
‘ময়মনসিংহের কলমাকান্দা সীমান্ত এলাকা থেকে আমরা মাল হাতে পাই। সেখানে স্থানীয়রা ভারত থেকে চিনি এনে তাদের গোডাউনে রাখেন। তারপর আমরা গোডাউন থেকে মাল নিয়ে যার যার গন্তব্যে রওনা হই। রাস্তায় কোথাও কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। আর সিলেট সীমান্ত এলাকা থেকেও আসে। টাঙ্গাইলের অংশে বেশি চিনি আসে ময়মনসিংহ জেলার ধুবরিয়া সীমান্ত দিয়ে। এই চিনি বর্ডার পার হয় বাংলাদেশ ও ভারতীয় দালাল চক্রের লাইনম্যানের মাধ্যমে।’ চিনি চোরাচালানের এসব তথ্য দিচ্ছিলেন কালিহাতী উপজেলার দুদু মিয়া।
দুদু মিয়া আরও বলেন, ধুবরিয়া বাজারে গোডাউন আছে ময়মনসিংহ শহরের চিত্র বাবু নামে এক লোকের। তিনি মূলত সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন কলমাকান্দা সীমান্ত এলাকায়। এই চিত্র বাবুকে প্রতি বস্তা চিনিতে ১০০ করে চাঁদা দিয়ে নিয়ে আসতে হয়। এই চিত্র বাবু প্রশাসন ম্যানেজ করেন। তাকে লাইনম্যান বললে সবাই চিনে। ময়মনসিংহে চিত্র বাবুকে লাইনবিল দিয়ে এলে সব কিছু সমাধান, ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত এসেছি কোনো বাধার মুখে পড়িনি। তবে আমরা শ্রমিক হিসেবে জনপ্রতি ২ হাজার টাকা পাই। আসলে ভারতীয় চিনি আসলে চিনির দাম কমে যাবে এ জন্য সীমান্ত এলাকায় দায়িত্বরত সরকারি কর্মকর্তারা তেমন বাধার সৃষ্টি করে না।
দুদু আরও বলেন, সপ্তাহে প্রায় ৭ থেকে ৯ ট্রাক চিনি টাঙ্গাইলে ঢোকে। আর বেশি চিনি ঢোকে ভালুকার দিকে। মাঝে মাঝে ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে চিনি আসা বন্ধও থাকে। তখন আধা বস্তা করে এনে সাপ্লাই দেই। এই অংশের মালিকের সঙ্গে সীমান্ত এলাকার মালিকের ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হয়। ভারতীয় চিনির বস্তা বদলিয়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা করে তীর চিনি বা ফ্রেস চিনির খালি বস্তা ক্রয় করে বাজার জাত করা হয়। প্রতি বস্তা চিনিতে প্রায় ২০০-৩০০ টাকা লাভ থাকে বাজারে আনার পর। ৫০ কেজির বস্তায় খুচরা বাজারে ২০০ টাকার উপরে লাভ থাকে। টাঙ্গাইলে বেশি মালামাল আসে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও নেত্রকোনার দুর্গাপুর সীমান্ত দিয়ে।
জানা গেছে, টাঙ্গাইলের ভারতীয় চিনির মূল হোতা টাঙ্গাইল শহরের কাগমারি এলাকার উজ্জল, ফরহাদ, সাখাওয়াত, দুলাল সাহাসহ বেশ কিছু ব্যবসায়ী।
টাঙ্গাইলের ছয়আনী বাজার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আছুরুদ্দিন আছুর ছত্রছায়ায় এ চিনির ব্যবসা চলছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।
টাঙ্গাইল পুলিশের অভিযানে একবার এক ট্রাক চিনি জব্দ করা হয়। এ ছাড়া গণমাধ্যম কর্মীদের সহায়তায় ২ ট্রাক চিনি জব্দ করে প্রশাসন। তারপরও টাঙ্গাইলে অহরহ চিনি ঢুকছে।
টাঙ্গাইল জেলা সেচ্ছাসেবক লীগ নেতা স্বাধীনের নেতৃত্বে টাঙ্গাইল ছয়আনী পুকুর পারে গোডাউনে ভারতীয় চিনি নামে ভোরে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় প্রায় ৪ শত বস্তা চিনি একটি ট্রাকে লোড করা। পরে ট্রাক থেকে নামিয়ে ভ্যানে বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যান শ্রমিকরা। সংবাদমাধ্যম কর্মীদের দেখে ম্যানেজ করার চেষ্টাও করেন এই নেতা।
এই সেচ্ছাসেবক লীগ নেতা স্বাধীন বলেন, বিষয়টি সবাই জানে। আপনি যদি কিছু করতে পারেন করেন, সমস্যা নাই। আসছেন চা খান। টাকা নিয়ে চলে যান।
টাঙ্গাইল ছয়আনী বাজারে সাখাওয়াত স্টোরের মালিক সাখাওয়াত হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, বাজারে সবাই ভারতীয় চিনি বিক্রি করে, তাদের ধরেন। আপনি কেন আমাকে ধরতে আসছেন। আমি সব ম্যানেজ করেই চিনি বাজারে নিয়ে আসি। আমার কোনো সমস্যা নাই। আপনার মতো সব সাংবাদিক ম্যানেজ করা আছে। কিছুই হবে না। আপনাকেও মাসোয়ারা দিব, চলে যান।
অপর চিনি ব্যবসায়ী দুলাল সাহা বলেন, আপনারা অযথা ব্যবসায় ডিস্টার্ব করেন। আমরা তো প্রশাসন ম্যানেজ করেই এই ব্যবসা করছি। তাদের তো কোনো সমস্যা হয় না, তা হলে আপনাদের সমস্যা কী।
টাঙ্গাইলে ভারতীয় চিনির মূল হোতা উজ্জল বলেন, সীমান্ত এলাকা থেকে সব কিছু ম্যানেজ করে আমরা এই টাঙ্গাইল পর্যন্ত চিনি নিয়ে আসি। এই কয় বছর কোনো সমস্যা হয়নি, হঠাৎ আপনারা সমস্যা সৃষ্টি করছেন। কখনো এই ধরনের সমস্যা হয়নি। যে সীমান্ত দিয়ে চিনি নিয়ে আসি সেখানকার সাংবাদিকও ম্যানেজ করা। আপনারাও আমাদের ব্যবসায়ীক পার্টনার হয়ে যান তা হলে দেখবেন সব কিছু সমাধান হয়ে যাবে। এই নিউজ করে কী করবেন, সরকার যেখানে বাঁধা দিচ্ছে না আপনারা অযথা নিউজ করবেন। আপনারা জানেন না যে এই চিনি দেশে আসায় কতটা চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই চিনি না আসলে দেশের বাজারে দাম বেড়ে যেত।
টাঙ্গাইল ছয়আনী বাজারের বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আছিরুদ্দিন আছু মিয়া বলেন, আপনারা সাংবাদিকরা অযথা এই চিনির পেছনে দৌড় পারতাছেন। আপনারা কিছুই করতে পারবেন না। বেশি বুঝলে পুলিশ ডেকে এনে ধরিয়ে দিব। বিশ হাজার টাকা দিচ্ছি, নিয়ে যান ভালোভাবে ঈদ উদযাপন করেন।
গত ৬ এপ্রিল টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার শুলাকুড়া এলাকা থেকে ৪৩০ বস্তা ভারতীয় চিনি জব্দ ও ৭ জনকে আটক করে কালিহাতী থানা-পুলিশ।
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার খবরের কাগজকে বলেন, কোনো প্রকার অবৈধ চিনি টাঙ্গাইলে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুবই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এই ভারতীয় চিনির সঙ্গে যারাই রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।