ঢাকা ২৪ কার্তিক ১৪৩১, শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪

দিনে মিলন খান, রাতে ‘চিনি খান’!

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৪, ১২:৫৫ পিএম
আপডেট: ১৩ জুন ২০২৪, ০১:০৩ পিএম
দিনে মিলন খান, রাতে ‘চিনি খান’!
বোগলাবাজার ইউপি চেয়ারম্যান মিলন খান ও ধনপুর ইউপি চেয়ারম্যান মিলন খান

সুনামগঞ্জের বোগলাবাজার ও ধনপুর ইউনিয়ন পরিষদের দুই চেয়ারম্যানেরই নাম মিলন খান। শুধু চেহারা ও শারীরিক গঠন ছাড়া আর আনুষঙ্গিক সব বিষয়ে তাদের মিল রয়েছে। দুজনই প্রবাসফেরত। ২০২১ সালে উভয়ই প্রথমবার ভোটে জিতে চেয়ারম্যান হন। বর্ডার হাট ও গরুর হাটের ব্যবসার সঙ্গে দুজনই জড়িত। তবে তাদের একটি গোপন পরিচয় রয়েছে। দুজনই সীমান্ত পেরিয়ে আসা চোরাই চিনির কারবারে ভাগ বসিয়েছেন। একই নামের দুজনকেই নিজ নিজ এলাকার বাসিন্দারা আড়ালে ‘চিনি খান’ বলে ডাকেন। ভারতের মেঘালয় রাজ্যঘেঁষা সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার ও বিশ্বম্ভরপুরের সীমান্তবর্তী এই দুই ইউনিয়নে দুটি বর্ডার হাট রয়েছে। বর্ডার হাট বসার সূত্র ধরে চোরাচালান বিস্তৃত হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। দুটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের হিসাবে গত বছরের অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চার মাসে সীমান্ত পথ দিয়ে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার চিনি চোরাচালান হয়েছে। তখন ছিল চিনি চোরাচালানের পিক টাইম। ঘটনাস্থল ঘুরে সিলেট ব্যুরোপ্রধান উজ্জ্বল মেহেদীর বিশেষ রিপোর্ট

মিলন খান। এক নামের দুই ইউপি চেয়ারম্যান। এক মিলন সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বোগলাবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, আরেকজন বিশ্বম্ভরপুরের ধনপুর ইউপির। নামের মতো তাদের ইউনিয়নের ভৌগোলিক অবস্থানেও মিল রয়েছে। দুটি ইউনিয়ন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী। ওপারে মেঘালয় রাজ্যের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে পড়েছে বোগলা-ধনপুর। দুজনের নামের মিল কাকতালীয় হলেও তাদের কাজেও অনেক মিল। এসব মিলমিশের সর্বশেষ নজির হচ্ছে, দুজনের বিরুদ্ধে রয়েছে একই অভিযোগ। সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট সীমান্তপথে চিনির চোরাচালানে মিলন খান নামের এ দুই ইউপি চেয়ারম্যানের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

দুজনই প্রবাসফেরত। ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার আগে ধনপুরের মিলন খান আফ্রিকাপ্রবাসী ছিলেন। আর বোগলাবাজার ইউপি চেয়ারম্যান মিলন খান ছিলেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী। ২০২১ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়ে ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন দুজন। নিজ ইউনিয়নে উভয়েরই গরুর হাটের ব্যবসা আছে। বর্ডার হাট পরিচালনায়ও সম্পৃক্ত দুজন। সেখানেও রয়েছে দুজনের একচ্ছত্র আধিপত্য।

দুই মিলন একই রাজনৈতিক আদর্শের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য পদে আছেন বোগলার মিলন। ধনপুরের মিলন দলীয় কোনো পদে নেই। দুজনই পরিচয় দেন তারা সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল হুদা মুকুটের ‘লোক’।

অভিযোগ রয়েছে, দুই মিলন তাদের এলাকায় চোরাচালান ঠেকানোর নামে দিনের বেলায় নানা রকম প্রচার চালান। আর রাতে চোরাচালানে নিজেরাই জড়িয়ে পড়েন। ইউনিয়ন পরিষদের নামে চোরাচালানের বস্তাপ্রতি উৎকোচ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তারা। ‘ইউপি-ফি’ নামে সেই টাকা উত্তোলন করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে চিনি চোরাচালানে দুই মিলনের সমান সক্রিয়তার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যবেক্ষণ থেকে জানা গেছে। গোয়েন্দা তালিকায় দুটি ইউনিয়নের সঙ্গে তাদের নামও রয়েছে। নিজ এলাকায় দুজন ‘মিলন চেয়ারম্যান’ নামে পরিচিত হলেও চোরাচালান ও প্রভাব বিস্তারে তাদের ইউনিয়নের বাসিন্দারা কটাক্ষ করে আড়ালে দুজনকে ‘চিনি খান’ নামে ডাকেন!

রুট টু বোগলা-চিনাকান্দি
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের ১১ ও সুনামগঞ্জের ৫টি ইউনিয়নে ৫৭টি চোরাচালানের রুট রয়েছে। চোরাচালান চক্রে পুরো ইউনিয়ন বিস্তৃত কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, দোয়ারাবাজার ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সাতটি। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের দুটি হচ্ছে বোগলা ইউনিয়নের বোগলাবাজার ও ধনপুরের চিনাকান্দি। গত ৯ মাসের চোরাচালান পর্যবেক্ষণ পরিস্থিতি সূত্রে জানা গেছে, বোগলা থেকে চিনাকান্দি রুটটি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বালাটের সঙ্গে যুক্ত। বোগলার ওপারে ভারতের রেঙ্গা সীমান্ত এলাকা। চিনাকান্দির ওপারে রয়েছে রাঙাছড়া। ভারতের দুই এলাকা থেকে নেমে এসেছে দুটি সীমান্ত নদী। বোগলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে খাসিয়ামারা, ধনপুরে মনাইছড়া। 

জানা গেছে, এ দুটি নদী ঘিরেই চোরাচালানির রুট। এ পথে পশুসহ নানা ধরনের পণ্য বছরজুড়ে নামে। এর মধ্যে চিনি চোরাচালান শুরু হয় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা গেছে, ধনপুর ইউনিয়ন থেকে রাজাপুর, মাছিমপুর, তাহিরপুরের লাউড়েরগড় ও দিঘারতলা সীমান্তের চোরাই পথ নিয়ন্ত্রিত হয়। বোগলা ইউনিয়ন থেকে নিয়ন্ত্রণ হয় পেকপাড়া, ইদিকুনা, কইয়ারাজুরি, কলাউড়া, বাঁশতলা, মুকামছড়া, লক্ষ্মীপুরের ভাঙাপাড়া, মাঠগাঁও এলাকা। দুই ইউনিয়নে দুটি বর্ডার হাট বসার সূত্র ধরে চোরাচালান বিস্তৃত হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। দুটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের হিসাবে অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চার মাসে সীমান্তপথ দিয়ে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার চিনি চোরাচালান হয়েছে।

‘চিনি খান’ যেভাবে
সুনামগঞ্জ জেলায় তিনটি বর্ডার হাট রয়েছে। প্রথমটি সুনামগঞ্জ সদরের ডলুরা। এই হাটের সঙ্গে ভারতের বালাট সীমান্ত এলাকা সংযুক্ত। দ্বিতীয় বর্ডার হচ্ছে বোগলার বাগানবাড়ি। এ হাটের সঙ্গে যুক্ত মেঘালয় রাজ্যের রিংকু এলাকা। তৃতীয় বর্ডার হাট তাহিরপুর সীমান্তের লাউড়েরগড়। এ হাটে ভারতের পশ্চিম হিল সীমান্তের সায়েদাবাদ যুক্ত। অবস্থানগত কারণে লাউড়েরগড় ও ডলুরা হাটের একাংশ নিয়ন্ত্রিত হয় ধনপুর ইউনিয়ন থেকে। আর বাগানবাড়ি হাট পুরোটাই বোগলা থেকে।

স্থানীয় ইউপি সদস্যরা বলছেন, বর্ডার হাট পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে ধনপুর ও বোগলার মিলন জড়িয়ে পড়েন চোরাই কারবারে। সরেজমিন অনুসন্ধানে বিভিন্ন মাধ্যমে চিনি চোরাচালানের একাধিক ভিডিও এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এসব ভিডিওর মধ্যে অধিকাংশ বোগলা ও চিনাকান্দি এলাকার। প্রতি বৃহস্পতিবার বর্ডার হাটবার শেষে রাতভর চলে চোরাই পণ্যের লেনদেন। এ সময় চাহিদাসম্পন্ন পণ্যের মধ্যে কেবল চিনির আদান-প্রদান হয়।

বর্ডার হাটের জন্য কাভার্ড ভ্যানে থাকে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী। এসব পণ্যের প্রতিটি কনটেইনারে ‘ইউপি-ফি’ নামে ৮০ টাকা নেওয়া হয়। চিনির বস্তাপ্রতি ‘লাইন খরচ’ বাবদ যে ৩০০ টাকা উত্তোলনের রেওয়াজ রয়েছে, সেখান থেকে ৭০ টাকা রাখা হয় ইউপি চেয়ারম্যানের নামে। নিজ ইউনিয়নে পশুর হাটে নিজের ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে দুজনের। বর্ডার হাটে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই চেয়ারম্যানের লোকদের মধ্যে প্রায়ই বিবাদ হয়।

গত ১৪ এপ্রিল দিনে ও রাতে বিশ্বম্ভরপুরের পলাশ থেকে চিনাকান্দি হয়ে ধনপুরের স্বরূপগঞ্জ বাজারে গিয়ে সরেজমিনে চোরাচালান-চিত্র দেখা গেছে। এ সময় চোরাই চিনি পরিবহনের জন্য পলাশবাজারে রাতের বেলা রীতিমতো ট্রাকের যানজট লেগে যায়। স্বরূপগঞ্জ ও পলাশবাজারে সরেজমিন অবস্থানকালে একাধিক ব্যক্তিকে তখন মিলনকে ‘চিনি খান’ বলে অভিহিত করতে দেখা গেছে। 

২৮ মে ছাতকের নোয়ারাই হয়ে বাংলাবাজার ও বোগলাবাজার ঘুরে ‘ইউপি-ফি’ উত্তোলন-চিত্র প্রায় প্রকাশ্যেই দেখা গেছে। এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে দুটি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সের নির্ধারিত কক্ষ। বিভিন্ন সূত্রসহ সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে জানা গেছে, দুই ইউপি চেয়ারম্যান সপ্তাহান্তে ১৫ থেকে ২২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কেবল চোরাচালানের নিরাপদ পথনির্দেশনা থেকে। এর মধ্যে বোগলা ইউপি চেয়ারম্যান মিলন খানের একটি সমবায় সমিতির মাধ্যমে চোরাই কারবারে আর্থিক বিনিয়োগ রয়েছে। গত ৯ মাসে সমিতির মাধ্যমে ৬ কোটি টাকার বিনিয়োগ থেকে চক্রবৃদ্ধি সুদের হারে টাকা আদায় হয়েছে। চোরাই চিনি খাতে আর্থিক বিনিয়োগের জন্য মিলন খানের আরেক পরিচিতি ‘চিনি খান’।

পছন্দ ‘ক্যাশ’ টাকা
দুই চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমে জানা গেছে, তাদের হাতে প্রচুর ক্যাশ টাকা রয়েছে। চোরাকারবার নিয়ন্ত্রণে যখন তখন টাকার দরকার পড়ে বলে ক্যাশ টাকা নিয়েই ঘোরেন তারা। বোগলার মিলন খানের ক্যাশ টাকার কিছু অংশ সংরক্ষিত রয়েছে সমবায় সমিতিতে। এ সমিতি চক্রবৃদ্ধি সুদের সমিতি। নাম ‘স্বপ্ন’। ২০২১ সালের নির্বাচনে মিলন খান বোগলা ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর আগে ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রথমবার অংশ নিয়ে হেরে যান। ২০১৬ ও ২০২১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি ‘স্বপ্ন’ নামের সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এখন অবশ্য এটা অনেকটা গুটিয়ে রেখেছেন। ‘স্বপ্ন’সংশ্লিষ্ট দুজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে ‘স্বপ্ন’ কার্যক্রমকে ‘সুদের জাল’ বলে চিহ্নিত করেন। তারা বলেন, ‘মিলন চেয়ারম্যান ভোটে জিতেছেন স্বপ্নের জাল ফেলে। এখন এটি গুটিয়ে এককভাবে চোরাচালানে নিমজ্জিত করে রেখেছেন। তার ক্যাশ টাকার শক্তি এটিই।’
 
‘আমার ইউনিয়ন চোরাচালানমুক্ত’
দিনের বেলা অনেক চেষ্টা করেও দুজনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মঙ্গলবার রাত পৌনে ৯টার দিকে বোগলা ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মিলন খানের ফোন নম্বরে কল ঢুকলেও ফোন রিসিভ হচ্ছিল না। স্থানীয় একজন সংবাদকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তার ফোনের মাধ্যমে সরাসরি কথা হয়।

গরু নিয়ে জানতে চাইলে মিলন বিস্তারিত মন্তব্য করলেও চিনি প্রসঙ্গ তুললেই তার কথা বলার ধরন পাল্টে যায়। জবাব দেন সংক্ষিপ্ত। ফোন রেখে দেওয়ার তাগাদা দিয়ে তিনি এ প্রতিবেদককে এলাকায় আসার আমন্ত্রণ জানান। ‘চিনি খান’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কতজনই তো কত কথা কয়! এসব শুনলে কাজ করা যায় না।’ 

বর্ডার হাট ও স্থানীয় গরুর হাটে প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি মিলন অস্বীকার করেন। বলেন, ‘আমি নিজে দেখেছি, দেশি গরু প্রতিপালন করে আমাদের হাটে গরু তোলা হয়। একটা গরুও ইন্ডিয়ান পাবেন না। আমার ইউনিয়ন চোরাচালানমুক্ত আছি, এটাই। এর বেশি কিছু নাই।’ 

কথা বলার সময় মিলন তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এড়িয়ে যান। ‘স্বপ্ন’ নামের সমিতির বিষয়টিও এড়িয়ে যেতে কথা বলার মধ্যেই তিনি ফোন কেটে দেন।

‘কে কয় চিনি খাই?’
ধনপুর ইউপি চেয়ারম্যান মিলন খানও দিনের চেয়ে রাতে বেশি ব্যস্ত থাকেন। মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে ফোন করলে তিনি জরুরি একটি মিটিংয়ে আছেন জানিয়ে ১০ মিনিট পর ফোন দিতে বলেন। এরপর ১০ মিনিট গড়িয়ে আধা ঘণ্টা পর ফোন দিলে তাকে ব্যস্ত পাওয়া যায়। শেষে রাত ৯টা ৫৭ মিনিটে ফোনে কথা বলা সম্ভব হয়। 

বোগলার মিলনের মতো ধনপুরের মিলনেরও দাবি, তার এলাকায় আগে চোরাচালান হতো, এখন হয় না। কেন হয় না? এ প্রশ্নে বলেন, ‘মুক্ত করে রাখছি!’ তিনি জানান, এক-দুই মাস তার ইউনিয়নে চিনির চোরাচালান হয়েছিল। এরপর চিনির সঙ্গে মাদক ও অস্ত্র আসার বিষয়টি তিনি নিজে দেখে এসব বন্ধ করে দিয়েছেন। লোকমুখে ‘চিনি খান’ প্রসঙ্গে মিলন বলেন, ‘কে কয় আমি চিনি খাই? খাই না বইলাই কয়। আপনি এত কিছু কই থাকি পাইলেন! সব ভুয়া কথা।’

বর্ডার হাট দেখিয়ে চোরাচালান হচ্ছে- এ প্রশ্নে তিনি কিছুটা রেগে যান। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম ধরে বলেন, ‘এগুলো তারাই বিভ্রান্ত করে। কিছু চোরাচালান হইতেছে, এসব রাইতের দুইটা-তিনটায়। আমি তখন ঘুমিয়ে থাকি। প্রচুর চেষ্টা করতাছি ভাই! পারতাছি না। এই কদিন আগে ডলুরায় মারামারি পর্যন্ত অইছে।’

জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কড়া হুঁশিয়ারি
সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল হুদা মুকুটের সঙ্গে দুই মিলন খানের বিষয়ে কথা হয়। তিনিও জানান, এ দুজনের বিরুদ্ধে সীমান্তে চোরাচালানসহ নানা অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। স্থানীয় রাজনীতিতে দুই মিলন তার ‘লোক’ পরিচয় প্রসঙ্গে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে জেলা পরিষদের সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের যোগাযোগ তো থাকেই। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক কারণে সব জনপ্রতিনিধিই তো আমার লোক। তবে এই পরিচয়ে কোনো ক্রাইম বরদাশত করব না। কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় আমি বহন করব না। আওয়ামী লীগও বহন করবে না।’

বিএনপি নেতার হাতে ‘পলাতক’ আ.লীগ নেতার পত্রিকা-ব্যবসা!

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫২ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৪ পিএম
বিএনপি নেতার হাতে ‘পলাতক’ আ.লীগ নেতার পত্রিকা-ব্যবসা!
সিলেট নগরীর আবাসিক এলাকা হাউজিং এস্টেটে বিএনপি নেতার কাযালয় এখন আওয়ামী লীগ নেতার পত্রিকা অফিস। শুক্রবার সকালে তোলা। ইনসেটে আ.লীগ নেতা সরওয়ার ও বিএনপি নেতা কয়েস লোদী। খবরের কাগজ

৫ আগস্টের পর হয়েছে ক্ষমতার পালাবদল। দলীয় কোনো সরকার এখনো নির্বাচিত হয়নি। তারপরও দলীয় প্রভাব খাটানো শুরু হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে জায়গা জমি পর্যন্ত দখল হচ্ছে। এমনকি মিডিয়া হাউসের মালিকানার হাত বদল হয়েছে। সম্প্রতি সিলেটে একটি আঞ্চলিক পত্রিকার মালিকানা বদল নিয়ে চলছে তোলপাড়।

জানা গেছে, কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সরওয়ার হোসেন সিলেটের আঞ্চলিক পত্রিকা ‘শুভ প্রতিদিন’-এর মালিক। ১৩তম বর্ষে পা রাখা এই পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশকও তিনি। পত্রিকার মালিক দেখিয়ে সরওয়ার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পেলেও তিনি দলীয় নির্দেশে সিলেট-৬ আসনে ডামি প্রার্থী হয়েছিলেন। আওয়ামী সরকার পতনের পর তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হওয়ায় তিনি এখন পলাতক। এরপরই গুঞ্জন উঠেছিল এই পত্রিকার মালিকানা বদলের। এই গুঞ্জনের পালে হাওয়া লাগে যখন সিলেট মহানগর বিএনপির সদ্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদীর কার্যালয়ে ‘সম্পাদকীয় কার্যালয় শুভ প্রতিদিন’ লেখা সাইনবোর্ড সাঁটানোর পর।

সিলেট সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও সিসিকের প্যানেল মেয়র ছিলেন সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। এই ওয়ার্ডের হাউজিং স্টেট এলাকায় তার কার্যালয়। সম্প্রতি সেই কার্যালয়ে পত্রিকার নামে উঠেছে নতুন সাইনবোর্ড। তাই অনেকেই বলছেন, ক্ষমতার দাপটে সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দখল করেছেন এই পত্রিকা। অনেকে আবার বলছেন মালিক সরওয়ার হোসেনে দল ক্ষমতায় নেই, তাই কয়েস লোদীকে সাময়িকভাবে চালাতে দিয়েছেন।

সরজমিনে দেখা যায়, কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সাইনবোর্ড খুলে ‘সম্পাদকীয় কার্যালয় শুভ প্রতিদিন’ সাইনবোর্ড লাগালেও এখনো পত্রিকা সংশ্লিষ্ট কোনো আসবাবপত্র বা অন্য কোনো সামগ্রী এখানে সাজানো হয়নি। কাউন্সিলরের কার্যালয় থাকা অবস্থায় ভিতরে যে সাজসজ্জা ছিল এখনো তাই আছে। পত্রিকাটির কার্যালয় নগরীর নেহার মার্কেটে রয়েছে। 

প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মীদের মাধ্যমে জানা গেছে, কয়েস লোদী পলাতক সরওয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে পত্রিকাটির সত্ত্ব নিজ নামে করে নিয়েছেন। বিদেশে অবস্থানরত প্রতিষ্ঠাকালীন একজন কর্মী বলেন, ‘পত্রিকাটি ডিএফপি তালিকাভুক্ত। সরকার বদলের সঙ্গে ডিএফপি তালিকাভুক্ত যাতে থাকে, এ জন্য মালিকানা বদল করা হয়েছে। এতে কোনো আর্থিক লেনদেন হয়নি।’

আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পত্রিকার মালিক বদলের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা সরওয়ার হোসেন একটি ডেন্টাল কলেজ ও একটি ওষুধ কোম্পানিরও পার্টনারশিপ মালিকানায় ছিলেন। ওই দুই প্রতিষ্ঠানের মালিকানাও কয়েস লোদী নিয়েছেন। এর বিনিময়ে তার ওপর মামলাসহ রাজনৈতিক দমনপীড়নে ক্ষমতাসীন বিএনপির পক্ষ থেকে সহায়তার আশ্বাস পেয়েছেন। 

সরওয়ার হোসেন পলাতক থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরিবার ঘনিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছেন, তিনি কয়েস লোদীর কাছে মালিকানা দিয়েই কানাডা পাড়ি দিয়েছিলেন। 

যোগাযোগ করলে বিএনপি নেতা রেজাউল হাসান কয়েস লোদী খবরের কাগজকে কেবল পত্রিকার মালিকানা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে ওষুধ কোম্পানি ও ডেন্টাল কলেজের বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানি ও ডেন্টাল কলেজ সম্পর্কে আমি বলতে পারব না। এগুলোতে প্রায় ৫৬ থেকে ৬০ জনের শেয়ার আছে।’

পত্রিকার বিষয়ে রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, ‘পত্রিকাটি আমি অনেকদিন আগে কিনেছি। তাই এই পত্রিকার মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। এটা উনি আমার কাছে বিক্রি করেছেন, অফিসিয়াল নিয়মনীতি মেন্টেইন করে। জেলা প্রশাসকের কাছে ডকুমেন্ট সাবমিট করে তারপর সেটির মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে।’

কবে কিনেছেন পত্রিকা? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দিন তারিখ কাগজপত্র দেখে বলতে হবে। অনলাইনের জন্য ডকুমেন্ট সাবমিট করা হয়েছে ঢাকায়। এটা এখনো ট্রান্সফার হয়ে আসেনি।’ 

ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতার পত্রিকার মূল মালিক বনে যাওয়া ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অংশীদারির মালিকানা নেওয়ায় কয়েস লোদী বিতর্কের মুখ পড়েছেন। দলীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে গণমাধ্যমকর্মীরা এ বিষয়টি তলে তলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত হিসেবে দেখছেন। এরমধ্যে আঁতাত বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক নুরুল হক শিপু। 

তার ফেসবুকে এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস সূত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘পালাবদলে সিলেটে কতকিছুর হাতবদল হচ্ছে। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতার এক মিডিয়ার হাতবদলে তলে তলে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের এই পত্রিকাটির মালিকানা বদল হয়েছে ৫ আগষ্ট পরবর্তী বাস্তবতায়। এখন মালিক যিনি, তিনি সিলেট মহানগর বিএনপির সদ্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী।‘ 

ফেসবুক পোস্টটিতে আরও লেখা হয়, ‘আগের মালিক সরওয়ার হোসেন পলাতক। সরওয়ারের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ রেখে মিডিয়া হাউসটি লিখিয়ে নিয়েছেন বিএনপি নেতা কয়েস লোদী। পলাতক সরওয়ার কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর আছে কয়েস লোদীর কাছে! সিলেটে এভাবেই আওয়ামী লীগের প্রভাব হাইজ‍্যাক করে এখন বিএনপির হয়ে যাচ্ছে। এই দেশে কে বলে আওয়ামী লীগ নাই? তলে তলে সরওয়ার হয়ে কয়েস লোদীরাই টিকিয়ে রাখবে আওয়ামী লীগকে।...’

ফোনে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত সাংবাদিক নুরুল হক শিপু খবরের কাগজকে বলেন, ‘কয়েস লোদী সম্প্রতি সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পদে আসীন হয়েছেন। যদি তিনি এ পদে না থাকতেন, তাহলে এ বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা হতো না। এখন যেন ব্যাটে-বলে লেগে গেছে! বিষয়টি বিএনপি-আওয়ামী লীগে আঁতাতের উদাহরণ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে!’

শাহজালালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩০ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৩ এএম
শাহজালালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে
ফাইল ফটো

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিভিন্ন দায়িত্বে কাজ করে প্রায় ২৫টি সংস্থা। এর মধ্যে নিরাপত্তাক্ষেত্রে বেশির ভাগ দায়িত্ব পালন করছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স (এভসেক)। সম্প্রতি এপিবিএনের কমান্ড সেন্টারটি বিনা নোটিশে দখল করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এভসেকের বিরুদ্ধে।

এ ঘটনায় এভসেকের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছে এপিবিএন। এতে সরকারি এ দুটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শাহজালালে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।

তবে সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেছেন, পৃথিবীর সব বিমানবন্দরেই এভিয়েশন সিকিউরিটি দায়িত্ব পালন করে। এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্সের সক্ষমতা বাড়লে সেখানে কর্মরত অন্য বাহিনীর সদস্যরা চলে যাবেন। 

গত ২৯ নভেম্বর মঙ্গলবার বিমানবন্দর আর্মড পুলিশে কর্মরত সহকারী পুলিশ সুপার জাকির হোসেনের করা জিডিতে বলা হয়েছে, ‘সকাল সোয়া ১০টার দিকে এভসেকে কর্মরত স্কোয়াড্রন লিডার তাসফিক তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর থেকে কল দিয়ে বলেন, ‘অ্যাপ্রোন এরিয়ার (অ্যাপ্রোন এলাকা হলো যেখানে বিমান পার্ক করা হয়, লোড-আনলোড করা হয়, রিফুয়েল করা বা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়) ৩৩ নম্বর গেটে আপনাদের (এপিবিএন) অফিস থেকে মালামাল সরিয়ে ৮ নম্বর হ্যাঙ্গার গেটে রাখা হয়েছে। আপনাদের পুলিশ পাঠিয়ে এগুলো নিয়ে যান।’

জিডিতে বলা হয়, ‘পরে তিনি এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আগে না জানিয়ে কেন মালামাল সরিয়ে অন্যত্র রাখলেন- এমন প্রশ্নে এভসেকের ডেপুটি ডিরেক্টর অপারেশন সাইফুর রহমান জানান, বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম ও এভসেকের পরিচালক উইং কমান্ডার জাহাঙ্গীরের নির্দেশে এগুলো সরানো হয়েছে।’

জিডিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘পরে তথ্য নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ওই অফিসের প্রবেশমুখে বাম পাশে দেয়ালে লেখা এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ, এয়ার সাইড কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল লেখা সাইনবোর্ডটি ভঙ্গুর অবস্থায় অফিসের ভেতরে রাখা হয়েছে। অফিসের ভেতরে সরকারি কাজে ব্যবহৃত কম্পিউটার, ইলেকট্রনিকস ডিভাইস, ২০১০ সাল থেকে রক্ষিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথিপত্র নির্দিষ্ট স্থানে পাওয়া যায়নি।’

জানা গেছে, এরই মধ্যে অ্যাপ্রোন এলাকায় থাকা এপিবিএনের কমান্ড সেন্টারটি দখলে নিয়ে সেটিকে নিজেদের অফিস বানিয়ে ফেলেছে এভসেক। তবে এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য পাওয়া গেছে বিমানবন্দরে কর্মরতদের কাছ থেকে। 

বিমানবন্দরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে জানান, ৫ আগস্ট সরকারের পতন ঘনিয়ে এলে এপিবিএনের সদস্যরা তাদের অস্ত্র ও দায়িত্ব রেখে পালিয়ে যান। ফলে ওই সময় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং শঙ্কা তৈরি হয়। পরে এভসেকের সদস্য বাড়িয়ে তাদের দিয়ে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সব কাজ করানো হয়। 

অন্যদিকে বন্দরের অন্য আরেকটি পক্ষের অভিযোগ, এভসেকের বাধায় এখন ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারছে না এপিবিএন। শাহজালাল থেকে এপিবিএন সদস্যদের সরিয়ে দিতে এমনটি করা হয়েছে বলেও তারা মনে করছেন।

তবে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি এ অভিযোগের মধ্যে বিশ্লেষকরা বলছেন, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সরকারি দুই সংস্থার এমন মুখোমুখি অবস্থান নিরাপত্তার জন্য যেমন শঙ্কা হয়ে দেখা দিতে পারে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও বিমানবন্দরের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে।

এভিয়েশন বিশ্লেষক ড. কুদারাত-ই খুদা বলেন, ‘দুটি সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমেই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাড়তি অন্য কোনো সংস্থা থেকে নিরাপত্তার জন্য লোক আনার প্রয়োজন দেখি না।’

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারি দুটি সংস্থার এ ধরনের মুখোমুখি অবস্থান কারও কাম্য নয়। এ রকম মুখোমুখি অবস্থানে না থেকে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকলে নিরাপত্তা আরও সুসংহত থাকবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিরাপত্তা ইস্যু আরও প্রশংসিত হবে। আমরা চাই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো একে অপরের সঙ্গে সহমর্মিতা নিয়ে কাজ করবে। সর্বশেষ আমি শুনেছি ৫ আগস্টের সময় দায়িত্ব নিয়ে কিছু ঝামেলা হয়েছিল; তবে সে বিষয়ে তারা আলোচনা করে এখন দায়িত্ব ভাগ করে কাজ করছেন।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘বিমানবন্দরে নিরাপত্তার বিষয়টি একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে থাকা উচিত। পৃথিবীর সব দেশেই এটি রয়েছে। অথচ এখানে প্রায় ২৫-৩০টি সংস্থা নিজ নিজ এখতিয়ারে কাজ করে। এদের প্রত্যেকের পৃথক কমান্ড। এ কারণে মাঝে মাঝেই সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। নিরাপত্তাব্যবস্থা যতদিন পর্যন্ত একটি সেন্ট্রাল কমান্ডের আওতায় না আসবে, ততদিন এ অবস্থা চলতে থাকবে।’

জানা গেছে, সিভিল এভিয়েশনের নিয়ন্ত্রণাধীন এভসেকে যে জনবল রয়েছে তা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের বাইরে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বিমানবাহিনী থেকে ৫০০-এর বেশি জনবল নিয়োগ দিয়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ১৬০ জন, বাংলাদেশ পুলিশের ৭৯ জন শাহজালালে কর্মরত। এ ছাড়া চলতি বছরের গত ৩ অক্টোবর আবারও ৩২৮ জনসহ আরও প্রায় এক হাজার জনের নিয়োগের মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন চাওয়া হয়। 

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১০ সালের ১ জুন বিমানবন্দরে নিরাপত্তার কাজ শুরু করে আর্মড পুলিশ। নিরাপত্তার পাশাপাশি চোরাচালান রোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এই সংস্থাটি। 

এপিবিএনের অধিনায়ক শিহাব কায়সার খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সক্ষমতার দিক থেকে আমরা আগে যেমন ছিলাম, এখনো তাই আছি। আমরা দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমাদের সেটি করতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি পরিপত্র, আইকাও (আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা)-এর নিয়মাবলি যেভাবে রয়েছে, আমরা সেভাবেই দায়িত্ব পালন করে আসছি। এখন কেন দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে এটি বোঝা যাচ্ছে না। অ্যাপ্রোন এরিয়ায় আমাদের যে অফিসটি ছিল, আমাদের না জানিয়ে সেটি তারা সরিয়ে ফেলেছে।’

এদিকে বিমানবন্দর থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এভসেকের বিরুদ্ধে দায়ের করা এপিবিএনের জিডির তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে যেহেতু দুটি সংস্থার মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে, তাই তদন্তের সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে পুলিশ অপেক্ষা করছে।

এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের বিশেষ পরিস্থিতির কারণে এখানে বিমানবাহিনীর সদস্যদের এনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা ঠিক করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তারাই ডিউটি করে যাচ্ছেন। আমাদের কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি। পরবর্তী সময়ে এপিবিএন দায়িত্বে ফিরে এসেছে। আমাদের তিন কিলোমিটারব্যাপী এয়ারপোর্টের এরিয়া, যা সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার। বহিরাঙ্গনের যে নিরাপত্তা সেটির কাজ এপিবিএন করে যাচ্ছে।’

এপিবিএনকে আবার পুরোনো দায়িত্বে ফেরানো হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক সংস্থাই তো ভেতরে ডিউটি করতে চায়, সবাইকে তো সুযোগ দেওয়া সম্ভব না।

সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘পৃথিবীর সব বিমানবন্দরেই এভিয়েশন সিকিউরিটি দায়িত্ব পালন করে। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে এভিয়েশন সিকিউরিটিকে আরও শক্তিশালী করা। আমাদের সক্ষমতা বাড়লে বিমানবন্দরে কর্মরত এপিবিএনসহ অন্য কোনো বাহিনীই থাকবে না। বর্তমানে ১ হাজার ৫০০-এর বেশি এভিয়েশন সিকিউরিটির কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। আমরা আরও সাড়ে তিন হাজার জনবল নিয়োগ দিতে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে পাঁচ হাজারের মতো সিকিউরিটি কাজ করবে। একসময় এভিয়েশন সিকিউরিটি পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্যরা চলে যাবে।’

চোরাচালান: গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধেই গোয়েন্দাগিরি

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৫ এএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৪ এএম
চোরাচালান: গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধেই গোয়েন্দাগিরি
সীমান্তে দেদার ঢুকছে মাদকসহ নানা ধরনের পণ্য। ফাইল ফটো।

চিহ্নিত অপরাধীদের গতিবিধি নজরদারি করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাধারণত সাদাপোশাকে গোয়েন্দা নিযুক্ত করে থাকে। এবার সীমান্ত এলাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাই উল্টো অপরাধী চক্রের নজরদারিতে। 

সীমান্ত এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশ ও র‌্যাবের গতিবিধি নজরদারি (রেকি) করে মাদকসহ নানা ধরনের পণ্য দেদার চোরাচালান হচ্ছে। ‘রেকি’ তৎপরতা চালিয়ে পাচারের ‘রুট ক্লিয়ারেন্স’ দেওয়া হয়, তারপর শুরু হয় চোরাচালান। এ যেন গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধেই গোয়েন্দাগিরি। 

কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার স্থানীয় একাধিক নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তারা বলেছেন, পাচারের রুট ও বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের আনাগোনার তথ্য জানাতে এসব দায়িত্বের জন্য চক্রগুলো নিজেরা ‘বেতনভুক্ত’ বিশ্বস্ত লোক নিয়োগ করে থাকে। মায়ানমারসংলগ্ন কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকা টেকনাফ-উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়িসহ ভারতসংলগ্ন বেশ কিছু সীমান্ত এলাকায় এ ধরনের অভিনব তৎপরতা রয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে বিজিবির মুখপাত্র কর্নেল শরীফুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সীমান্তে বিশেষ নজরদারির পাশাপাশি নিয়মিত যৌথ টহল ও অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া যেকোনো ধরনের অপতৎপরতার খবর পেলেই বিজিবি অত্যন্ত দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।’

যেসব কৌশলে ঢুকছে মাদকসহ চোরাই পণ্য
মায়ানমার সীমান্তে চোরাচালান চক্রের এক বা একাধিক সদস্য রুট পাহারা দিয়ে খোদ বিজিবি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহলের ওপর নজরদারি করে থাকে। সেই সদস্য চোরাচালানের পণ্য বহনকারী আরেক চক্রকে যখন ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেয় বা রুটটি নিরাপদ বলে জানায়, তখনই সেই চালানটি নিয়ে চক্র অগ্রসর হয়। মাদক কারবারিরা মায়ানমার সীমান্তে কক্সবাজারের নাফ নদী এবং ভারত সীমান্তে রাজশাহীর পদ্মা নদী এলাকায় আরও কিছু অভিনব কৌশল প্রয়োগ করে থাকে। 

প্রশিক্ষিত সাঁতারু রোহিঙ্গারা ইয়াবা পাচার চক্রে অংশ নিচ্ছে। এর বাইরে অন্যতম আরেকটি কৌশল হচ্ছে ককশিটের ভেতরে মাছের আড়ালে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হেরোইন ঢুকিয়ে ভেলার মতো ভাসিয়ে সীমান্ত পার করা। এই প্রক্রিয়ায় বহনকারী হিসেবে সাধারণত কিশোর বয়সীদের ব্যবহার হয়। এটি ভারত সীমান্তসংলগ্ন পদ্মা নদীতে বেশি হয়। এমনকি ওই সব এলাকায় এক ধরনের ‘চুঙ্গা’ (অতি সরু ভাসমান বাহন) ব্যবহার হয়, যার ভেতরে মাদকসহ মূল্যবান চোরাই পণ্য নিয়ে সীমান্তের এপারে আনা হয়।

সীমান্তের যেসব এলাকায় চক্রের তৎপরতা বেশি
মায়ানমার সীমান্তে মাদক চোরাকারবারিদের অপতৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির তথ্য জানিয়েছেন টেকনাফের স্থানীয় সামাজিক একটি সংগঠনের নেতৃত্ব স্থানীয় এক ব্যক্তি। যার অডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। খবরের কাগজের সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপকালে নির্ভরযোগ্য ওই ব্যক্তি জানিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে টেকনাফ সীমান্ত এলাকার মাদক-চোরাকারবারিরা তৎপর হয়ে উঠেছে। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারিরাও প্রকাশ্যে চালাচ্ছে তাদের কারবার। বিশেষ করে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া, খারাইঙ্গাঘোনা, কোণাপাড়া, লম্বাবিল, উনচিপ্রাং, কানজরপাড়া, নয়াবাজার, খারাংখালী, হ্নীলা, সাইটপাড়া, ওয়াব্রাং, এইচকে আনোয়ার প্রজেক্ট এলাকায় চোরাকারবারিদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মায়ানমার থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে মূলত ইয়াবা, আইসসহ অন্যান্য মাদক ও অস্ত্র আসে বাংলাদেশে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে খাদ্য ও কৃষিপণ্য পাচার হয়ে থাকে মায়ানমারে, যার মধ্যে তেল, মরিচ, সার অন্যতম। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা যা বলছেন 
বিজিবির উপমহাপরিচালক (মিডিয়া উইং) ও মুখপাত্র কর্নেল শরীফুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন ছাড়াও সীমান্তে বাড়তি নজরদারি অব্যাহত রেখেছি। এর ফলে মাদকসহ নানা ধরনের চোরাচালানসামগ্রী উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উদ্ধার করা হচ্ছে। এর মধ্যে মায়ানমারের সীমান্ত এলাকাগুলোতে সব সময়ই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গোয়েন্দা নজরদারি ও অভিযান পরিচালনা করা হয়ে থাকে।’ 

একই প্রসঙ্গে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস খবরের কাগজকে বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় আমরা সাধারণত যৌথ অভিযান পরিচালনা করি। সীমান্ত এলাকার মূল দায়িত্বে রয়েছে বিজিবি। আমরা বিজিবির সঙ্গে যৌথভাবে কিংবা কোনো ক্ষেত্রে তাদের অবগত করে মাদকসহ চোরাচালানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাই।’ চোরাচালান চক্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নজরদারি করার জন্য সাদাপোশাকে নিজস্ব সোর্স নিয়োগ করে রেখেছে বলে খবর রয়েছে। এ সম্পর্কে কী জানেন জিজ্ঞাসা করলে মুনিম ফেরদৌস বলেন, ‘এ রকম খবর আমরাও পেয়েছি। আমরা সার্বিকভাবে অবগত হয়েই মাদকসহ সব ধরনের চোরাচালান বন্ধে কাজ করে যাচ্ছি।’

পরিসংখ্যান যা বলছে
বিজিবির সদর দপ্তরের এক পরিসংখ্যান বলছে, গত অক্টোবর মাসে তাদের অভিযানে সীমান্ত এলাকা থেকে ৫ লাখ ৯০ হাজার ৯৭৭ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। এ ছাড়া বিজিবি গত ১ মাসে ৩ কেজি ১৯৫ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস), ১১ কেজি ৮০২ গ্রাম হেরোইন, ২৬ হাজার ৫৯৯ বোতল ফেনসিডিল, ২১ হাজার ৬০৫ বোতল বিদেশি মদসহ বিপুল পরিমাণ মাদকজাতীয় পণ্য উদ্ধার করেছে।

সর্বশেষ শুক্রবার (৮ নভেম্বর) ফেনীর সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২ কোটি ১৭ লাখ টাকার চোরাচালান পণ্য আটক করা হয়েছে, যা ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচার হয়ে আসে। 

এদিকে মাদকবিরোধী অভিযানে অন্যতম ভূমিকা রাখা র‌্যাবের পরিসংখ্যান বলছে, গত ৩ মাসে (৫ আগস্ট থেকে ৫ নভেম্বর) কেবল র‌্যাবের অভিযানে মোট ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩১৭ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া একই সময়ে ২১ কেজি ৫৪ গ্রাম হেরোইন, ৪ হাজার ৭৯০ কেজি গাঁজা এবং ৪৪ হাজার ৮৩৬ পিস ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে। এসব মাদক জব্দের পাশাপাশি মাদকসংশ্লিষ্টতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯০১ জনকে।

ওএসডির পরও অফিস করছেন কর্মকর্তা!

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১০ এএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১২ এএম
ওএসডির পরও অফিস করছেন কর্মকর্তা!
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

এক চিকিৎসকের কারণে বিপাকে পড়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রোগী ও চিকিৎসকরা। দুই মাসে আগে ওএসডি হওয়া এই চিকিৎসক এখনো দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনি বহিরাগতদের নিয়ে হাসপাতালে অবস্থান করায় আতঙ্কিত চিকিৎসকরা। তিনি একজন নারী চিকিৎসককে অপদস্থ করেছেন বলেও জানা গেছে। চিকিৎসকদের আতঙ্কের কারণে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক চিকিৎসা ও সেবা কার্যক্রম। এ ছাড়া পরিচালকসহ প্রধান দুটি পদ শূন্য থাকায় ব্যাহত হচ্ছে প্রশাসনিক কার্যক্রম।

ওই চিকিৎসক হলেন ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবির জুয়েল। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে উপপরিচালক হিসেবে যোগদানের ৯ দিনের মাথায় তাকে ওএসডি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু তিনি সরকারি আদেশের তোয়াক্কা না করে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত অর্থাৎ ২ মাসের বেশি সময় ধরে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটেই অফিস করে যাচ্ছেন।

ওই প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকরা জানান, সফিকুল কবির দীর্ঘ চার বছর ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। সব মিলিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানেই কাটিয়েছেন অন্তত ১০ বছর। অথচ তিনি এখন নিজেকে বৈষম্যের শিকার বলে দাবি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত ৪০০ শয্যার মানসিক স্বাস্থ্যের এই হাসপাতালে আন্তবিভাগ ও বহির্বিভাগে রোগীদের সেবা দেওয়া হয়। প্রায় ৮০ জন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী উচ্চতর কোর্সে অধ্যয়নরত। 

প্রতিষ্ঠানের অস্থিরতার দ্রুত সমাধান চেয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর ৬৬ জন চিকিৎসক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে লিখিতভাবে অবহিত করেছেন। গত ৩১ অক্টোবর সুষ্ঠু কর্মপরিবেশের স্বার্থে বিশৃঙ্খলা রোধে ও বহিরাগতদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কর্মরত চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। একই দিন চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে এই প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রার ডা. তৈয়বুর রহমান স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। তার আগে গত ২৭ অক্টোবর থেকে চিকিৎসক-নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিদিন প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করে আসছিলেন।

এতে একাত্মতা পোষণ করেছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসের (বিএপি) আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক ডা. মো. নিজাম উদ্দিন, যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মেজর (অব.) মো. আব্দুল ওহাব, যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. নিলুফার আকতার জাহান, যুগ্ম সদস্যসচিব ও বিএসএমএমইউর সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শামসুল আহসান, শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জুবায়ের মিয়া, কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের ডা. রাহেনুল ইসলাম প্রমুখ। 

গত বৃহস্পতিবার ওই প্রতিষ্ঠানে উপপরিচালকের রুমের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে নেমপ্লেটে এখনো আছে ওএসডি হওয়া ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবিরের নাম। 

অভিযোগের বিষয়ে ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবিরের বক্তব্য জানার জন্য তার ব্যক্তিগত মুঠোফোন নম্বরে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ১১ মিনিটে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে ৭টা ৪ মিনিটে ফোন করে রেদোয়ানা নামে এক নারী নিজেকে সফিকুল কবিরের আইটি অ্যাসিসট্যান্ট পরিচয় দেন। কোন বিষয়ে কথা বলতে চাই, তা জানিয়ে তাকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিতে বলেন। তারপর তিনি বিষয়টি নিয়ে ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবিরের সঙ্গে আলাপ করবেন বলে জানান। পরে রেদোয়ানা একজন সাংবাদিকের নম্বর দিয়ে তাকে সফিকুল কবিরের প্রেস সচিব জানিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করতে বলেন। কথা হলে ওই সাংবাদিক জানান, তিনি তার প্রেস সচিব নন। কিন্তু সামগ্রিক বিষয় সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আছে। সফিকুল কবির যোগদানের পর আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। কিছু ভালো উদ্যোগ নেন। যে কারণে তিনি রোষানলে পড়েন।

ওএসডি হয়েও কক্ষ না ছাড়া প্রসঙ্গে ওই সাংবাদিক বলেন, ওএসডি হওয়ার পর সফিকুল কবির স্বাস্থ্য সচিবের সঙ্গে দেখা করে সব বিষয় অবহিত করলে তিনি তাকে উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে বলেন। সে জন্য তিনি হয়তো দায়িত্ব পালন করছেন।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদের মুঠোফোনে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইনগতভাবে সচিবের মৌখিক নির্দেশে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ নেই।

গত ২১ আগস্ট সফিকুল কবির উপপরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। তাকে ১ সেপ্টেম্বর ওএসডি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ন্যস্ত করা হয়। তখন এই হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক ডা. অভ্র দাশ ভৌমিক। সফিকুল কবিরকে ওএসডি করার পর ১২ সেপ্টেম্বর অভ্র দাশ ভৌমিককেও ওএসডি করা হয়। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি গত ২৩ সেপ্টেম্বর অবসরে যান। ওই দিনই তিনি প্রতিষ্ঠানের সহযোগী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি) ডা. মোহাম্মদ মুনতাসীর মারুফকে পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে যান। 

পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা ডা. মোহাম্মদ মুনতাসীর বলেন, পরিচালক ও উপপরিচালকের শূন্য পদ পূরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

আগের ঘটনার বিবরণ দিয়ে চিকিৎসকরা জানান, ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর থেকে এই প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ৬ আগস্ট পরিচালকের কার্যালয়সহ ৬ জন শিক্ষকের কক্ষ ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। 

অধ্যাপক অভ্র দাশ ভৌমিক পরিচালক থাকাকালীন ৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের বরাবর দেওয়া এক চিঠিতে কক্ষ ভাঙচুর প্রসঙ্গে অবহিত করেন। তাতে তিনি লিখেছেন, পরিচালকের কার্যালয়ের অনার বোর্ড ভাঙার ছবি দেখে একজনকে চিহ্নিত করা হয়। তিনি হলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) ডা. এইচ এম মাহমুদ হারুন। তবে বিষয়টি অস্বীকার করে ডা. এইচ এম মাহমুদ হারুন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি ওই দিন ঢাকা মেডিকেলে দায়িত্ব পালন করেছি। কেউ হয়তো এডিট করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমার ছবি বসিয়ে দিয়েছেন। আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’

চিকিৎসকরা জানান, ভাঙচুর ও লুটের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও রিপোর্ট দেওয়ার আগেই গত ২১ আগস্ট কমিটির প্রধান তৎকালীন উপপরিচালক ডা. মো. গোলাম মোস্তফাকে বদলি করা হয়। সেখানে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবিরকে পদায়ন করা হয়। 

সফিকুল কবির যোগদানের পর তৎকালীন পরিচালক অভ্র দাশ ভৌমিক ছুটিতে গেলে উপপরিচালক ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবিরকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে যান। কিন্তু তিনি রুটিন দায়িত্বের বাইরে গিয়ে গত ৩১ আগস্ট ৯ জন শিক্ষককে স্ব-স্ব দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার জন্য চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেন। সরে না গেলে এ ইনস্টিটিউটে ছাত্র ও কর্মচারীদের দ্বারা কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটুক- এটা কোনোভাবেই কাম্য নয় বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেন।

সিনিয়র সচিবের বরাবর দেওয়া ওই চিঠিতে সাবেক পরিচালক অভ্র দাশ ভৌমিক লিখেছেন, একজন কোর্স আউট হওয়া পরবর্তী সময়ে মার্সি পিটিশনের মাধ্যমে কোর্সে ফেরত আসা ডা. এ কে এম খালেকুজ্জামানকে দিয়ে একটি ভুয়া কাগজে ৬০ জন প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকের স্বাক্ষর নিয়ে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেন সফিকুল কবির। শিক্ষার্থীরা এই প্রতারণা ও মিথ্যাচারের বিরোধিতা করলে তাদের পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার ভয় দেখান এবং হুমকি দেন। একজন নারী প্রশিক্ষার্থী চিকিৎক না বুঝে করা ওই স্বাক্ষর প্রত্যাহারের জন্য সফিকুল কবিরকে অনুরোধ করলেও তিনি অনুরোধ রাখেননি।

জানা গেছে, পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের দপ্তরে আবেদন করেন। পরদিন গত ১ সেপ্টেম্বর ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবিরকে ওএসডি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পদায়ন করা হয়। ২ সেপ্টেম্বর ওই নারী চিকিৎসক সাবেক পরিচালক ডা. অভ্র দাশ ভৌমিকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন, যা জানতে পেরে ওই দিন বেলা আড়াইটায় সফিকুল কবিরের রুমে ডেকে বহিরাগত এক চিকিৎসককে দিয়ে ওই নারী চিকিৎসককে অপদস্থ করা হয়। 

খবরের কাগজের হাতে আসা একটি ছবিতে দেখা গেছে, ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবির উপপরিচালকের চেয়ারে বসে আছেন। রুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন এবং ডান হাতে চোখ মুছছেন ওই নারী চিকিৎসক। তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ রাঙ্গাচ্ছেন ডা. ফরিদুজ্জামান রানা। 

জানা গেছে, রানা চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। এ ঘটনার পর ওই নারী চিকিৎসক গত ৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। 

এ বিষয়ে নারী চিকিৎসক ডা. নাজিয়া হক অনি বলেন, ‘অভিযোগের পর তদন্ত কমিটি এসে তদন্ত করে গেছে, কিন্তু এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি’। তিনি দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দাবি করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, ওএসডি হওয়ার ক্ষোভে সফিকুল কবির গত ৩ ও ৪ সেপ্টেম্বর বহিরাগতদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অস্থির করে তোলেন। তিনি নিজেকে বৈষম্যের শিকার উল্লেখ করে কোটাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে দাবি করেন। 

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বরাবর দেওয়া স্মারকলিপিতে বলা হয়, তিনি ওএসডি হওয়ার পরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগদান না করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশ অমান্য করে তিনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের উপপরিচালকের কক্ষ দখল করে বহিরাগত ব্যক্তিদের নিয়ে মিটিং করেন। তিনি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসাগত, একাডেমিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ এবং দাপ্তরিক নথিতে স্বাক্ষর করে চলেছেন। 

স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কাছে পাঠানো স্মারকলিপিতে বলা হয়, সফিকুল কবির গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা পরিপন্থি কাজ করে নিজেই একজন স্বৈরাচারের ভূমিকা পালন করছেন।  

অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ডা. সফিকুল কবিরের কর্মকাণ্ড বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। গত ২২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব খন্দকার মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি দল তদন্ত করে। 

যুগ্ম সচিব খন্দকার মোহাম্মদ আলী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি তদন্তের পর প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। পরবর্তী সময়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা আমার জানা নেই।’

তদন্ত কমিটিকে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে অবসরে যাওয়া সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন ওএসডি হওয়া ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবির জুয়েলের প্রতিদিন অফিস করার বিষয়টি উল্লেখ করেন। গত ১৪ সেপ্টেম্বর সফিকুল কবির পরিচালক হিসেবে (ওএসডি উল্লেখ না করে) নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে একটি চিঠিও পাঠিয়েছেন বলে জানান।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার মুঠোফোনে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা ফেরাতে ছাত্ররাজনীতির রূপরেখা দরকার

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৮ এএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০৩ এএম
শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা ফেরাতে ছাত্ররাজনীতির রূপরেখা দরকার
রাজু ভাস্কর্যের সামনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ফাইল ফটো

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি। সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বড় একটি অংশ ছাত্ররাজনীতি বা লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়েছে। তবে এই দাবি বাস্তবায়নে এখনো কোনো রূপরেখা তৈরি হয়নি। ফলে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি, সাধারণ শিক্ষার্থী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি ছাত্রসংগঠনগুলোর নানা ইস্যুতে বিরোধ তৈরি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হল প্রশাসন, কার্যকর ছাত্রসংসদ এবং সব শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির ধারা বন্ধ হবে। একই সঙ্গে ক্যাম্পাসে দীর্ঘমেয়াদে শৃঙ্খলা ফিরবে। তবে ছাত্ররাজনীতি একেবারে বন্ধের পক্ষের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। 

ছাত্ররাজনীতির কাঠামো বা রূপরেখা তৈরির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় গত মাসে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে আমরা এক দফা বসেছি। শিগগিরই আবার বসব। আমরা ধাপে ধাপে অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করব। একটি কমিটি গঠনের বিষয়েও অগ্রগতি হয়েছে। সেই কমিটি পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের পরামর্শ দেবে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটি করার জন্য।’

অপরদিকে ছাত্ররাজনীতি ইস্যুতে বিশৃঙ্খলার সমাধান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক খবরের কাগজকে বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি থাকবে। তবে এটাকে একটা কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে হল প্রশাসনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকতে হবে। কার্যকর ছাত্রসংসদ থাকতে হবে। ফলে দুই পক্ষই একটা মনিটরিংয়ের মধ্যে থাকবে। অনিয়মের সুযোগ কম থাকবে। আবাসিক সিট নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষার্থীদের দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে রাজনীতি করানো যাবে না। এ অবস্থায় ক্যাম্পাসে ছাত্ররা বুঝে-শুনে রাজনীতি করবে। ছাত্ররাজনীতি থাকলেও প্রতিপত্তিমূলক প্রভাব কমে আসবে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।’

জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশের একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা করে ছাত্রলীগ। একপর্যায়ে ১৬ জুলাই মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে ক্যাম্পাস ছাড়ে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। একই অবস্থা হয় রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৭ জুলাই ভোরে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ৫ হল, পরে ছাত্রদের হলগুলোতেও দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে নোটিশ দেওয়া হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে এসব নোটিশে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন তৎকালীন হল প্রাধ্যক্ষরা। একই সঙ্গে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সিট বরাদ্দ এবং গণরুম (এক কক্ষে একাধিক শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা), গেস্টরুম (ছাত্র নেতাদের কাছে জবাবদিহি) সংস্কৃতি বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়।

তবে নোটিশ দেওয়ার দিনই সিন্ডিকেট আবাসিক হল বন্ধ ঘোষণা করে। সরকারও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের ছুটি ঘোষণা করে। দেশব্যাপী আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শিক্ষাঙ্গনে ভিন্ন পরিস্থিতি দেখা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে থাকা নিয়ে পদত্যাগ, বহিষ্কার ও হেনস্তার ঘটনা ঘটে। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেতৃত্বেও পরিবর্তন আসে। 

আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গা-ঢাকা দেন। এ সময় দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা সংগঠনগুলো সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে। দেশের একাধিক উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আত্মপ্রকাশ করে ছাত্রশিবির। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় অংশই আবাসিক হলগুলোকে রাজনীতিমুক্ত রাখার পক্ষে। ফলে ছাত্রলীগ-পরবর্তী ক্যাম্পাসে অন্য সংগঠনগুলোও শিক্ষার্থীদের মেজাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সতর্কভাবে কর্মসূচি পালন করছে। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ছাত্রদল হল প্রাধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। মধুর ক্যান্টিন-কেন্দ্রিক দলীয় ফরমও বিতরণ করেছে। তবে ৭ নভেম্বর উপলক্ষে ছাত্রদল ক্যাম্পাসজুড়ে পোস্টারিং করে। এরপরই সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। মধ্যরাতে বিক্ষোভ মিছিল করেন তারা। ৫টি আবাসিক হলে পোস্টারিং নিষিদ্ধ করে কর্তৃপক্ষ। ছাত্রদলের পক্ষ থেকেও প্রতিক্রিয়া আসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিবির আর ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হয়। আবার ছাত্রশিবিরও বিভিন্ন ইস্যুতে উপাচার্যকে স্মারকলিপি দেয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা হলে অবস্থান তৈরির চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে ছাত্রশিবিরও তাদের কমিটি প্রকাশ করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা লিফলেট বিতরণ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা।

পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসগুলোতে শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করতে চায় ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির। বিভিন্ন বাম ছাত্রসংগঠনও ক্যাম্পাসে সক্রিয় রয়েছে। তবে সংগঠনগুলো কৌশলী ভূমিকা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধারার ছাত্ররাজনীতির সংস্কার দরকার। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর তিন মাস পার হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির কোনো রূপরেখা তৈরি হয়নি। ফলে শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি ভার্চু্য়ালি পরস্পরবিরোধী মন্তব্যে নানা বিষয় সামনে আসছে।

সিটের বিনিময়ে বাধ্যতামূলক রাজনীতি থেকে মুক্তি চান শিক্ষার্থীরা

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসনসংকট এখনো চরম। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৬০ ভাগ শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা নেই। প্রতিটা হলে আসনসংকট থাকায় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলো হলের কক্ষের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শিক্ষার্থীদের উঠিয়ে থাকে। ফলে রাজনৈতিক আশ্রয়ে হলে থাকায় তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে হয়। না গেলে নেমে আসে নির্যাতন। ২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এই সংস্কৃতি থেকে মুক্তিলাভ করেন শিক্ষার্থীরা। ছাত্রত্ব শেষ হওয়া শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। একাধিক হলে মেধার ভিত্তিতে সিট বণ্টন করেছেন হল প্রাধ্যক্ষরা। বৈধভাবে সিট পাওয়ায় তারা সন্তুষ্ট। এই ধারায় আর ছেদ ঘটুক, চাচ্ছেন না তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা যখন প্রথম বর্ষে আসি, তখন আমাদের পুরো বছর বাধ্যতামূলকভাবে প্রোগ্রামে অংশ নিতে হয়েছে, যা আমাদের ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু এবার সবাই বৈধভাবে সিট পেয়েছেন। সবাই নিজেকে স্বাধীন ভাবছেন। হলে রাজনীতির মাধ্যমে আবার সেটি ফিরে আসুক আমরা তা চাই না।’

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির খবরের কাগজকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ হয়েছে। এটা গণআকাঙ্ক্ষার ফল। এখন একুশ শতক উপযোগী মেধাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি বিনির্মাণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ চলমান। আমরা হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছি। সেখানে শিক্ষার্থীরা যে আউটলাইন দিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা মনে করছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমাদের রাজনৈতিক অংশীদার হবেন। ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থীরাও আমাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অংশীদার হবেন। পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও গোপন রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্তরা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে চান। তাদের এক ধরনের মনোবাসনা রয়েছে। আমরা মনে করছি, শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমরা কয়েকদিনের মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আমাদের রাজনৈতিক রূপরেখা উপস্থাপন করব।’