
চোরাই চিনির বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের প্রভাব পড়েছে খাতুনগঞ্জে। ১০ দিনের ব্যবধানে খাতুনগঞ্জে চোরাই চিনিতে মণপ্রতি দাম কমেছে ৩২০ টাকা। ফলে নতুন করে চোরাই চিনির চালান আনতে আগ্রহ হারিয়েছেন অনেকেই। চোরাই চিনির বিরুদ্ধে সীমান্তের পাশাপাশি চট্টগ্রামের বৃহত্তর ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জেও চলছে একের পর এক অভিযান। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাহিদা বাড়ায় কয়েক মাস ধরে চোরাই চিনিতে সয়লাব হয়ে ওঠে খাতুনগঞ্জ। অতি মুনাফার লোভে খাতুনগঞ্জ ও পাহাড়তলী বাজারে চোরাই চিনি মজুত করেছেন অনেক ব্যবসায়ী। আলু ও পেঁয়াজ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কাঠ ব্যবসায়ী সবাই জড়িয়েছেন চোরাই চিনির কারবারে। খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বেশির ভাগ চিনি সংগ্রহ করেন সিলেট অঞ্চল থেকে।
এসব চিনি আনতে প্রতি ট্রাকে ব্যয় করতে হচ্ছে ৩৬ হাজার টাকা। পরিবহন ভাড়া যোগ করে গত ৩ জুন খাতুনগঞ্জে চোরাই পথে আসা চিনি প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) বিক্রি হয় ৪ হাজার ২০০ টাকায়। অর্থাৎ সে সময় প্রতি কেজি চিনি পাইকারি এই বাজারে বিক্রি হয়েছিল ১১৫ টাকায়। আর দেশীয় প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত চিনি বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ৯০০ টাকায়, যা কেজিপ্রতি দাম পড়ে ১৩২ টাকা।
বর্তমানে প্রশাসনের অভিযান তৎপরতার কারণে দ্রুত চোরাই চিনি বিক্রি করে দিতে দাম কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে খাতুনগঞ্জে প্রতি মণ চোরাই চিনি ৩ হাজার ৮৮১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে প্রতি কেজি চোরাই চিনি বিক্রি হচ্ছে ১০৪ টাকায়। অন্যদিকে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পরিশোধিত চিনি মণপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৪০৪ টাকায়। সে হিসাবে পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি পরিশোধিত চিনির দাম পড়ছে ১১৮ টাকা।
খাতুনগঞ্জের চিনি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সীমান্তে চিনি ধরা পড়ছে। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে খাতুনগঞ্জে। কম দামে পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা কিনে রেখেছিলেন চোরাই চিনি। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন দপ্তর তৎপর হয়ে ওঠায় খাতুনগঞ্জে কমতে শুরু করেছে চোরাই চিনির দাম। পাশাপাশি সরবরাহ বাড়ায় খাতুনগঞ্জে পরিশোধিত চিনি পাওয়া যাচ্ছে আগের তুলনায় কম দরে। শুধু তাই নয়, ব্যবসায়ীরা আরও জানিয়েছেন, খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা এখন চোরাই চিনি কেনার প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিশোধন করা চিনির ওপর নির্ভর করতে হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাতুনগঞ্জের এক চিনি ব্যবসায়ী খবরের কাগজকে বলেন, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা চোরাই চিনিতে আর আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বিশেষ করে সিলেটে ১৪ ট্রাক চোরাই চিনির চালান ধরা পড়ার পর চিনির দাম কমতে শুরু করে। খাতুনগঞ্জে এখন প্রতিনিয়ত অভিযান চলছে। তাই ব্যবসায়ীরা এখন দাম কমিয়ে দ্রুত এসব চিনি বিক্রি করে দিতে চাইছেন।
খাতুনগঞ্জের চিনি ব্যবসায়ী মো. শহীদুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, খাতুনগঞ্জে এখনো পরিশোধিত চিনির পাশাপাশি চোরাই পথে আসা চিনি রয়েছে। তবে সিলেটে চোরাই পথে আসা ১৪ ট্রাক চিনির চালান পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর সবাই সতর্ক হয়ে যান। এরপর থেকেই খাতুনগঞ্জে চোরাই পথে আসা চিনির দাম কমতে থাকে।
খাতুনগঞ্জ সুগার ডিলার সমিতির সদস্য কামাল উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভারত থেকে চিনি আসার কারণে মিলগুলোতে পরিশুদ্ধ চিনির উৎপাদন এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছিল। বর্তমানে চিনির দাম কমতির দিকে। চোরাই চিনি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের মিলগুলোর কার্যক্রমে গতি আসবে। তবে চিনির বেচা-বিক্রিও কমে গেছে। আগে দিনে চোরাই চিনি ৫০ বস্তা বিক্রি হলে এখন ২০ বস্তা বিক্রি হচ্ছে।’
তবে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, এখন চোরাই চিনির চালান ধরা পড়ছে। এরপর থেকে দাম কমতে শুরু করে। তবে খাতুনগঞ্জে এখন চিনির সরবরাহ বেশ ভালো। আমি মনে করি, সরবরাহ ভালো থাকার কারণে চিনির দাম কমে গেছে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার কারণে চোরাই চিনির চালান ধরা পড়ছে। এভাবে চিনি আসতে থাকলে একদিকে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার শুল্ক হারাত, অন্যদিকে আমাদের দেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ত। তাই এভাবে চোরাই চিনির চালান যাতে ভবিষ্যতে আসতে না পারে, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সে বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে বলে আমি মনে করি।’
এর আগে গত ৩ জুন চোরাই চিনির চালানসংক্রান্ত ভিডিও (অনলাইন সংস্করণে) ও ৪ জুন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক খবরের কাগজ। সংবাদ প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গত ৬ জুন সকাল ৬টার দিকে সিলেটের জালালাবাদ থানা এলাকায় উমাইরগাঁওয়ে অস্থায়ী চেকপোস্ট বসিয়ে ১৪ ট্রাক ভারতীয় চিনি জব্দ করে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ। গত ৫ জুন সন্ধ্যায় সিলেটে শাহপরাণ (রহ.) থানা-পুলিশের অভিযানে একটি ট্রাকসহ ১৩ হাজার ৭২০ কেজি ভারতীয় চিনি জব্দ ও একজনকে আটক করা হয়।