
চুরি ও ভেজাল রোধে ট্যাংক লরিতে বসানো হচ্ছে ট্র্যাকিং সিস্টেম। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এই ট্র্যাকিং সিস্টেম বসানোর জন্য কাজ করছে দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কল্পলোক টেকনোলজিস। চলতি মাসের শেষ নাগাদ এই ট্র্যাকিং সিস্টেম বসানোর কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। ১ জুলাই থেকে ট্যাংক লরিতে ট্র্যাকিং সিস্টেম না থাকলে কোনো ডিপো থেকে তেল নিতে পারবে না জ্বালানি তেল বহন করা এই পরিবহন।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য ২ হাজার ৮০০ নিবন্ধিত ট্যাংক লরি রয়েছে। এ ছাড়া আরও ১০০টি ট্যাংকার আছে।
সম্প্রতি খবরের কাগজকে এসব তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পরিচালক (বিপণন) কবির মাহমুদ। তিনি জানান, জ্বালানি তেল পরিবহনের সময় চুরি হওয়ার মতো ঘটনা যেমন ঘটে, তেমনি এসব লরি ভেজাল তেল পরিবহন করলেও কারও কিছু করার থাকে না। তাই ট্যাংক লরিতে তেল চুরি ও ভেজাল প্রতিরোধে বসানো হচ্ছে ট্র্যাকিং সিস্টেম। গত মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এই ট্র্যাকিং সিস্টেম বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪০০ গাড়িতে এই ট্র্যাকিং সিস্টেম বসানো হয়েছে। এই ট্র্যাকিং সিস্টেম বসাতে প্রতি গাড়িতে খরচ পড়ছে ৩ হাজার ১০০ টাকার বেশি। এই খরচ বহন করবেন গাড়ির মালিকরা। প্রাথমিক অবস্থায় ২ হাজার ৮০০ নিবন্ধিত ট্যাংক লরিতে এই ট্র্যাকিং সিস্টেম বসানো হবে এবং চলতি মাসের শেষ নাগাদ কাজ শেষ হবে। ১ জুলাই থেকে ট্যাংক লরিতে ট্র্যাকিং সিস্টেম না থাকলে কোনো ডিপো থেকে তেল নিতে পারবে না।
তিনি আরও জানান, এ ছাড়া ট্যাংকারে বসানো হবে ডিজিটাল লক। ট্যাংক লরিতে ট্র্যাকিং সিস্টেম বসানো শেষ হলেই ট্যাংকারে ডিজিটাল লক বসানোর কাজ শুরু হবে।
জ্বালানি বিভাগে দুই মাস আগে ট্যাংক লরিতে ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ট্যাংকারে ডিজিটাল লক সংযোজন করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে জ্বালানি সচিব নূরুল আমিন অবিলম্বে ট্যাংক লরিতে ট্র্যাকিং সিস্টেমের সঙ্গে ডিজিটাল লক স্থাপনের নির্দেশ দেন।
এ বিষয়ে জ্বালানি সচিব খবরের কাগজকে বলেন, ট্যাংক লরি ও ট্যাংকারের তেল চুরি এবং ভেজাল তেল মেশানোর ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন পেট্রল পাম্পে অভিযান চালিয়ে ওজনে কম দেওয়া ও ভেজাল তেল মেশানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের এই অবৈধ কারবার বন্ধে নতুন এই উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, যা চলমান রয়েছে। প্রথমে ট্যাংক লরিতে ট্র্যাকিং সিস্টেম বসানো হচ্ছে। এরপর ট্যাংকারে ডিজিটাল লক বসানোর কাজ শুরু হবে।
জ্বালানি সচিব বলেন, ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ডিজিটাল লক বসানো হলে কেউ ইচ্ছা করলেই ট্যাংক লরি খুলে তেল চুরি করতে পারবে না। লক খুললেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে দায়িত্বরত ব্যক্তির কাছে সংকেত পৌঁছে যাবে। এ ছাড়া একই সঙ্গে মালিক দেখতে পারবেন কোথায় ট্যাংক লরিটি রয়েছে।
জ্বালানি তেল ও সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ইতোমধ্যে সরকার জ্বালানি বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জিপিএস ম্যাপিং করেছে। এবার জ্বালানি পরিবহনকে ডিজিটালাইজেশন করার মধ্য দিয়ে চুরি ও ভেজাল ঠেকাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে এখন প্রশ্ন হচ্ছে চুরি ও ভেজাল ঠেকাতে এই ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ডিজিটাল লক কতটা কাজে আসবে। চুরি ঠেকাতে এই ট্র্যাকিং সিস্টেম কতটা কাজে আসবে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পরিচালক (বিপণন) কবির মাহমুদ বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জেনে-বুঝে ট্যাংক লরি ও ট্যাংকারে ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ডিজিটাল বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই পদ্ধতি যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে চুরি ও ভেজাল রোধ করা যাবে বলে আমরা আশাবাদী।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ডিজিটাল লক বসালেই যে চুরি বন্ধ হয়ে যাবে এমন নয়। এমনও হতে পারে দেখা যাবে, যারা চুরি করে তারা নিজেরাই এই ডিজিটাল লক বা ট্র্যাকিং সিস্টেম নষ্ট করে ফেলবে। দেখা যাবে পরে তারা নিজেরাই বলবে কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই এ ধরনের উদ্যোগ শতভাগ সফল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ট্যাংক লরি ও ট্যাংকারের একাধিক ব্যবসায়ী খবরের কাগজকে বলেন, ‘জ্বালানি তেল চুরি, ভেজাল মেশানো ও ওজনে কম দেওয়া নতুন নয়। কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর এই অবৈধ কারবারের কারণে আমরা যারা সততার সঙ্গে ব্যবসা করতে চাই তারা অনেক সমস্যায় আছি।’ তবে সরকারের নতুন এই উদ্যোগে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এতে চুরি ও ভেজাল কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে বলেও জানান তারা।
এ বিষয়ে কথা হয় আসাদগেট সোনার বাংলা সার্ভিস স্টেশনের ম্যানেজার হিমালয় মণ্ডলের সঙ্গে (ডিলার যমুনা অয়েল কোম্পানি)। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, সোনার বাংলা সার্ভিস স্টেশনের ট্যাংক লরিগুলোতে ট্র্যাকিং সিস্টেম লাগানোর কাজ চলছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটিতে লাগানো হয়েছে। জ্বালানি তেল ওজনে কম দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সবই ডিজিটাল মিটার, ওজনে কম দেওয়ার সুযোগ নেই।
কল্পলোক টেকনোলজিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নাজমুল হাসান খবরের কাগজকে জানান, জ্বালানি তেল বহনকারী সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের পরিবহনকে ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ডিজিটাল লকের আওতায় আনবে সরকার। কল্পলোক এখন ট্যাংক লরিতে ট্র্যাকিং সিস্টেম বসানোর কাজ করছে। এই ট্র্যাকিং সিস্টেমের মাধ্যমে ট্যাংক লরি যে রুট দিয়ে চলবে তার অবস্থান জানা যাবে। তবে ট্যাংক লরি যদি নির্দিষ্ট রুট দিয়ে না গিয়ে অন্য রুট ব্যবহার করে, কোথায় দাঁড়িয়ে তেল চুরির চেষ্টা করে, তখন দায়িত্বরত ব্যক্তির কাছে একটি সংকেত যাবে। এই পদ্ধতিতে চুরি ও ভেজাল রোধ করা সম্ভব বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘একটি ট্যাংক লরি যদি তেল চুরি করতে চায়, তখন অবশ্যই তাকে একটি নিরাপদ জায়গায় পার্কিং করে তেল চুরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যাত্রাপথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তেল চুরি না করাই স্বাভাবিক। পরিবহন করা কোনো গাড়ি যদি মূল রুট থেকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে অনুমান করা সহজ হবে চুরি হচ্ছে কি না। তাই ট্র্যাকিং সিস্টেম চুরি রোধে সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি।’