ইভিএমে। তবে নতুন করে অর্থ সংস্থান না পেলে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলোও অকেজো হয়ে পড়বে। তখন সেগুলো মেরামতের জন্য অর্থের জোগান না পেলে উপজেলার পর অন্য কোনো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সম্ভাবনা কম।
ইভিএম কারিগরি কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, ব্যালট মাধ্যমে ভোট কারচুপির দীর্ঘদিনের অপসংস্কৃতি বন্ধ করে, আধুনিক ও স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থায় ইভিএম অত্যন্ত বিশ্বস্ত মাধ্যম। ইভিএম জনসাধারণের ভোটাধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে ইভিএমের প্রকল্প পরিকল্পনায় ত্রুটি ছিল বলে আমি মনে করি। সে কারণেই সঠিক ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেশির ভাগ ইভিএম অকেজো হয়ে পড়েছে। এই পদ্ধতিতে ভোটের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক। কারণ বিগত ৫ বছরে আমরা দেখেছি সরকার প্রায় ১৫শ ভোট এই পদ্ধতিতে করেছে। সেসব নির্বাচন নিয়ে ইসিও সন্তোষ জানিয়েছে। কাজেই এই পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতায় ঘাটতি নেই। প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া ইতিবাচক হবে না।
দেশে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন- ইভিএমের যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালে, ওয়ান ইলেভেন সরকারের আমলে। প্রথমে সেটা ছিল পাইলট প্রকল্প। সেসময় এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন সিটি করপোরেশনে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করেছিল, কিন্তু সংসদ নির্বাচনে নিতে পারেনি। পরে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পরিধি পর্যায়ক্রমে বাড়ায় পরবর্তী সব কমিশন।
সবশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমদিকে ১৫০ আসনে এবং পরবর্তী সংকট বাস্তবতায় ৬০ থেকে ৭০টি আসনে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইসি। কিন্তু নষ্ট ইভিএমগুলো মেরামতসহ প্রয়োজনীয়সংখ্যক বাড়তি ইভিএম কেনার বাজেট না পাওয়ায় কোনো আসনেই ইভিএমে ভোট হয়নি। তবে স্থানীয় সরকার ও সংসদ নির্বাচনের উপনির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন।
এ পর্যায়ে সরকারের নতুন বরাদ্দ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ফের অনিশ্চয়তায় পড়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। সরকার প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়ালে জুনের পরই নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকা ইভিএমগুলো ধ্বংস করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তার আগে হাতে থাকা ইভিএমগুলোর ভবিষ্যত নিয়েও এখন সরকারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সাংবিধানিক সংস্থাটি।