ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতি স্থিতিশীল এবং গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে বলে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল জনমনে। কিন্তু সরকার পতনের এক বছর পার না হতেই দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা স্পষ্ট হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিরোধ বাড়তে থাকায় দলগুলোর মধ্যে দোষারোপের রাজনীতি তীব্র আকার ধারণ করেছে।
সর্বশেষ গত ৯ জুলাই মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ কয়েকটি দল বিএনপির বিরুদ্ধে শক্তভাবে মাঠে নেমেছে। পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপিও। বর্তমানে একদল অন্য দলকে রাজনীতির মাঠে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন বিদ্বেষপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হলে তার ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে, তা নিয়ে সুধী সমাজের পাশাপাশি পর্যবেক্ষক মহলে নানা আলোচনা উঠছে। বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হলে গণতন্ত্রের জন্য সেটি হুমকি হয়ে উঠতে পারে। কারও মতে, এ ধরনের পরিস্থিতি অরাজনৈতিক শক্তির উত্থান হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দলটির নিবন্ধনও স্থগিত রয়েছে। আগামী নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ অনিশ্চিত। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টিসহ ১৪-দলীয় কয়েকটি দলের কার্যক্রমও একরকম বন্ধ। এ রকম এক পরিস্থিতিতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, এবি পার্টিসহ কিছু দল সক্রিয় রাজনীতি নিয়ে মাঠে রয়েছে। কিন্তু এ দলগুলোর মধ্যে বিরোধ যেভাবে তীব্র হচ্ছে তাতে দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ কেউ পলিটিক্যাল পার্টি সিস্টেম বা রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার আলামত দেখছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘একটি দল স্লোগান দিচ্ছে- আওয়ামী লীগ গেছে যে পথে, বিএনপি যাবে সেই পথে। অত সহজ নয়।’
গতকাল পটুয়াখালীতে দেওয়া এক বক্তব্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বিএনপি এখন একটি চাঁদাবাজদের দলে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে যখন একটা আশার সঞ্চার হয়েছে, ঠিক সেই সময়ই কয়েকটি রাজনৈতিক দল, কয়েকটি চক্র বাংলাদেশের রাজনীতিকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, এই ষড়যন্ত্র নতুন নয়। এই চক্রান্তকারীরা বাংলাদেশকে আবার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে যাতে নির্বাচন না হয়, সেই চেষ্টা তারা করছে। এই পরিকল্পনাকে অত্যন্ত ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রথমত আমি মনে করি, বিএনপিকে একেবারে ধ্বংস বা শেষ করে দেওয়া সম্ভব না। হয়তো সাময়িকভাবে দুর্বল করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, একটি গোষ্ঠী ভাবছে, বিএনপিকে এবার শেষ করে দিতে পারলে তারা একক কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারবে। তাহলে তারা ভুল ভাবছে- এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনেও নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাড়তে থাকবে। একে অপরকে বাতিল করতে চাইবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ইদানীং নানা রকম অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমার মনে হয়, শুধু বিএনপি দল হিসেবে অপপ্রচারের শিকার হচ্ছে না, বাংলাদেশের পার্টি সিস্টেম ভেঙে দিতে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।’ তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে দেশের অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ভঙ্গুর। এমন পরিস্থিতিতে দেশের পার্টি সিস্টেম ভেঙে দিলে ওয়ান-ইলেভেনের মতো সরকার আসার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এটা দেশের জন্য ক্ষতি, তখন দেশের ভবিষ্যৎ অবস্থা অন্ধকার।’
‘বিএনপির ভুলত্রুটি রয়েছে। যারা অপকর্ম করছে তাদের বহিষ্কার করেছে। কিন্তু তাদের যারা দলে জায়গা দিয়েছেন তাদের বহিষ্কার করছে না। আমি শুনেছি, মিটফোর্ডের ব্যবসায়ী নাকি একসময় আওয়ামী লীগ করতেন। ৫ আগস্টের পর তাকে বিএনপির দলে জায়গা দিল কারা? রাজনৈতিক দলগুলোর দোষত্রুটি যাই-ই থাকুক না কেন, তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তা না হলে দেশের গণতন্ত্র ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে। রাজনীতিতে নোংরা ভাষা ব্যবহার থেকে সব দলকেই বিরত থাকতে হবে’ যোগ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বর্তমানে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দলীয় সিস্টেম যদি দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে তৃতীয় শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার শঙ্কা থাকে। এখন এই দিকে যাচ্ছে কি না স্পষ্ট না; তবে একটা আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। প্রত্যেকটা দলই কোনো না কোনোভাবে দুর্বল অবস্থায় আছে বা তাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা হচ্ছে। নতুন দলগুলোও ভালোভাবে অবস্থান করতে পারছে না। এটা দেশের জন্য অশনিসংকেত।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ তো নিষিদ্ধ। সে কারণে প্রকাশ্যে নেই। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের একটা গোলমাল লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে। জামায়াত বিএনপির সহযোগী ছিল, সেখান থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে। ভেতরে একধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে এবং সেটি তৈরি করা হচ্ছেও।’
‘এনসিপি বা অন্যান্য নতুন দল হয়েছে সেগুলোর কার্যক্রম সেভাবে হচ্ছে না। চিত্রটা স্থির না, একটা অস্থির অবস্থা। এ রকম অস্থির অবস্থা যখন হয়, তখন জরুরি অবস্থা আসার আশঙ্কা থাকে। তৃতীয় শক্তির ক্ষমতা নেওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হতে পারে। গণতান্ত্রিক একটা দেশে এই অবস্থাটা ভালো না। আমরা খুব ভালো দিকে যাচ্ছি না। প্রত্যেক দলকে লক্ষ করা উচিত, নিজেদের মধ্যে গোলমাল মিটিয়ে ফেলা উচিত। যেন গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়। সরকারেরও সেদিকে খেয়াল করা উচিত। প্রত্যেককে এখন সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। সব দলের নেতাদের এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের এখনই নজর দেওয়া উচিত’ যোগ করেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উপ-উপাচার্য।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কোনো ঐক্যবদ্ধ নীতির বাস্তবায়ন বা নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্বাচন কোনোটাই সম্ভব হয় না রাজনৈতিক দল ছাড়া। রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় নীতি নির্ধারণ করে এবং জনগণের স্বার্থের জন্য জনমত গঠন করে এবং দাবি-দাওয়া তুলে ধরে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারব্যবস্থায় এর বিকল্প নেই। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক এডমন্ড বার্কের মতে, রাজনৈতিক দল হলো একটি সুসংগঠিত জনসমষ্টি, যারা কোনো নির্দিষ্ট নীতির দ্বারা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং যৌথ প্রচেষ্টার দ্বারা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলকে কেবল দেশের ক্ষমতা দখলের জন্য উৎসুক সংগঠনরূপে গণ্য করলে ভুল করা হবে। রাজনৈতিক দল বিদ্যমান রাষ্ট্রক্ষমতা সংরক্ষণ অথবা তার ধ্বংস সাধনের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের পথ ও প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। ভারত, পাকিস্তান, ইতালি, ফ্রান্সসহ বিশ্বের অনেক দেশে এ ধরনের সিস্টেম দেখা যায়। ফলে এসব দেশে সরকার গঠনের জন্য বিভিন্ন দলের সমর্থন প্রয়োজন হয়। আর সেই দলীয় ব্যবস্থা যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এ ছাড়া মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কমে যাওয়া স্বৈরশাসনেরও সূচনা করে। অনেকের মতে, এসব কারণেই হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় দলের হাইকমান্ড। চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের কারণে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে গত ৯ জুলাই মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী সোহাগকে হত্যার পর থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ নানা মতের মানুষ। দলের শীর্ষ নেতাকে নিয়েও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেওয়া হয়। ক্যাম্পাসগুলোও উত্তাল হয়ে ওঠে। এগুলো বিএনপিকে দুর্বল করার চক্রান্ত বলে মনে করছে দলটি। এ ঘটনায় বিএনপির দৃঢ় অবস্থান থাকার পরও একটি চিহ্নিত মহল পরিকল্পিতভাবে বিএনপি এবং বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের শালীনতা ও চরিত্রহননের দুঃসাহস প্রদর্শন করছে বলে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মন্তব্য করেন।
ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, বিএনপির সমালোচনা করলে দেশের ক্ষতি হবে, গণতন্ত্রের ক্ষতি হবে। তবে বিএনপিকে পার্টির মধ্যে জমে থাকা ময়লা, যারা দলের ক্ষতি করছে এসব অবাঞ্ছিত লোকদের পরিষ্কার করতে হবে। সমাজের মধ্যে চরিত্রহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন ও সুবিধাবাদী লোক থাকে। এরা সুযোগ বুঝে বিভিন্ন দলে ঢুকে পড়ে। শুধু বিএনপি নয়, অন্যান্য দলে রয়েছে। যত দ্রুত করা যাবে, ততই দেশ ও দলের মঙ্গলজনক। দলের মধ্যে আদর্শগত প্রচার চালাতে হবে।
অন্যদিকে বিশ্লেষকদের একটি অংশ মনে করছেন, ৫ আগস্টের পর বিএনপি অনেক ঘটনায় বহিষ্কার করেও অনেক স্থানে নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাই আরও কার্যকর পদক্ষেপ দরকার। দেশের কল্যাণের জন্যও বিএনপির প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে। অন্যথায় জামায়াত কিংবা অন্য দলগুলোর পক্ষে অভ্যুত্থানের বিরোধী শক্তিকে মোকাবিলা করে দেশ পরিচালনা করতে পারবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিএনপি অনেক বড় দল। সবাই মনে করে আগামীতে নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। এ জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো সক্রিয় হয়েছে। সুযোগ বুঝে ওই সব দল বিএনপির ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। তবে গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনা বিএনপিকে শেষ বা ধ্বংস করতে পারেনি। আগামী দিনেও কেউ পারবে না।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে নানা রকম সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর। গণ-অভ্যুত্থানের আসল নায়ক ছাত্ররা। তাদের নামে বহুমাত্রিক শক্তি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিদিন বিপরীত শক্তি সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে।’
তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের পর নানা শক্তির তৎপরতা বেড়েছে। আমার মনে হয়, এসব শক্তির বিরাজনীতিকীকরণের একটা প্রবণতা থাকতে পারে। দৃশ্যমান রাজনীতির একটা শক্তি এর সঙ্গে লিপ্ত থাকতে পারে। নোংরা ভাষা পরিহারের জন্য রাজনীতিবিদদের সম্মিলিতভাবে আচরণ বিধি থাকা জরুরি। নো মব জাস্টিস, দলে কোনো চাঁদাবাজকে রাখা যাবে না- এটা প্রত্যেক দলকে মেনে চলতে হবে। হালুয়া-রুটির রাজনীতি ও আদর্শিক রাজনীতির পার্থক্য সবাইকে বুঝতে হবে।