টিলাভূমি আর জলাভূমি নিয়ে সিলেট। এই জেলার উত্তরপূর্বে রয়েছে ভারত সীমান্ত। ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের বেষ্টনী। একদিকে পাহাড় আরেকদিকে নদী। পাহাড় আছে মেঘালয়, খাসিয়া ও জয়ন্তিয়ায়। সুউচ্চ এই তিন পাহাড় একদিকের সীমান্ত। ভারত থেকে বরাক নদী নেমে এসে বাংলাদেশের সুরমা-কুশিয়ারার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। কুশিয়ারা সিলেটের প্রান্তসীমার উপজেলা জকিগঞ্জের সীমারেখা। টিলাভূমি আর জলাভূমির সিলেট কেন ঢল নামলেই জলতল হচ্ছে? এ প্রশ্নটি ২০২২ সালের বন্যার পর থেকে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
বলা হচ্ছে, পৃথিবীর বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল ভারতের শিলংয়ের চেরাপুঞ্জি থেকে সরাসরি পানি আসছে ভাটির পথে। এতকাল এই পানিকে বলা হতো উজানের পানি। এখন সরাসরি বলা হচ্ছে ‘ভারতের ঢল’ বা ভারতের ছেড়ে দেওয়া পানি। দোষারোপের গণ্ডি সীমানা পেরিয়েছে।
স্থানীয় ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেছে, সিলেট অঞ্চলকে একসময় ‘জলতল্লাট’ বলা হতো। আঠারো শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ শাসনামলে সিলেটে যখন প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা হয়, তখন কালেক্টরেট উঁচু একটি টিলা এলাকা বাছাই করেছিলেন। বর্তমানে এমসি কলেজের অধ্যক্ষের ভবনের স্থানটি ছিল সেই টিলা। কালেক্টরেট কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করায় সেই থেকে টিলাটির নাম হয়েছে ‘থ্যাকারের টিলা’। মাইকেল থ্যাকার ছিলেন প্রথম কালেক্টরেট। উইলিয়াম মাইকপিস থ্যাকারের ‘ভারতজীবন’ গ্রন্থে এ বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এখানে বছরের ৯ মাস পানি থাকে। নৌকার কারিগর পাঠানোর তাগাদা দিয়ে ব্রিটিশ সরকারের মাধ্যমে নৌ-কারিগর প্রতিষ্ঠান গড়ার কথাও বলা হয়েছে। অপরদিকে থ্যাকার কেন কালেক্টরেট কার্যালয় টিলার ওপর করলেন? এ নিয়েও তার জবাবদিহিতে জলতল্লাট কথাটি প্রকাশ পেয়েছে।
ব্রিটিশ শাসকদের স্মৃতিচারণ গ্রন্থ ও নথিপত্র থেকে প্রাপ্ত এসব তথ্য-উপাত্ত বলছে, সিলেট অঞ্চল জলাভূমি। একাংশ টিলাভূমি হওয়ায় ভৌগোলিক দুটো চিত্রই দৃশ্যমান রয়েছে। অপেক্ষাকৃত নিচু টিলাভূমি এলাকায় ঢলের পানি নামলে দ্রুত গড়িয়ে যায়। পর্যবেক্ষক ও ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই গড়িয়ে পড়ার ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে বিগত কয়েক বছর ধরে।
২০০৪ ও ২০২২ সালের বন্যা এবং এবারকার পরিস্থিতি কাছ থেকে দেখেছেন সিলেট কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদ অববাহিকা ইসলামপুর (পশ্চিম) ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘ভারতের চেরাপুঞ্জি থেকে সরাসরি ঢলের পানি ধলাই নদে নামে। এ সময় সদরসহ নদতীরের জনবসতিতে পানি এলেও স্থায়িত্ব ছিল কম। কিন্তু ২০২২ সাল থেকে এখানে ঢলের পানির বন্যার স্থায়িত্ব বেশি হচ্ছে। অর্থ্যাৎ পানি আগের মতো গড়াচ্ছে না। কেন গড়াচ্ছে না, এটা দেশীয় বিষয়। আর ঢল কেন সরাসরি আসছে, সেটা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিষয়। এই দুই বিষয়ের সমাধান ছাড়া নিস্তার নেই।’
ধলাই ছাড়াও সিলেটের অন্যতম সীমান্ত নদী সারী। এ নদী এক যুগ আগে ও পরের পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন মৃতপ্রায়। নদীটিকে বাঁচাতে গঠন করা হয়েছে একটি কমিটি। ‘সারী বাঁচাও আন্দোলন’ নামের এ কমিটির সভাপতি আবদুল হাই আল হাদী ‘পৃথিবীর পাঠশালা’ নামে একটি ফেসবুক পেজ পরিচালনা করছেন।
জানতে চাইলে এই নদী অধিকারকর্মী বলেন, ‘এতকাল আমরা জেনেছি বরাক থেকে সুরমার পানি প্রবাহিত হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, জকিগঞ্জের কাছের বরাক মোহনা এখন ভরাট। সুরমার পানি প্রবাহের প্রাণ এখন লোভা নদী। এই যে নদীর গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে, এসবের মূলে রয়েছে ভারতে যত্রতত্র নদী শাসন।’
আবদুল হাই আল হাদী সিলেট অঞ্চলের নদনদীর উৎস অবস্থা সরেজমিনে দেখতে ভারতের মেঘালয়ে একাধিকবার গিয়েছেন। ব্যক্তিগত সফর থেকে ফিরে এসে প্রতিবার তিনি একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তার মতে, ‘পাহাড়ি ঢল বা উজানের পানি বলা হতো সেই ১৯৪৭ সালে। যখন সিলেট অঞ্চল আসামের ছিল। এরপর থেকে এভাবে বলা এক ধরনের আঞ্চলিকতা। বরং ভারত থেকে আসা ঢল বললেই সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিপাত হবে।’
উপদ্রুত এলাকার মানুষের কথা থেকে বন্যার কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় সামনে এসেছে। একটি ভারতের পানি, দ্বিতীয়ত দেশের অভ্যন্তরে পানিপ্রবাহে বাধা আর নদনদীর খনন না হওয়া। কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন সড়কটিকে অনেকে ‘টিকটক সড়ক’ বলে অভিহিত করছেন। ঢলের পানি দ্রুত না নামার জন্য এ সড়কটি কতটা দায়ী? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
জানতে চাইলে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মুশতাক আহমদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রথম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এ পরিবর্তনে আগের অনেক হিসেব-নিকেশ কিন্তু এখন পালটে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক কিছুই ঢালাওভাবে প্রকাশ হয়। কেবল ইটনা-মিঠামইন সড়ক নয়, দায়ী আরও অনেক কিছু। পানি কেন সহজে নামছে না, এ জন্য একটি ডিজিটাল সার্ভে দরকার। এই সার্ভের পর সমন্বিত গবেষণা করে চিহ্নিত করতে হবে বন্যার কারণ। এক কথায় ২০২২ সালের বন্যা থেকে আমরা কোনো শিক্ষা নিইনি, এ কারণে ২০২৪ সালে এ পরিস্থিতির মুখে পড়েছি।’
সার্বিক পরিস্থিতি মোকবিলায় সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) মঙ্গলবার রাতে নগরভবনে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেছে। এই সংবাদ সম্মেলনে সিলেট অঞ্চলে বন্যার তিনটি কারণ উপস্থাপন করেছেন সিলেট অনলাইন প্রেস ক্লাবের সভাপতি মুহিত চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘কিশোরগঞ্জের হাওরে ইটনা-মিঠামইন সড়ক, সুরমা নদী ভরাট ও সীমান্ত এলাকার পাথর কোয়ারিতে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে আসা পাথর আহরণ না করা।’
মুহিত চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘২০২২ সালের বন্যার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইটনা-মিঠামইন সড়কের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, পানি প্রবাহে সড়কটি বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় ঢলের পানি নামছে না, বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। আর পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকায় সীমান্ত নদনদীগুলোর উৎসমুখ বন্ধ হয়ে পানি চলাচলে বাধা দিচ্ছে। সুরমার নাব্য কমায় সিলেট শহরে এক মৌসুমে আট থেকে দশবার জলাবদ্ধতা হচ্ছে। দেশীয় এই তিন সমস্যার সমাধান করে আন্তর্জাতিক দিকে নজর দিতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে সিসিক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জানিয়েছেন, তিনি এবারকার পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ মহলের দৃষ্টিতে দেবেন। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি অবহিত করে প্রতিকার চাইবেন।