সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় ছাত্রলীগের চিনি লুটের ঘটনা এখন বহুল আলোচিত এক বিষয়। লুটের চিনি ভাগাভাগি করতে ছাত্রলীগ নেতাদের ফোনালাপ ও জড়িতদের নাম প্রকাশ হওয়ায় কেন্দ্র থেকে কমিটি বিলুপ্তির পর ছাত্রলীগ নেতাদের ধরপাকড়ের মধ্যে একের পর এক চোরাই চিনি লুটের ‘ধামাচাপা’ দেওয়া ঘটনা বের হচ্ছে। এ নিয়ে থানায় মামলা পর্যন্ত হলেও ধামাচাপা দিতে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠছে।
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় ছাত্রলীগের চিনি লুটের ঘটনাটির আগে আরও বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে সিলেট সদর, জকিগঞ্জ ও কানাইঘাটে। এর মধ্যে প্রথম ঘটনা ঘটে গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। বিয়ানীবাজারের পর জকিগঞ্জের চিনি লুটের ঘটনা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে প্রকাশ পেয়েছে। স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যান ভিডিও বার্তায় বলেছেন, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুলতান আহমদ চিনি লুটের সঙ্গে জড়িত। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী দ্বারা এসব ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলা হলেও সংবাদমাধ্যমে আসেনি। ধামাচাপা দিতেই এমনটি করা হয়।
বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জের ঘটনা প্রকাশের পর খবরের কাগজের হাতে এসেছে গোলাপগঞ্জে গত বছর ছাত্রলীগের চিনি লুটের একটি ধামাচাপার ঘটনার তথ্য-প্রমাণ। অভিযোগ উঠেছে, চিনি লুটের এ ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদের বাদ দিয়ে মামলা হয়েছে। আর পুলিশকে চাপ দিয়ে তড়িঘড়ি করে মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এরই মধ্যে পুলিশ বলছে, বাদীকে চাপ দিয়ে ঘটনার আপস-নিষ্পত্তিও করা হয়েছে। এতে করে মামলাটির বিচারপ্রক্রিয়া এখন বাধার মুখে পড়েছে।
খবরের কাগজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেট জেলার সীমান্ত উপজেলাগুলোতে চোরাই চিনি লুটের প্রথম ঘটনাটি ঘটে গোলাপগঞ্জে। এই উপজেলা সিলেট জেলা সদরের পাশে অবস্থিত। সেখানে কোনো সীমান্ত এলাকা নেই। তবে সীমান্ত উপজেলা বিয়ানীবাজার-জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের সড়ক যোগাযোগের একটাই পথ গোলাপগঞ্জ। এরই সুবাদে চোরাই চিনির ‘লাইন’ বাণিজ্য ছিল গোলাপগঞ্জে। এ সুযোগে চোরাই চিনির পথ থেকে অন্তত ১১টি লুটের ঘটনা ঘটে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, এক মাসে ১৭টি ঘটনায় ৩ কোটি টাকার চিনি লুট হয়েছে। এর মধ্যে একটি ঘটনা কেবল থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। ওই মামলার পর অবশ্য গোলাপগঞ্জ এলাকা এড়িয়ে চলায় চিনি লুটে ভাটা পড়ে।
ঘটনাটি গত বছর ২১ নভেম্বরের। সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার ব্যবসায়ী মিজানউদ্দিন উপজেলার সুরইঘাট বিওপি প্রাঙ্গণ থেকে নিলামে ৭৪ বস্তা চিনি কিনে সিলেট নগরীর কালীঘাট নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথের মধ্যে গোলাপগঞ্জ পৌরসভার ফুলবাড়ী পূর্বপাড়ার সিলেট টু জকিগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কে রয়েল কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেকে তার সব চিনি ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী পরিচয় দেওয়া একদল লোক। এ ঘটনায় চিনির মালিক ব্যবসায়ী মিজানউদ্দিন গোলাপগঞ্জ থানায় মামলা করেন।
ব্যবসায়ী মিজানউদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সুরইঘাট বিওপি প্রাঙ্গণ থেকে নিলামে ৭৪ বস্তা চিনি কিনে বিক্রির জন্য সিলেট কালীঘাট নিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের চিনিবাহী দুটি পিকআপ যখন গোলাপগঞ্জ উপজেলায় আসে, তখন গোলাপগঞ্জ পৌরসভার ফুলবাড়ী পূর্বপাড়াস্থ সিলেট টু জকিগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক থেকে আমার চিনির গাড়িগুলো গোলাপগঞ্জ উপজেলার ছাত্রলীগের কর্মীরা ছিনতাই করে। মুখোশ পরিহিত অবস্থায় হাতে ধারালো দা নিয়ে হত্যার ভয় দেখিয়ে তারা আমার ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার চিনি ছিনতাই করে। ছিনতাইয়ের সময় তাদের মুখোশ পরা থাকলেও তারা পরস্পরের নাম ধরে ডাকাডাকি করছিল। তাই তাদের নাম জানতে পারি এবং পরে আমি গোলাপগঞ্জ থানায় তিনজনের নামোল্লেখ করে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে গোলাপগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করি। এরপর ৩০ বস্তা চিনি উদ্ধার করে আমাকে দেয় গোলাপগঞ্জ থানা পুলিশ। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। শুনেছি যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা এখন জামিনে আছে। এই ঘটনার আর বিস্তারিত জানি না। এখন পর্যন্ত ছিনতাই হওয়া বাকি চিনি আমি ফেরত পাইনি।’
মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামি গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী দক্ষিণপাড়ার শাকিল আহমদ (২৭), হোসাইন আহমদ (২৬), পারভেজ আহমদ নিয়াজ (২৭)সহ অজ্ঞাতনামা। চিনি লুটের আগে নামোল্লেখ করা আসামিরা সহযোগীদের নিয়ে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা দিয়ে তাদের গাড়ির গতিরোধ করে। তারা সবাই মুখোশ পরা ছিল। হাতে ধারালো দা নিয়ে হত্যার ভয় দেখিয়ে পিকআপ থেকে চিনির মালিকসহ কয়েকজনকে নামতে বাধ্য করে এবং বলপ্রয়োগ করে তাদের সিএনজি অটোরিকশাতে তোলে। তখন তারা চিৎকার করে হুমকি-ধমকি দিয়ে চিনিভর্তি দুটি পিকআপ চালিয়ে ফুলবাড়ী দক্ষিণপাড়ার রোডে ধরে নিয়ে চলে যায়।
এ সময় চিনির মালিক মিজান ব্যবহৃত সিএনজি অটোরিকশাটির পেছনে ‘শাহিন অ্যান্ড তামিম পরিবহন’ লেখা দেখতে পান। চিনি ছিনতাইকারীদের পরস্পরের নাম ধরে ডাকাডাকিতে তাদের নাম জানতে পারেন। ঘটনাস্থলের আশেপাশের স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাদের পরিচয় শনাক্ত করেন।
পরে চিনির মালিক গাড়ির (মেট্রো-নম্বর-১১-১৯৩৫) মালিককে ফোনে ঘটনার বিষয়ে জানালে, গাড়িতে সংযুক্ত জিপিএস ট্রেকারের সহায়তায় তারা ফুলবাড়ী দক্ষিণপাড়া গ্রামের একপ্রান্ত থেকে ছিনতাইকারীদের ফেলে যাওয়া পিকআপ দুটি উদ্ধার করেন। তবে এর আগেই ছিনতাইকারীরা গাড়িতে থাকা ৭৪ বস্তা চিনি (প্রতি বস্তায় ৫০ কেজি করে ৩ হাজার ৭০০ কেজি) ভারতীয় চিনি ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এই চিনির মূল্য ধরা হয় মূল্য ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এরপর গোলাপগঞ্জ থানায় সংবাদ দিলে গোলাপগঞ্জ থানা পুলিশ অভিযান চালায়। পারভেজ আহমদ নিয়াজ নামে মামলার এক আসামিকে গ্রেপ্তার করে চিনি লুটে ব্যবহৃত সিএনজিচালিত অটোরিকশা জব্দ করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, এক আসামি গ্রেপ্তার ও লুটে ব্যবহৃত যান জব্দ করার পর গোলাপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তাজুল ইসলাম ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আকবর আলী ফখর তদবির শুরু করেন। তারা ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার সর্বশেষ চেষ্টায় পুলিশকে আর কোনো আসামি গ্রেপ্তার না করার জন্য চাপ দেন। চাপের মুখে পুলিশ তড়িঘড়ি করে তদন্ত করে দ্রুত আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে রাজনৈতিক চাপ থেকে রক্ষা পায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গোলাপগঞ্জ থানার ওসি (পরিদর্শক, তদন্ত) সুমন চন্দ্র সরকার খবরের কাগজকে বলেন, ‘এ মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। সে সময়ে ওই চিনি ছিনতাইয়ের ঘটনাটি বেশ আলোচিত হয়েছিল। তাই আমাদের জন্য চিনি উদ্ধার ও আসামি আটক করা অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। কিন্তু তখন আমরা অভিযান চালিয়ে সফলভাবে চিনি উদ্ধার ও আসামি আটক করি। এ ঘটনায় সারা রাত অভিযান করে ৩৯ বস্তা চিনিসহ এ দুজনকে আটক করা হয়। এটা নিয়ে ওই দিন বিকেল থেকে বিভিন্ন ঘটনা হয়। ওই অভিযানটা আমিই পরিচালনা করি। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো আমরা পরে জানতে পারি, মামলার বাদী আসামিদের সঙ্গে আপস করে নেন। কিন্তু আমরা এসব আমলে নেইনি। এই ধরনের ঘটনায় আপস করা মানে ছিনতাইকে প্রমোট করা। আমরা ঠিকই আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। এই মামলা বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন।’