অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন, অর্থ পাচার, এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে ফেঁসে যেতে পারেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও তার দুই ভাইসহ পরিবারের সদস্যরা। ইতোমধ্যে আজিজ আহমেদ ছাড়াও তার দুই ভাই হারিছ আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ জোসেফ এবং তাদের স্ত্রীদের এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতির তথ্য চেয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অভিযোগ আছে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে হারিছ ও জোসেফের এনআইডি ও পাসপোর্ট তৈরিতে আজিজ আহমেদ প্রভাব বিস্তার করেছেন। দুদকের কাছে এটা প্রতীয়মান হওয়ায় নির্বাচন কমিশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর এ বিষয়ে তদন্তে নেমেছে।
এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন- কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে সরকার তাকে প্রশ্রয় দেবে না। যিনি সেনাপ্রধান তিনিও যদি অপরাধী হন, তার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুদকের বাধা নেই। অপরাধের জন্য শাস্তি পেতেই হবে।
আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতি তদন্ত করতে নির্বাচন কমিশন এবং পাসপোর্ট অধিদপ্তর পৃথক দুটি টিম গঠন করেছে। এদিকে আজিজ আহমেদ, তার দুই ভাই ও তাদের পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহে ১০ দিন ধরে মাঠে কাজ করছেন দুদকের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটের সদস্যরা। তারা গোপনে ঢাকা, চাঁদপুরের সদর, মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গোপনে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন।
গোয়েন্দা সদস্যরা মূলত জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ সম্পদ, আর্থিক দুর্নীতির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন। এ বিষয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের একজন পরিচালকের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের গোয়েন্দা টিম কাজ করছে।
এ ছাড়া আজিজ আহমেদ ও তার ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির অভিযোগ দুদকের তফসিলভুক্ত ও আমলযোগ্য কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটি (যাবাক) চলতি সপ্তাহে কমিশনে মতামত পেশ করতে পারে বলে জানা গেছে।
সোমবার (১০ জুন) দুর্নীতিবিরোধী সাংবাদিকদের সংগঠন রিপোর্টার্স এগেইনস্ট করাপশনের (র্যাক) সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আব্দুল্লাহ বলেন, ‘সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ এবং তার ভাইদের এনআইডি ও ই-পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে তথ্য চেয়ে নির্বাচন কমিশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখানে ভাইদের অপরাধের দায় আজিজ আহমেদের ওপর বর্তায় না। যার যার অপরাধ পাওয়া যাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য এলে পরবর্তী প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে।’
নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘কেউ ঘুষ নিয়ে সাবেক সেনাপ্রধানের পরিবারের সদস্যদের এনআইডি তৈরি করেছেন কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হবে। হয়তো কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে এই অপরাধ করার সুযোগটা তিনি পেয়েছেন। কিন্তু তিনি যে নির্মোহ ব্যক্তি, আমরা তো সেটা বলছি না। কোনো সাফাই করছি না। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে।’
আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো তফসিলভুক্ত ও আমলযোগ্য কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে দুদকের যাচাই-বাছাই কমিটি (যাবাক)। বিশেষ করে আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আসা প্রতিবেদন এবং একজন আইনজীবীর দেওয়া অভিযাগপত্রের তথ্য-উপাত্ত খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যাবাকের সুপারিশ ও গোয়েন্দা টিমের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন।
দুদকের কর্মকর্তারা খবরের কাগজকে জানান, সাধারণত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগের অনুসন্ধান শুরুর আগে দুদকের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটের মাধ্যমে গোপনে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য-উপাত্ত ও যাবাকের সুপারিশের ভিত্তিতে কমিশন অনুসন্ধান শুরু করার নির্দেশ দিয়ে থাকে। কমিশন অনুমোদন দিলে অনুসন্ধানের জন্য পৃথক কমিটি গঠন করা হয় এবং সেই কমিটি প্রকাশ্যে অনুসন্ধান শুরু করে। প্রকাশ্যে অনুসন্ধানই মূলত দুদকের মূল অনুসন্ধান। আজিজ আহমেদের ক্ষেত্রে তেমনটাই হচ্ছে। ইতোমধ্যে কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা সদস্যরা গোপনে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। এ ধরনের তথ্য সংগ্রহের জন্য সাধারণত মাসখানেক সময় পাওয়া যেত। কিন্তু এবার ১৫ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আগামী ১৫ জুনের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও অভিযোগ যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করার তাগিদ রয়েছে।
জালিয়াতি তদন্তে ইসি ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কমিটি গঠন: গতকাল ইসি সচিবালয়ের সচিব শফিউল আজিম সাংবাদিকদের জানান, আজিজ আহমেদ ও তার দুই ভাইসহ সংশ্লিষ্টদের এনআইডি তৈরিতে জালিয়াতির বিষয়ে তদন্ত করতে একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে তথ্য চেয়ে দুদক থেকেও একটি চিঠি এসেছে। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে দুদকে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।
যেসব জালিয়াতি:
আজিজ আহমেদের দুই ভাই হারিছ আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) নিজেদের নামের পাশাপাশি মা-বাবার নাম পাল্টে এনআইডি সংগ্রহ করেন। জোসেফ নিয়েছেন দুটি এনআইডি। একটি তানভীর আহমেদ তানজীল নামে, আরেকটি আসল নামে।
হারিছ আহমেদ এনআইডি নেন মোহাম্মদ হাসান নামে। মোহাম্মদ হাসান নামে করা এনআইডিতে হারিছ নিজের ছবি পরিবর্তন করেন ২০১৯ সালে। ছবি বদলানোর জন্য সুপারিশ করেছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।
আইন অনুযায়ী, মিথ্যা তথ্য দিয়ে এনআইডি করা এবং একাধিক এনআইডি করা- দুটিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাদের স্ত্রীরাও একইভাবে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। সেনাপ্রধান থাকার সময়েই আজিজ আহমেদের ভাইদের ভুয়া তথ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করানোর ক্ষেত্রে তার প্রভাব খাটানো হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
২০১৮-এর জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর সেনাপ্রধান ছিলেন আজিজ আহমেদ। ২০১২ সাল থেকে চার বছর সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সেনাপ্রধান থাকাকালে তার বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আল-জাজিরায় ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামে দুর্নীতিসংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে।
এদিকে অবসরের পর গত ২০ মে ‘তাৎপর্যপূর্ণ দুর্নীতি’তে জড়িত থাকার অভিযোগে আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
আজিজ আহমেদের ভাই হারিছ দুটি এবং আরেক ভাই আনিস একটি খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ তাদের সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ১৯৯৬ সালে মোহাম্মদপুরের ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান হত্যা মামলার আসামি ছিলেন জোসেফ। এ মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। এই রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট। পরে আপিল বিভাগ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। ২০১৮ সালে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পান।
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল আজিজ ও তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ ও অর্থ পাচারের অভিযোগের তদন্ত চেয়ে গত ২৯ মে দুদকে লিখিত অভিযোগ করেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী।
আবেদনে বলা হয়, দুর্নীতির অভিযোগে জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি এবং তার দুর্নীতি নিয়ে জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনেও দেশের সেনাবাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। দেশের সেনাবাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির তদন্ত সাপেক্ষে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। দুদক এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা না নিলে প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হবে।