সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিমে’ অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে নজিরবিহীন অচলাবস্থার দিকে যাচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। একই ইস্যুতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্মিলিত শাট ডাউন বা কর্মবিরতি কর্মসূচির কারণে এই অবস্থা তৈরি হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি পালন করলেও সরকার কিংবা সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা। নতুন নিয়মে পেনশন বাবদ অধ্যাপক ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা প্রায় কোটি টাকা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা ৩০ থেকে ৬০ লাখ টাকা কম পাবেন। সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়ার কারণে মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে আগ্রহ হারাবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি বছরের ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় প্রত্যয় স্কিমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্টদের অন্তর্ভুক্তির প্রজ্ঞাপন জারি করে। এর পর থেকে মানববন্ধন, অর্ধদিবস কর্মবিরতি, স্মারকলিপি দেওয়াসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষক ও কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে স্বতন্ত্র বেতন স্কেল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুপারগ্রেডে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান তারা।
রবিবার (৩০ জুন) সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালিত হবে। ২০১৫ সালে বেতন গ্রেডে অবনমনের প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালনের ৯ বছর পর আবারও কঠোর কর্মসূচিতে নামলেন শিক্ষকরা। এবার নতুন মাত্রা যোগ করেছে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অংশগ্রহণ। একই ইস্যুতে সম্মিলিত আন্দোলন এবারই প্রথম বলছেন অনেকে। স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় হওয়ায় সব পন্থি (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াত) আন্দোলনে সক্রিয় হচ্ছে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আখতারুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রত্যয় স্কিমের যারা প্রবর্তক তাদের সঙ্গে বসে সরাসরি আলোচনা করতে চাই। তারা বলুক বর্তমান সিস্টেমের সঙ্গে কতটুকু লাভজনক হবে, কতটুকু ক্ষতি হবে। এটা যদি করা হতো, তাহলে আমাদের মিছিল-মিটিং করতে হয় না। এর চেয়ে কঠিন আর কী হতে পারে, আমরা প্রিয় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত করছি। এটা শুনেই তো আমাদের সঙ্গে আলাপ করার কথা। কিন্তু এখনো আলাপ করার প্রয়োজন মনে করেনি তারা। এখন টোটালি শাট ডাউন।’
তিনি বলেন, সর্বজনীন পেনশনের স্কিমগুলো অকার্যকর হবে। কারণ ব্যক্তি যখন পেনশনে যান, তখন সমসাময়িক বেতন স্কেলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পেনশন নির্ধারণ করা হয়। এটাই নিয়ম সারা বিশ্বে। পেনশন একটা সুরক্ষা বলয়। প্রত্যয় স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি চরম অবজ্ঞার।
নতুন নিয়মানুযায়ী, সোমবার (১ জুলাই) থেকে স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং অধীনস্থ অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন। সেখানে স্কিমে যুক্ত ব্যক্তির মূল বেতনের ১০ ভাগ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা কেটে জমা করা হবে। উদাহরণস্বরূপ, যার বেতন ১ লাখ টাকা তার ক্ষেত্রে বেতনের ১০ ভাগ হিসাবে (১০ হাজার টাকা) না কেটে ৫ হাজার টাকা কাটা হবে। অন্যদিকে যার বেতন ১০ হাজার টাকা তার ক্ষেত্রে ১০ ভাগ হিসাবে ১ হাজার টাকা কাটা হবে।
সমপরিমাণ অর্থ প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া হবে। অবসরের পর সেই টাকা থেকে মাসিক পেনশন পাবেন। বিষয়টিকে বৈষম্যমূলক বলছেন আন্দোলনকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। নতুন নিয়ম পর্যালোচনা করে একটি রিপোর্ট তৈরি করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সেখানে ১৩টি পয়েন্ট উপস্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বর্তমান নিয়মে শিক্ষকদের কোনো টাকা কাটা হয় না। নতুন নিয়মে টাকা কাটা হবে। বর্তমানে একজন অধ্যাপক এককালীন আনুতোষিক পান ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। নতুন নিয়মে এককালীন কোনো টাকাই পাবেন না। এ ছাড়া নমিনিদের সুযোগ-সুবিধা, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, এলপিআর-সংক্রান্ত নির্দেশনা না থাকাসহ নানা অসংগতি তুলে ধরা হয়েছে।
শিক্ষক-কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে পেনশন বাবদ এককালীন আনুতোষিক, ছুটি নগদায়ন, বেনোভোলেন্ট ফান্ড বাবদ ২৪ মাসের বেতন, প্রভিডেন্ট ফান্ড হিসাবে কাটা টাকা (সুদ-আসলে), এলপিআর বাবদ ১২ মাসের বেতন সুবিধা পান। সব মিলিয়ে অধ্যাপকরা কোটি টাকার বেশি, কর্মকর্তারা কোটি টাকার কাছাকাছি, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা ৫০ থেকে ৬০ লাখ এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা কম পাবেন।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হন। এটা পদোন্নতি হলেও এ জন্য বিজ্ঞাপনসহ নতুনভাবে আবেদন করতে হয়। নতুন নিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়। কর্মরত কোনো সহযোগী অধ্যাপক যদি অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান, তিনি যদি এই স্কিমে যুক্ত হন, তাহলে তিনিও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং সিনেট সদস্য ড. মিজানুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কম। যেখানে শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন স্কেল কাঠামো নিয়ে ভাবার কথা, সেখানে উল্টো সুযোগ-সুবিধা কমানো হচ্ছে। এর ফলে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আসার আগ্রহ কমে যাবে। শিক্ষার মান দ্রুতই খারাপ হবে।’
শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের যুগ্ম মহাসচিব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুর রহিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আশা করছিলাম আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। আমরা সবার স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে আন্দোলন করছি। বর্তমানে যারা শিক্ষার্থী তারা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক বা কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তারা নতুন নিয়মে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
বাংলাদেশ আন্তবিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স ফেডারেশনের সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল মোতালেব খবরের কাগজকে বলেন, নতুন নিয়ম কার্যকর হলে শিক্ষকদের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও কিছু পাবেন না। অনেকটা বেসরকারি চাকরির মতো হয়ে যাবে। এককালীন কোনো সুযোগ-সুবিধাই পাবেন না। কোনো সুরক্ষায় থাকল না। ৩০ জুনের মধ্যে দাবি মানা না হলে তিন দিন লাগাতার কর্মবিরতি পালন করা হবে।