ঢাকা ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, বুধবার, ০৪ জুন ২০২৫
English

নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব আইনের তোয়াক্কা করে না কেউ

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৪, ১২:৪৬ পিএম
আপডেট: ১৪ মে ২০২৪, ১২:৪৮ পিএম
আইনের তোয়াক্কা করে না কেউ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর চার মাস পেরিয়ে গেলেও নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব (রিটার্ন) নির্বাচন কমিশনে জমা দেননি শতাধিক প্রার্থী ও ৯টি রাজনৈতিক দল। চট্টগ্রামসহ তিন জেলার প্রার্থীদের ব্যয়ের হিসাব এখনো পুরোপুরি বুঝে পাননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে দুর্বলতার কারণেই বন্ধ হচ্ছে না এসব অনিয়ম।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে, ভোটের ফল গেজেট আকারে প্রকাশের পরবর্তী এক মাসের (৩০ দিন) মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থী এবং তিন মাসের (৯০ দিন) মধ্যে সব দলের ইসিতে নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব বিবরণীর সত্যায়িত কপি দাখিল করা বাধ্যতামূলক। সংসদ নির্বাচনের পর সংস্থাটির নির্বাচন পরিচালনা শাখা থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন আদেশ জারি করা হয়। তাতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সব প্রার্থী ও দলকে নির্বাচনি ব্যয়ের রিটার্ন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়।

আইন অনুযায়ী, এই দলগুলোর নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল গত ৭ এপ্রিল। আর প্রার্থীদের হিসাব জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল গত ৭ ফেব্রুয়ারি। এবারের সংসদ নির্বাচনে ভোটের লড়াইয়ে অংশ নেয় ২৮টি রাজনৈতিক দল। 

সংসদ নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন আসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে খবরের কাগজের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আরপিও আইনে উল্লিখিত ভোট-পরবর্তী নির্ধারিত সময়ে ২৮টি দলের মধ্যে নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব (রিটার্ন) ইসিতে জমা দিয়েছে মোট ১৯টি রাজনৈতিক দল। তাদের মধ্যে সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সংস্থার পক্ষ থেকে পাঠানো চিঠির পর ১০ হাজার টাকা জরিমানাসহ রিটার্ন জমা দিয়েছে চারটি দল। এখনো ব্যয়ের হিসাব জমা দেয়নি ৯টি দল। তারা হলো বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। তাদের মধ্যে বাড়তি এক মাস সময় চেয়ে ইসিতে আবেদন করেছে দুটি দল- জাকের পার্টি ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট।

সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের বিপরীতে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মোট ১ হাজার ৯৭৭ জন। তাদের মধ্য থেকে ভোটের পর নির্বাচনি ব্যয় বিবরণী জমা দিয়েছেন ১ হাজার ৭৪৮ প্রার্থী। অন্যদিকে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর চার মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো নির্বাচনি ব্যয় বিবরণী জমা দেননি এক শর বেশি প্রার্থী। এ ছাড়া তিন জেলার (চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ ও নাটোর) প্রার্থীদের ব্যয়ের হিসাব এখনো পুরোপুরি বুঝে পাননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এবার প্রার্থীদের জন্য ভোটারপ্রতি সর্বোচ্চ ব্যয় ১০ টাকা এবং ভোটার সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, একজন প্রার্থীর জন্য সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা নির্বাচনি ব্যয়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল ইসি। 

গণপ্রতিনিধিত্ব আইনে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক দলকে প্রার্থী অনুপাতে ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যেমন- কোনো দলের প্রার্থী ২০০ জনের বেশি হলে সর্বোচ্চ ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা, প্রার্থীর সংখ্যা ১০০ জনের বেশি, তবে ২০০ জনের কম হলে ব্যয়সীমা ৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া কোনো দলের প্রার্থীর সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ হলে সেই দল দেড় কোটি টাকা এবং প্রার্থীর সংখ্যা ৫০ জনের কম হলে তাদের সর্বোচ্চ ব্যয়সীমা ৭৫ লাখ টাকা। 

বিগত দিনে আইন লঙ্ঘনের শাস্তি ও ব্যবস্থা
আইনে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচনি ব্যয়ের বিবরণী জমা না দিলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম দুই থেকে সাত বছরের কারাদণ্ডের শাস্তি বা জরিমানার বিধান রয়েছে। আর দলের ক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি নিবন্ধন বাতিলের বিধান রয়েছে। 

বিগত বেশ কয়েকটি সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনি ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নির্ধারিত সময়ে নির্বাচনি ব্যয় বিবরণী জমা না দিয়ে আইন লঙ্ঘনকারী অর্ধশতাধিক প্রার্থীর মধ্যে অন্তত ২৩ জনের বিরুদ্ধে ইসি মামলা করেছিল। যেটি ছিল সংসদ ভোটের পর নির্বাচনি ব্যয়ের রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলার প্রথম ঘটনা। 

তার আগে অষ্টম সংসদে প্রায় দুই হাজার প্রার্থীর মধ্যে পাঁচ শতাধিক প্রার্থীই রিটার্ন দাখিল না করে পার পেয়ে যান।

অন্যদিকে দলের ক্ষেত্রে নির্বাচনি ব্যয় বিবরণী জমা না দেওয়ার কারণে এ পর্যন্ত কোনো দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের নজির নেই। তবে ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব জমা না দেওয়ায় দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে ইসি মামলা করেছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন নির্বাচনে বেশির ভাগ দল ও প্রার্থীই সময়মতো তাদের ব্যয়ের রিটার্ন দাখিল না করে পার পেয়ে গেছেন। একই সঙ্গে প্রকৃত নির্বাচনি ব্যয়ের তথ্য তারা কৌশলে গোপন করেন। 

অনিয়ম নিয়ে টিআইবির বিশ্লেষণ
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটে অংশ নেন ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মোট ১ হাজার ৭৩৩ প্রার্থী। ওই নির্বাচনের পর ২১টি আসনের ৪৫ জন প্রার্থীর নির্বাচনি ব্যয়ের রিটার্ন নিয়ে গবেষণা করে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা টিআইবি। 

তাদের তথ্য অনুযায়ী, ব্যয়ের রিটার্ন জমা দেওয়া এসব প্রার্থীর মধ্যে ৪০ জন প্রার্থী ব্যয়ের রিটার্ন জমা দিয়েছেন। এই প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাবের তথ্য গবেষণা করে টিআইবি দেখতে পায়, বেশির ভাগ প্রার্থীই তাদের প্রকৃত ব্যয়ের তথ্য গোপন করেছেন। কোনো প্রার্থীই রিটার্নে ২৫ লাখ টাকার বেশি ব্যয় দেখাননি, বরং অনেক কম দেখিয়েছেন। ৪০ জনের মধ্যে একজন সর্বনিম্ন ব্যয় দেখিয়েছেন ৭১ হাজার ৩০০ টাকা। আর সর্বোচ্চ ব্যয় দেখিয়েছেন একজন, ২৫ লাখ টাকা। 

অথচ মাঠের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ প্রার্থীই প্রচারের জন্য অনুমোদিত সময়ে নির্ধারিত ব্যয়সীমার অনেক বেশি ব্যয় করেছেন।

এবারের সংসদ নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দল ছাড়াও স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ৪৩৭ জন। সব মিলিয়ে ৩০০ আসনে ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ১ হাজার ৯৭৭ জন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী দেয় জাতীয় পার্টি ২৬৪ জন, দ্বিতীয় স্থানে আওয়ামী লীগ ২৬৫ জন। দল দুটি সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয় করার সুযোগ পায়। এ ছাড়া তৃণমূল বিএনপি ১৩৫ জন ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি ১২২ জন করে প্রার্থী দিয়েছিল। দল দুটি সর্বোচ্চ ৩ কোটি টাকা করে ব্যয় করার সুযোগ পায়।

ভোটে অংশ নিলেই ব্যয়ের হিসাব দিতে হবে: এম সাখাওয়াত হোসেন
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব জমা না দিলে প্রার্থীদের জন্য জেল-জরিমানা আর দলের ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাতিলের যে বিধান রয়েছে, তা কি কখনো কার্যকর করা হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দলের ক্ষেত্রে না হলেও নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব জমা না দেওয়ায় সংখ্যা মনে নেই, বেশ কয়েকজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে আমাদের সময় মামলা করা হয়েছিল। অনেকে জেলেও গিয়েছিলেন। এ ছাড়া কয়েকজনকে জরিমানা বা অর্থদণ্ড করা হয়। অনেক প্রার্থী মনে করেন ভোটে হেরে গেলে আবার রিটার্ন কেন দিতে হবে! আইনে আছে, হারুক বা জিতুক প্রার্থী হলে তাকে নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব দিতেই হবে। তবে দলের ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নিতে হয়নি কারণ সব দলই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হিসাব দিয়েছিল, যদিও দল-প্রার্থী কারোর জমা দেওয়া হিসাবই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে নানা কৌশলে তারা নির্ধারিত অঙ্কের মধ্যেই ব্যয়ের হিসাব দিয়ে থাকেন। নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব নিয়ে এই লুকোচুরি বন্ধে এ আইন করার পরামর্শ আমি দিয়েছিলাম, পরবর্তী সময়ে সে ব্যাপারে কাউকে উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।’

লুকোচুরি দৃশ্যমান, আইন প্রয়োগে ব্যর্থ কর্তৃপক্ষ: ড. ইফতেখারুজ্জামান
নির্বাচনের প্রকৃত ব্যয় লুকানো, সময়মতো রিটার্ন দাখিল না করা- ঘটনাগুলো সবারই জানা, দৃশ্যমান। এসব অনিয়ম বন্ধের এখতিয়ার কমিশনের। আইনে সুস্পষ্টভাবে তা উল্লেখও করা আছে। তারপরও দু-একটা ব্যতিক্রম পদক্ষেপ ছাড়া আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায় না। দীর্ঘদিন ধরে চলা এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের কোনো শাস্তি না হওয়ায় এ ধরনের প্রতারণাকে দল বা প্রার্থীদের বেশির ভাগই স্বাভাবিক, অলিখিত এখতিয়ার মনে করেন। ভাবখানা এমন যে তারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। জনগণের প্রতিনিধিত্ব তারা কতখানি করেন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। 

নির্বাচনকে ঘিরে ভোটের মাঠে যে অর্থের খেলা হয় তার খুব সামান্যই তাদের ব্যয় বিবরণীতে প্রদর্শিত হয়। কিন্তু বিষয়টি খতিয়ে দেখে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ দেখা যায় না। রাজনৈতিক শক্তির অনৈতিক প্রভাবে আইনি ব্যবস্থা কার্যকরে সংশ্লিষ্ট সংস্থার উদাসীনতা ও সক্ষমতার ঘাটতিতে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। নির্বাচনে অনিয়মের বেড়াজাল কিন্তু তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়, অর্থ ও পেশিশক্তির ধারাবাহিক প্রভাবে। এসবের প্রতিকার ইসির একার পক্ষে করা সম্ভব নয় মনে করি। একমাত্র পারবে রাজনৈতিক দলগুলো, যদি তারা দায়িত্ব নিয়ে প্রতিকারের উপায় খোঁজে। অনিয়ম রোধে নৈতিক ও জনকল্যাণমুখী রাজনীতিতে কীভাবে ফিরে আসা যার তার নীতি-কৌশল দলগুলোকেই নির্ধারণ করতে হবে। 

এ বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানিয়েছেন, ‘আইনে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে প্রার্থী ও দলগুলোর কাছ থেকে তাদের নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব জমা নিয়ে সেগুলো ইসিতে পাঠাতে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে কয়েক দফা চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত বেশির ভাগ প্রার্থী ও দল হিসাব জমা দিয়েছেন। আইন অনুযায়ী আবেদন সাপেক্ষে হিসাব দিতে ব্যর্থ দলের জন্য ১৫ দিন জরিমানা ছাড়া এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানাসহ সর্বোচ্চ এক মাস বর্ধিত সময় দেওয়া যাবে। ওই সময়ের মধ্যে না দিলে দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার বিধান রয়েছে। বর্ধিত সময়সীমা শেষ হওয়ায় অভিযুক্ত দল ও প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

শতাধিক আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০১:৫৬ পিএম
আপডেট: ০৪ জুন ২০২৫, ০২:০৪ পিএম
শতাধিক আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত অর্থবিলে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে আমদানি করা শতাধিক পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গাড়িতে বাড়তি কর পরিশোধের প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ে কঠোর হওয়ার কথা বলা হয়েছে। অনলাইনে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রাজস্ব মামলা নিষ্পত্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্টদের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এভাবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের অর্থবিলে বিভিন্ন ধারা যুক্ত করে পদে পদে রাজস্বের ভার বাড়ানো হয়েছে।

নতুনভাবে কোন খাতে কত শতাংশ রাজস্ব ধার্য করা হয় তার গাণিতিক হিসাব অর্থবিলে থাকে। এ ছাড়া রাজস্ব সংক্রান্ত যেসব গুরুত্বপূর্ণ ধারা বিদ্যমান রাজস্ব আইনে নেই, কিন্তু বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে রাজস্ব আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাও অর্থবিলে থাকে। 

আগামী অর্থবছরের অর্থবিলে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে বাদাম, কমলালেবু, মাল্টা, আঙুর, আপেলের মতো সাধারণ মানুষের কাছে চাহিদা আছে এমন সব ফলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। 

শুধু এসব ফল না, মাখন, দুগ্ধজাত চর্বির দামও বাড়ানো হয়েছে। সব ধরনের মসলা যেমন, লবঙ্গ, জিরা, দারুচিনির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের পটেটো চিপসের দামও বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। ফলের জেলি ও জ্যাম বাজেট ঘোষণার পর বেশি দামে আমদানি করতে হবে। ফলের রস আমদানিতে শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে ফলের রসের দাম বাড়বে। 

পারফিউম, শেভ করার সরঞ্জামাদি, সাবান ও টয়লেটে ব্যবহার করার সামগ্রীর ওপরও সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্য আমদানিতে খরচ বাড়বে। একইভাবে আমদানি করা হীরা, জুয়েলারি, পোশাক, পশমী কম্বলের দামও বাড়বে। রেডিও-টেলিভিশনের যন্ত্রপাতি আমদানির ওপরও সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এভাবে শতাধিক পণ্যে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ফলে বাড়বে এসব জিনিসের দাম। 

অর্থবিল বিশ্লেষণ করে বলা যায়, বাদাম আমদানির ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হয়েছে। প্রক্রিয়াজাত নয় এমন তামাক আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ করা হয়েছে। মার্বেল, চুনযুক্ত পাথর, গ্রানাইটের সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হয়েছে। ১২ ধরনের পেইন্ট অ্যান্ড বার্নিশের শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। সাবান এবং সাবান হিসেবে ব্যবহৃত সারফেস অ্যাকটিভ সামগ্রী এবং সমজাতীয় পণ্য আমদানিতে শুল্ক ৪৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ করা হয়েছে। মোড়কজাত পণ্য ও ডিটারজেন্টের শুল্ক ২০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। অমসৃণ হীরার সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ করা হয়েছে।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে শতাধিক পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব পণ্যের বেশির ভাগই প্রয়োজনীয় এবং সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে থাকে। তাই আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে এসব পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে।’ 

আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের অর্থবিল বিশ্লেষণ করে বলা যায়, বিলটি পাস হলে ১ জুলাই থেকে গাড়ির নিবন্ধন ও ফিটনেস নবায়নে অগ্রিম কর বাড়বে। 

এখন ৫২টির বেশি আসনের বাসের ক্ষেত্রে অগ্রিম কর ১৬ হাজার টাকা। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছর এই গাড়িতে অগ্রিম কর দিতে হবে ২৫ হাজার টাকা।

বর্তমানে ৫২টির বেশি আসন না, এমন বাসের ক্ষেত্রে অগ্রিম কর ১১ হাজার ৫০০ টাকা। আগামী বাজেটে এই গাড়িতে অগ্রিম আয়কর ২০ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের অগ্রিম কর ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা। 

আগামী অর্থবছর এই গাড়িতে অগ্রিম কর ৫০ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। 

ডাবল ডেকার বাস, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিনিবাস ও ৫ টনের বেশি ক্যাপাসিটির ট্রাক, লরি বা ট্যাংকের অগ্রিম কর ১৬ হাজার টাকা। আগামী বাজেটে এসব প্রতিটি যানের ক্ষেত্রে অগ্রিম কর ২৫ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয় এমন মিনিবাসের বর্তমান অগ্রিম কর ৬ হাজার ৫০০ টাকা। আগামী বাজেটে ১২ হাজার ৫০০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। 

প্রাইম মুভারের বর্তমান কর ২৪ হাজার টাকা। আগামী বাজেটে ৩৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বর্তমানে ৫ টনের বেশি নয়- এমন ক্যাপাসিটির ট্রাক, লরি বা ট্যাংকলরির ৯ হাজার ৫০০ টাকা। আগামী বাজেটে ৩০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। 

বর্তমানে দেড় টনের বেশি নয়, তবে ৫ টনের কম নয় এমন ক্যাপাসিটির ট্রাক, লরি বা ট্যাংক, পিকআপ ভ্যান, হিউম্যান হলার, ম্যাক্সি বা অটোরিকশা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয় এমন ট্যাক্সিক্যাবের জন্য ৪ হাজার টাকার কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে ১৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আবার দেড় টনের বেশি নয় এমন ট্রাক, লরি ও ট্যাংকলরির অগ্রিম কর ৭ হাজার ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। 

বর্তমানে পিকআপ ভ্যান, হিউম্যান হলার, ম্যাক্সি বা অটোরিকশা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয় এমন ট্যাক্সিক্যাবের কর বাড়িয়ে আগামী বাজেটে ১৫ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। 

এনবিআর সূত্র জানায়, বর্তমানে একের অধিক গাড়ি ব্যবহার থাকলে বেশি কর দিতে হয়। এ ছাড়া পরিবেশ সুরক্ষার জন্য ‘কার্বন ট্যাক্স’- এর আদলে কর বসানো আছে। এসব বহাল রাখা হয়েছে। 

কোটিপতি কমলেও আমানত বেড়েছে

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০১:৪৬ পিএম
আপডেট: ০৪ জুন ২০২৫, ০২:০৩ পিএম
কোটিপতি কমলেও আমানত বেড়েছে
প্রতীকী ছবি

সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে। তবে বেড়েছে আমানতের পরিমাণ। চলতি বছরের মার্চ শেষে এক কোটি টাকার বেশি জমা রয়েছে, এমন হিসাবের সংখ্যা কমেছে ৭১৯টি। একই সময়ে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ৮ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দুর্নীতির অভিযোগে বেশ কিছু সাবেক এমপি, মন্ত্রী ও নেতার ব্যাংক হিসাব জব্দ এবং তলব করা হয়েছে। এর ফলে বড় অঙ্কের আমানতকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অনেকেই নিরাপত্তার কারণে ব্যাংক থেকে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছেন। এতে কোটিপতি হিসাবের সংখ্যা কমলেও কিছু অ্যাকাউন্টে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে। তাদের মতে, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ যখন দিশেহারা, তখন একশ্রেণির মানুষের অর্থ বৃদ্ধি দেশে আয়বৈষম্য বাড়ার ইঙ্গিত। তাদের মতে, করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং সাম্প্রতিক সময়ে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে আশঙ্কাজনক হারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী মানুষের আয় বাড়েনি। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমন অবস্থায় অর্থ জমানো দূরের কথা, অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। এই সময় দেশের একটি শ্রেণির মানুষের আয় বেড়েছে। এরা হচ্ছেন পুঁজিপতি, বিত্তবান ও বড় বড় প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। তাদের আয় আগেও বেশি ছিল, এখন আরও বেড়েছে। মূলত আয়বৈষম্যের কারণেই দেশের কোটি টাকার আমানত বাড়ছে। এ ছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে কালোটাকা অর্জন, হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা, করনীতিতে অসামঞ্জস্য, ধনীদের কাছ থেকে কম হারে কর আদায়ও আয়বৈষম্য বাড়ায়। এসব কারণে একশ্রেণির মানুষের বৈধ-অবৈধ উপায়ে আয় বাড়ছে। তবে আয় কমেছে এমন মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গত সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, সেখানেও আয়বৈষম্য কমানোর কোনো দিকনির্দেশনা নেই। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোরও কোনো পদক্ষেপ নেই। এই অবস্থায় আয়বৈষম্য কমাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর অনেক মন্ত্রী-এমপিসহ প্রভাবশালীদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এতে অনেক আমানতকারী তাদের আমানত সরিয়ে নিয়েছেন। ফলে কোটিপতি আমানতধারীর সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তবে এসব হিসাবে রাখা আমানতের পরিমাণ বেড়েছে। এটা সমাজের আয়বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করার একটা অন্যতম দৃষ্টান্ত। দেশে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার কারণেই এই আয়বৈষম্য বাড়ছে। তাই বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বাড়ানো না গেলে সামনে এটা আরও বাড়তেই থাকবে।’

একই বিষয়ে গতকাল বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেটে কর কাঠামোতে যে কয়েকটি স্তরের কথা বলা হয়েছে, সেখানেও বড় ধরনের বৈষম্য করা হয়েছে। অর্থাৎ নিম্নবিত্তদের বেশি ও উচ্চবিত্তদের কম কর দিতে হবে। যদিও বাজেটের মূল দর্শন হওয়া উচিত ছিল রাজস্বনীতির মাধ্যমে আয় বৈষম্য কমানো। 

প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ শেষে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ৩৬২টি, যা গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় ৭১৯টি কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে কোটিপতি হিসাবগুলোর আমানতের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫ সালের মার্চ শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে কোটিপতি হিসাবগুলোর আমানত বেড়েছে ৮ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। 

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে হিসাব ও আমানতের সংখ্যা বেড়েছে। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৩২ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩২টি, আর মার্চ শেষে তা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৫৭ লাখ ৬৮ হাজার ৮২১টিতে। একই সময়ে আমানতের পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭১১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে হিসাব বেড়েছে প্রায় ২৪ লাখ ৬০ হাজারটি। আর আমানত বেড়েছে ৩৯ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কোটিপতি হিসাব মানেই তা ব্যক্তিমালিকানাধীন নয়। এসব হিসাবের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠান, সংস্থা এবং একজন ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। ফলে হিসাবের সংখ্যা কমার অর্থ ব্যক্তি কোটিপতির সংখ্যা কমেছে, তা নির্ধারণ করা যায় না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী ১৯৭২ সালে দেশে কেবল ৫ জন কোটিপতি হিসাবধারী ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তা বেড়ে হয় ৪৭ জন। এরপর ১৯৮০ সালে ছিল ৯৮টি, ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি এবং ২০০৮ সালে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালের শেষে এ সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৯০৮টি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তা হয়েছিল ১ লাখ ২২ হাজার ৮১টি, যা মার্চে নেমে আসে ১ লাখ ২১ হাজার ৩৬২টিতে। 

ঈদযাত্রা বাসের টিকিট মিলছে না, রেলে ফিরতি যাত্রার টিকিটে কারসাজি

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ১০:৪৭ এএম
আপডেট: ০৪ জুন ২০২৫, ১০:৪৮ এএম
বাসের টিকিট মিলছে না, রেলে ফিরতি যাত্রার টিকিটে কারসাজি
ছবি: খবরের কাগজ

ঈদুল আজহার বাকি মাত্র দুই দিন, ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন রাজধানীর অনেক বাসিন্দা। ঈদের আগে আজ বুধবার শেষ কর্মদিবস। পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, আজ বিকেলে অফিস শেষ হওয়ার পর বিকেল থেকে রাজধানীর চার আন্তজেলা বাস টার্মিনাল, ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যাবে। তাদের ধারণা, আজ সন্ধ্যার পর রাজধানী থেকে বের হওয়ার প্রতিটি পয়েন্টে বাড়তি চাপ পড়বে, যার প্রভাবে যানজট হতে পারে রাজধানীর নানা সড়কে।

গতকাল কলাবাগান, ফকিরাপুল, ফুলবাড়িয়া ও মহাখালী আন্তজেলা বাস টার্মিনালে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছেন খবরের কাগজের এই প্রতিবেদক। যাত্রীদের মধ্যে যারা আগে থেকে ঈদযাত্রার টিকিট কাটেননি তারাই কাউন্টারে এসে বিপাকে পড়েছেন। কাউন্টারম্যানরা জানান, গত ১৫ মে থেকেই অনলাইনে ঈদযাত্রার টিকিট বুকিং করা শুরু হয়েছে। এখন আন্তজেলা রুটের বিলাসবহুল এসি বা নন-এসি বাসের কোনো টিকিট নেই। 

মহাখালী আন্তজেলা বাস টার্মিনালে চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী একতা এক্সপ্রেস, বগুড়ার রিফাত পরিবহন, সিলেটের বিয়ানীবাজার রুটের বিলাস পরিবহন ও এনা পরিবহন, রংপুরের এসআর ট্রাভেলস, ময়মনসিংহের এনা ও ইউনাইটেড পরিবহনের কাউন্টারগুলোতে অনেক যাত্রী টিকিট খুঁজছিলেন। 
এদের একজন বাড্ডার বাসিন্দা মিজানুর রহমান। রংপুর যাবেন বলে এসএ পরিবহনের এসি বাসের টিকিট খুঁজছিলেন তিনি। স্বাভাবিক সময়ে রংপুর রুটে এই পরিবহনের ইকোনমি ক্লাসের এসি বাসের ভাড়া ৯০০ টাকা, হুন্দাই এসি বাসের ভাড়া ১ হাজার ৫০০ টাকা। ঈদযাত্রায় দুই ধরনের বাসের টিকিটে ২০০ টাকা অতিরিক্ত রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মিজানুর রহমান অতিরিক্ত ভাড়ায় টিকিট কাটবেন বলেই জানান কাউন্টার ম্যানেজারকে। কিন্তু তাতেও টিকিট মিলছিল না। পরে এক যাত্রী যাত্রা বাতিল করায় সেই আসন ফাঁকা হয়। হুন্দাই পরিবহনের সেই বাসে রংপুর যেতে মিজানুর রহমানকে ১ হাজার ৭০০ টাকা গুনতে হলো।

মিজানুর রহমানের মতো অভিযোগ করেছেন আরও অনেক যাত্রী। দূরপথের যাত্রায় টিকিট না পেয়ে অনেক যাত্রী মহাখালী থেকে গাবতলী ও সায়েদাবাদে চলে যান। সেখানে বিলাসবহুল বাস না পেলে লোকাল বাসেই বাড়ির উদ্দেশে রওনা হবেন বলে তারা জানান। মহাখালী আন্তজেলা বাস টার্মিনাল থেকে যারা গাজীপুরের কাপাসিয়া-কালীগঞ্জ, টাঙ্গাইলের কালিহাতী, নরসিংদীর ঘোড়াশালের দিকে যাচ্ছিলেন, বাস না পেয়ে তাদের অনেকে খোলা ট্রাক ও মাইক্রোবাসের সন্ধান করছিলেন। ঈদযাত্রায় এসব পরিবহন অনিরাপদ জেনেও উপায়ান্তর না দেখে এভাবেই যেতে বাধ্য হন বলে জানান গার্মেন্টশ্রমিক রনি। 

গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়াতে পিরোজপুরগামী যাত্রী রেহানা আক্তার দোলা পরিবহনের টিকিট পাননি। পরে তিনি সাকুরা পরিবহনের টিকিট কাটেন। নন-এসি বাসে ৬০০ টাকার টিকিট টাকতে হয়েছে ৮০০ টাকায়। অনেক যাত্রী টিকিট না পেয়ে বিভিন্ন লোকাল বাসে খোঁজ নিচ্ছিলেন কত দূর যাওয়া যায়। আবুল কালাম ইলিশ পরিবহনের লোকাল বাসে বরিশাল যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘খুব বেশি বাড়তি টাকা রাখেনি এই বাসে। তবে একটাই সমস্যা, এই বাসটা কখন বরিশাল যাবে আমি জানি না। বাসটির সিটগুলো মোটেই আরামদায়ক নয়।’

কয়েকজন পরিবহনমালিক গতকাল সন্ধ্যায় ফোনে খবরের কাগজকে জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যার পরে রাজধানী থেকে বের হওয়ার প্রতিটি পয়েন্টে গাড়ির বাড়তি চাপ ছিল। উত্তরার আব্দুল্লাহপুরের সব বাস কাউন্টারে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। কল্য্যাণপুর ও শ্যামলীর সব বাস কাউন্টারে যাত্রীরা ভিড় করেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই আগে থেকে টিকিট কাটেননি।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক ও ফুলবাড়িয়া বাসমালিক সমিতির সভাপতি কাজী জুবায়ের মাসুদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাসের টিকিট যে একদমই নেই, ব্যাপারটা এমন নয়। তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে টিকিটের তো সংকট হবে। আমরা বাড়তি বাস নামিয়ে যাত্রীদের নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’ 

টিকিটের বাড়তি বাড়া আদায়ের অভিযোগে গতকাল সায়েদাবাদের ইউরোলাইন বাস কোম্পানির মালিককে বাসমালিক সমিতিতে ডেকে নেওয়া হয়। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি বাস কোম্পানির বিরুদ্ধে খোদ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকেই অভিযোগ এসেছে বলে জানান তিনি। জুবায়ের মাসুদ বলেন, ‘প্রতিটি বাস টার্মিনালে র‌্যাব, বিআরটিএ, পুলিশের ভিজিলেন্স টিম রয়েছে। তারা কড়া নজরদারি রাখছে। তারপরও এই টিমগুলো যখন কাজ করে না, তখনই বাসের টিকিটে অতিরিক্ত দাম রাখা হচ্ছে। এ অভিযোগ মিথ্যা নয়।’ 

উত্তরের পথে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থেকে যমুনা সেতু এলাকা পর্যন্ত মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। যমুনা সেতু সাইট অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবীর পাভেল বলেন, মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়লেও নেই যানজট। যানজট নিরসনে যমুনা সেতু পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশে ৯টি করে ১৮টি টোল বুথ স্থাপন করা হয়েছে। মোটরসাইকেলের জন্য ৪টি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। 
হাটিকুমরুল হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রউফ বলেন, এবার ঈদে মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়লেও দুর্ভোগের কোনো শঙ্কা নেই। তা ছাড়া যানজট নিরসনে ছয় শতাধিক জেলা পুলিশ, ১০০ হাইওয়ে ও অর্ধশত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) তিন শিফটে দায়িত্ব পালন করবে।

এদিকে রাজধানীর কমলাপুরে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে বেড়েছে যাত্রীর চাপ। আজ বুধবার সকাল থেকে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যাবে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক সাজেদুল ইসলাম। তিনি গতকাল খবরের কাগজকে বলেন, ‘আজ (মঙ্গলবার) কোনো আন্তনগর ট্রেন খুব বেশি দেরি করে ছাড়েনি। এতে যাত্রীরাও স্বস্তিতে ছিলেন। আশা করি, আমরা শিডিউল ধরে রাখতে পারব।’ 

যারা ঈদ শেষে আবার ট্রেনেই ফিরতি টিকিট কেটেছেন এমন কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা হয় স্টেশনে। তাদের একজন অমিয় দত্ত ভৌমিক বলেন, ‘আমি আগামী ১৩ জুন ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় ফিরব বলে রেলসেবা অ্যাপে লগ-ইন করি সকালে। নিয়ম অনুযায়ী আমাকে চারটা টিকিট দেবে। কিন্তু লগ-ইন করার পরেই বলছে, আমার আইডি থেকে আজ কোনো টিকিট কাটা যাবে না। আমি টিকিট কেনার সীমা অতিক্রম করেছি। তার মানে, আমার আইডি থেকে কেউ টিকিট কেটেছেন। আমার ধারণা, এটি রেলওয়ে ও সহজ ডটকমের অসাধু কর্মকর্তাদেরই কারসাজি।’

ইতোমধ্যে দুদক কর্মকর্তারা রেলওয়ে ও সহজ ডটকমের সার্ভার রুমে গিয়ে টিকিট কালোবাজারির বিষয়ে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন। এ বিষয়ে রেলওয়ের সব কর্মকর্তা মুখে কুলুপ এঁটেছেন।

ঈদুল আজহা রাজধানীর রাস্তা রক্তপানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০৯:০৬ এএম
রাজধানীর রাস্তা রক্তপানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা
২০২৩ সালে ঈদুল আজহার দিন মালিবাগ প্রথম লেনের চিত্র (ছবি-১0, চলতি বর্ষায় রাজধানীর জলাবদ্ধতা (ছবি ২)

পুরো গলি যেন রক্তের নালা! গলির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত- পুরোটাই রক্তমিশ্রিত পানিতে ডোবা। এর মাঝে ক্ষণে ক্ষণে রিকশা ছুটছে দুই পাশে মানুষের গা ভিজিয়ে দিয়ে। ঈদের দিনে এই নিয়ে এখানে-ওখানে ঝগড়া, বাগবিতণ্ডা।

রাজধানীর মালিবাগ এলাকার মানুষজন ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যমের গ্রুপে কয়েক দিন ধরে এমন ছবি/ভিডিও শেয়ার করছেন। বিগত ২০২৩ এবং ২০১৬ সালের এসব ছবি/ভিডিও এখন শেয়ার করার প্রেক্ষাপট হচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের একটি তথ্য। অধিদপ্তর বলছে, আসন্ন ঈদুল আজহার দিন আগামী শনিবার রাজধানীতে বৃষ্টি হতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানা জানিয়েছেন, আগামী ৭ জুন শনিবার সকাল ৯টা থেকে ঢাকাসহ দেশের সব বিভাগেই অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বিদ্যুৎ চমকানো এবং হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। 

এদিকে গত বৃহস্পতিবার ভোর থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত একটানা অতিভারী বৃষ্টিতে ঢাকা মহানগরী প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। মালিবাগ, নিউ মার্কেট, মৌচাক, ধানমন্ডি-২৭, রাজাবাজার, মগবাজার, শান্তিনগর, বাসাবো, মিরপুর ও বিমানবন্দর সড়কসহ প্রধান সড়ক ও গলিগুলোতে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি জমে। এতে জনদুর্ভোগ পৌঁছায় চরমে। তুলনামূলক নিচু এলাকার দোকানপাট, বাসাবাড়ি ও মার্কেটে পানি ঢুকে পড়ে। রাজধানীর কোনো কোনো জায়গায় সড়কে নৌকা চলতে দেখা যায়। ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট ও চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের সামনেও পানি জমে।

ওই দিনের ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরে রাজধানীর মালিবাগ প্রথম লেনের ব্যবসায়ী খলিল উল্লাহ বলেন, এখানে তো বৃষ্টি লাগে না। দুপুরের পর এমনিতেই রাস্তা পানিতে ডুবে যায়। কারণ এখানকার সব ড্রেন জ্যাম হয়ে আছে। পানি সরে না। সকাল বেলায় বাসাবাড়িতে রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া ও গোসলের চাপ থাকে। সেই পানি সরতে না পেরে ম্যানহোল উপচে দুপুরের দিকে রাস্তা ডুবে যায়। এবার নাকি ঈদের দিনও বৃষ্টি হবে। তাহলে তো ২০২৩ এবং ২০১৬ সালের মতো রক্তপানিতে ডুবে যাবে রাস্তা। পরে পানি শুকিয়ে গেলেও রাস্তায় এসব রক্ত থেকে যাবে। আর বিশ্রী গন্ধের পাশাপাশি রোগজীবাণু ছড়াবে।

নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী আবুল খায়ের বলেন, সামান্য বৃষ্টিতেই নিউ মার্কেট এলাকা তলিয়ে যায়। সিটি করপোরেশনের তো এই নিয়ে ভাবারই সময় নেই।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. মাহাবুবুর রহমান তালুকদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘বৃষ্টিপাতের কারণে ঈদের জামাত যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য জাতীয় ঈদগাহে শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। আর কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা আছে আমাদের। প্রতিটি ওয়ার্ডে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের লোকবল থাকবেন, ক্লিনার থাকবেন। বৃষ্টি হলে যেন পানি জমতে না পারে, সে জন্য নিউ মার্কেট ও হকার্স মার্কেট এলাকায় পাম্প থাকবে। ৩-৪ ইঞ্চি পানি জমলেই তা নিষ্কাশন করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার বৃষ্টি হয়ে এক প্রকার ভালোই হয়েছে। কারণ এতে আমরা সমস্যার প্রকটতা অনুমান করতে পেরেছি এবং ঈদকে সামনে রেখে প্রস্তুতি নিতে পেরেছি।’

এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে মালিবাগের একটি উদাহরণ তুলে ধরা হয় এই কর্মকর্তার সামনে। সেখানকার সামাজিক সংগঠন ‘মালিবাগ ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ প্রায় দেড় মাস আগে গত ২১ এপ্রিল সিটি করপোরেশনের প্রশাসককে সমস্যার বিশদ (চিঠি নম্বর ১৮৬৭) তুলে ধরে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

হাটে হাটে ঢুকছে কোরবানির পশু, রাজধানীতে কেনাবেচা শুরু

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০৭:৩০ এএম
হাটে হাটে ঢুকছে কোরবানির পশু, রাজধানীতে কেনাবেচা শুরু
রাজধানীর অস্থায়ী পশুর হাটগুলোতে গরু আসতে শুরু করেছে। ছবিটি ধোলাইখাল থেকে তোলা। ছবি: ইন্দ্রজিৎ কুমার ঘোষ

পবিত্র ঈদুল আজহা আগামী ৭ জুন উদযাপিত হবে। এরই মধ্যে রাজধানীর গাবতলীর পশুর হাটে ট্রাক বোঝাই করে আসতে শুরু করেছে গরু, ছাগল, মহিষ তথা কোরবানির পশু। গত সোমবার রাত থেকেই গাবতলীর হাটে ট্রাক বোঝাই করে প্রচুর কোরবানির পশু আনা হয়েছে। এক রাতেই এই হাটে প্রায় ৫০ হাজারের মতো পশু আনা হয়েছে। আজকের মধ্যে তা ১ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন হাট-সংশ্লিষ্টরা। কেবল গাবতলী নয়, রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের পশুর হাটসহ অন্যগুলোতেও প্রায় অভিন্ন চিত্র।

মঙ্গলবার (৩ জুন) দুপুরে গাবতলী হাটে গিয়ে দেখা গেছে, পশু বিক্রির জন্য প্রস্তুত রাজধানীর একমাত্র স্থায়ী পশুর হাট গাবতলী। সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা-দর্শনার্থীর আনাগোনা বেড়েছে। কোরবানির পশুর দাম কিছুটা কম বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। তবে অনেক বিক্রেতা শেষ দিকের বিক্রিতে বেশি লাভের আশাবাদী।

ওই হাট ঘুরে দেখা যায়, প্রধান ফটকসহ হাটের ভেতরেও সাজসজ্জা করা হয়েছে। এবার হাটের আয়তন ৫৪ বিঘা বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। বৃষ্টির জন্য টানানো হয়েছে প্যান্ডেল। গরম কমাতে ঝোলানো হয়েছে সিলিং ফ্যান। হাটের অভ্যন্তরে কাদা-পানি ঠেকাতে ফেলা হচ্ছিল বস্তা বস্তা বালি। অনেক স্থানে গরু বাঁধার জন্য বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে শেড তৈরি করা হয়েছে। বসানো হয়েছে ৮ থেকে ৯টি হাসিল ঘর। সেখানে পশুর চিকিৎসার জন্য রয়েছে ১০ থেকে ১১ সদস্যবিশিষ্ট দুটি মেডিকেল টিম। গাবতলীর হাট ও প্রধান সড়কে দেখা গেছে সেনাবাহিনীর টহল। হাটে রয়েছে র‌্যাব-৪-এর কন্ট্রোল রুম ও পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আছে র‌্যাবের ওয়াচ টাওয়ার ও জাল টাকা শনাক্তের মেশিন। পাশাপাশি আছে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি।

এই হাটে দেশি গরুর পাশাপাশি রয়েছে ভারত, নেপাল ও মায়ানমারের গরু। মহিষ, ষাঁড়, উট, দুম্বাও সেখানে দেখা গেছে। কোরবানির পশু সাজাতে বিক্রি হচ্ছিল বাহারি রঙের কাগজের মালা। এ ছাড়া জবাইয়ের ও মাংস বানানোর কাজে ব্যবহৃত চাপাতি-ছুরিসহ প্রায় সব সরঞ্জাম পাওয়া যাচ্ছে এই হাটে।

অপরদিকে মঙ্গলবার বিকেলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে নাবিস্কোর পাশের প্রশস্ত সড়কে বসানো হাটেও মঙ্গলবার জমজমাট চিত্র দেখা যায়। প্রধান সড়কের মুখেই হাটের গেট সাজানো। বিভিন্ন পয়েন্টে মাইক স্থাপন করা হয়েছে। কন্ট্রোল রুম থেকে হাটের চিত্র দেখে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্টরা। ওই হাট ঘিরেও ছিল বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। গাবতলী ও তেজগাঁওয়ের এই হাট ছাড়াও রাজধানীর প্রায় সব হাটেই মঙ্গলবার ট্রাক বোঝাই করে প্রচুর কোরবানির পশু ঢাকায় আসে। আজ বুধবারের মধ্যে সেই সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলে মনে করছেন হাট-সংশ্লিষ্টরা।

হাট-সংশ্লিষ্টরা জানান, পশুর হাটে ক্রেতার উপস্থিতি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ব্যবসায়ী ও হাটের ইজারাদাররা বলেছেন, ঈদের তিন দিন আগে থেকে পশু বিক্রির ধুম পড়বে। তখন ভিড়ে পা ফেলার জায়গা থাকবে না রাজধানীর সবচেয়ে বড় এই পশুর হাটে।

গত সোমবার রাতে গাজীপুর থেকে ৩৭টি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন আব্দুল খালেক। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘পশু বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত তিনটি গরু বিক্রি করেছি। এখন দাম কম থাকলেও ঈদের তিন দিন আগে থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী দাম পাব বলে আশা রাখছি।’

কুষ্টিয়া থেকে বেশ কয়েকটি গরু নিয়ে এই হাটে এসেছেন রিপন ইসলাম। তিনি জানান, গত সোমবার রাতে লালুসহ বেশ কয়েকটি গুরু নিয়ে হাটে এসেছেন। ক্রেতারা আসছেন, দাম বলছেন, চলেও যাচ্ছেন। কেনাবেচা শুরু হলেও তিনি শেষ সময়ের অপেক্ষায় আছেন বলে জানান।

এই হাট থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় একটি দেশি গরু কিনে বাড়ি ফিরছিলেন ইরফান। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘হাটে এখনো ঠাসা ভিড় হয়নি, এ ছাড়া দাম ও বাজেট অনুযায়ী পশু মেলানো যাচ্ছে। তাই একটু আগেই কিনে ফেললাম।’

এবার গাবতলী পশুর হাটের ইজারা পেয়েছে এরফান ট্রেডার্স। হাসিল ঘরের দায়িত্বে থাকা ইয়াহিয়া সামি খবরের কাগজকে বলেন, ‘হাট দেখভালে দেড় হাজার স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। তারা হাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সার্বিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। হাসিল লাখে ৫ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আজ (কাল মঙ্গলবার পর্যন্ত) ৫০ হাজারের বেশি কোরবানির পশু এলেও কাল (আজ বুধবার) তা ১ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।’

পশুর চিকিৎসা ও ক্রেতা-বিক্রেতার পশু সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবার পরামর্শ দিতে অবস্থান করছিল দুটি মেডিকেল টিম। এ বিষয়ে মহাখালী প্রাণিসম্পাদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. কাজী আলমগীর হোসেন (এফএমডি ভ্যাকসিন উৎপাদন অনুবিভাগ) খবরের কাগজকে বলেন, পশুর স্বাস্থ্যসেবায় দুটি মেডিকেল টিম কাজ করছে। গরমে পশুর হিট স্ট্রোক ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বেশি হয়। এই সংক্রান্ত সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও ক্রেতা-বিক্রেতার পশু স্বাস্থ্যসংক্রাস্ত যেকোনো পরামর্শের জন্য আমাদের দুয়ার খোলা।

এদিকে রাজধানীর গাবতলীতে পশুর হাটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা-সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গলবার র‍্যাব-৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মাহবুব আলম বলেন, পশুর হাটে চাঁদাবাজি ও এক হাটের পশু অন্য হাটে নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হাটে আভিযানিক দল নিয়োগ, গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া ছিনতাইকারী, মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টিসহ পেশাদার অপরাধীদের প্রতিরোধে কাজ করছে র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।