দেশে কাজের ক্ষেত্র কম। আবার কাজ পেলেও আয় আশানুরূপ নয়। স্বাচ্ছন্দ্যে ভরণ-পোষণ চালানো দায়। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গেলেই নাকি হাজার হাজার টাকা আয়ের সুযোগ। এমন লোভনীয় প্রস্তাব পেয়ে ভাগ্য বদলের জন্য ঝুঁকি নেন তরুণী আফরোজা (ছদ্মনাম)। চোরাপথে বান্ধবী সাদিয়ার হাত ধরে দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী হায়দ্রাবাদে পাড়ি জমান তিনি। তাকে বলা হয়েছিল বিউটি পার্লারে কাজের কথা। কিন্তু হায়দ্রাবাদে পা রাখতেই তার স্বপ্নভঙ্গ হয়। বুঝতে পারেন বড় রকমের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর পথ খোলা নেই।
হায়দ্রাবাদে মোটা অঙ্কের টাকায় আফরোজাকে এক যুবকের কাছে বিক্রি করে দেয় সাদিয়া। সেখান থেকে সেই যুবক তাকে নিয়ে যায় দিল্লিতে। সেখানে আফরোজাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় এক যৌনপল্লির সর্দারনীর কাছে। কিন্তু দেহ ব্যবসায় রাজি না হওয়ায় আফরোজার ওপর চলে পৈশাচিক নির্যাতন। আফরোজা সুযোগ খুঁজতে থাকেন পালিয়ে যাওয়ার। এরই মধ্যে নরক যন্ত্রণার কয়েক মাস কেটে যায়। একপর্যায়ে সুযোগ পেয়েই ট্রেনে চেপে পালিয়ে চলে পশ্চিমবঙ্গের শিয়ালদহে। ওই তরুণী তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ঘুরতে থাকেন সেখানকার অচেনা পথে-ঘাটে একদিন শিয়ালদহ স্টেশনে আফরোজাকে উত্ত্যক্ত করছিল কয়েকজন তরুণ। বুঝতে পেরে ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিও ক্লাবের সম্পাদক অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস বিষয়টি পুলিশকে জানান। পুলিশ আফরোজাকে উদ্ধার করে একটি সেফ হোমে পাঠায়। পরে সেখানে তার চিকিৎসা শুরু হয়। এরপর তারা জানতে পারেন আফরোজার বাড়ি বাংলাদেশে। অম্বরীশ নাগ বিষয়টি লিখিতভাবে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দিল্লির পুলিশকে জানান। পরে ভারতীয় হাইকমিশন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও হ্যাম রেডিওর প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় ৬ মাস পর তার পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়। পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাকে বেনাপোল দিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছে দেওয়া হয়। পরে বেনাপোল পুলিশের সহায়তায় তাকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
আফরোজার মা খবরের কাগজকে জানান, ‘সংসারে অভাবের কারণে মেয়েকে কাজে দিয়েছিলেন। এক বছর ধরে মেয়ের খোঁজ না পেয়ে পাগল ও দিশেহারা ছিল পরিবারের লোকরা। এখন মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন। এটাই বড় সান্ত্বনা।’
গত ৩০ এপ্রিল ভারতে সাজাভোগের পর বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে আফরোজাসহ বাংলাদেশে ফেরে ৫ জন নারী ও ১৪ শিশু।
৯ বছরের একটি মেয়ে ঢাকার রাস্তায় বাবার সঙ্গে ভিক্ষা করত। হঠাৎ তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। দেড় বছর আগে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তাকে ভারত থেকে উদ্ধার করে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। জানা যায়, তার সঙ্গে একই বয়সের আরও একটি মেয়েকে দালালচক্র ভারতে নিয়ে যায়। ঘটনাচক্রে দুটি মেয়েই ভারতীয় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পাচারের শিকার নারী-শিশুদের নিয়ে কাজ করেন এমন একাধিক ব্যক্তি জানান, যৌনকাজে নিযুক্ত করতে পাচার হওয়াদের মধ্যে ৪০ শতাংশই শিশু। প্রতিবছর হাজারও নারী-শিশুকে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয় ভারতের মুম্বাই ও পুনের মতো শহরে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পশ্চিমবঙ্গের নারী-শিশু পাচার রোধ বিষয়ক টাস্কফোর্সের সমন্বিত প্রচেষ্টায় তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ফেরত নারী ও শিশুরা বিভিন্ন সময় অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে। তারা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সেফ হোমের হেফাজতে ছিল। পরবর্তী সময়ে এদের নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাইয়ের পর ট্রাভেল পারমিট ইস্যু করে ফিরিয়ে আনা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক বিদোষ চন্দ্র বর্মণ জানান, দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগের মাধ্যমে এই নারী-শিশুদের আনা হয়েছে। ফিরে আসা নারী ও শিশুদের ৩টি মানবাধিকার সংগঠনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এসব মানবাধিকার সংগঠন তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
২০২০ সালের মানব পাচার তথা টিআইপি বা বৈশ্বিক ট্রাফিকিং ইন পারসন (টিআইপি) সূচকে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়েছিল। টায়ার মাইনাস টু থেকে টায়ার টুতে উন্নীত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই এই অগ্রগতির প্রশংসা করেছিল।
প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে কত নারী-শিশু পাচার হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান পুলিশ বা কোনো বেসরকারি সংস্থার কাছে নেই। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশু পাচার হয়েছে। বছরে দেশ থেকে ২০ হাজার নারী, কিশোরী ও শিশু ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে।
যেভাবে পাচার করা হয়
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, অবৈধভাবে সীমান্ত পার হতে চাওয়া ব্যক্তিদের অস্থায়ীভাবে সীমান্ত এলাকার কোনো বাড়িতে এক বা দুই দিনের জন্য রাখা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা অন্য কেউ তাদের সম্পর্কে জানতে চাইলে ওইসব বাড়ির লোকজন আত্মীয় বলে পরিচয় দেন। পরে সুযোগ বুঝে মধ্যরাতে সীমান্ত পার করে দেওয়া হয়। সীমান্তের ওপারে ভারতের বাড়িগুলোতেও একইভাবে আত্মীয় পরিচয়ে তাদের রাখা হয়। পরে সেখান থেকে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী খবরের কাগজকে বলেন, প্রতিবছর কতজন মানুষ পাচার হয়, তা নির্ধারণ করা খুবই কঠিন। বিশাল বর্ডারের অসংখ্য খান-বিল বা জলাশয় রয়েছে, এসব অঞ্চলে কিছু গ্রুপ আছে। যারা পাচারের কাজটি করে। কাজের জন্য যারা স্বেচ্ছায় যায় তারা কিন্তু আসামিদের নাম ঠিকানা বলতে পারে না। ফলে পাচারকারীদের শনাক্ত করা কঠিন। চাইলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
এই অপরাধ বন্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, পাচার বন্ধে কাজ করা উচিত। তবে এখানে বিজিবি, বিএসএফ, লোকাল পুলিশ, দালাল, মাস্তানরা জড়িত থাকায় এ অপরাধ বেড়েই চলেছে। তাই প্রতিটি জেলায় ডিসিরা এ বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা নিয়ে থাকলেও তেমন কোনো কাজ হয় না।
এ বিষয়ে বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন ভক্ত খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভারত থেকে যে ২০ নারী ও শিশুকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তারা বিভিন্ন সময় পাচারের শিকার হয়েছিল। তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
পাচার বন্ধের বিষয়ে ওসি জানান, পাচার ঠেকাতে আমরা বিভিন্ন সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করে থাকি। এ ছাড়া বিজিবিও আমাদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।