দায়িত্ব নেওয়ার পর চার বছরে শুধু পরিকল্পনা পর্যায়েই রয়ে গেছে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি) যাবতীয় কার্যক্রম। যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেগুলোও কবে বাস্তবায়ন হবে তা বলতে পারেন না সংশ্লিষ্টরা।
২০২০ সালে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশন বুঝে নেওয়ার পর চার বছর পার হলেও রাজধানীর জলাবদ্ধতার উন্নতি হয়নি বলেই মনে করেন নগরবাসী। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই এখনো রাজধানীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত ভারী বৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। ফলে নগরবাসী নতুন করে জলাবদ্ধতার শিকার হতে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের জন্য পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন দরকার। পূর্ণাঙ্গ ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। সেটা না করে যেটুকু প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ছিল, তাও ধ্বংস করা হয়েছে।’
২০২০ সালে ঢাকা ওয়াসা খাল হস্তান্তরের সময় জানা যায়, রাজধানীতে মাত্র ২৬টি খাল রয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ডিএনসিসির ৩০টি এবং ডিএসসিসির ৩৯টি মিলিয়ে মোট ৬৯টি খালের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আর দুই সিটি করপোরেশনের নর্দমা রয়েছে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খালগুলোর দায়িত্ব নেওয়ার পর রুটিনমাফিক উচ্ছেদে কিছু অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। তা ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে খাল-নর্দমা পরিষ্কার করা হয়।
তবে দুই মেয়র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের বাইরে নগরবাসীর দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, খালে বর্জ্য ফেলে নগরবাসী। নির্বিচারে খাল দখল করে। এগুলোর অবসান হওয়ার দরকার।
ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম খাল উদ্ধারে ‘কলাগাছ থেরাপি’র কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘বাড়ির বর্জ্য যেসব পাইপের মধ্য দিয়ে খালে ফেলা হয়, সেই প্রতিটি পাইপে কলাগাছ ঢুকাতে পারলে মনে শান্তি পেতাম। আমার ব্যর্থতা এখানে। কারণ কীভাবে বারিধারা, গুলশানের লোকেরা খালের মধ্যে কালো বর্জ্য দিয়ে দিচ্ছে। এটি অত্যন্ত কষ্ট লাগে আমার।’
ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘খাল দখলের সময় খেয়াল থাকে। জলাশয় আইন অনুযায়ী দখল হওয়া খালের জায়গা উদ্ধার করতে গেলে মানুষের কান্নার রোল পড়ে যাবে। লাঠিপেটা বা তদারকি করে দুর্নীতিমুক্ত হওয়া যায় না। একজন নাগরিক হিসেবে যদি দুর্নীতিমুক্ত হতে না পারি, তাহলে কিছুই হবে না।’
ডিএনসিসির যত পরিকল্পনা
খালের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর প্রথমেই সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ নেয় ডিএনসিসি। এই কাজ দেওয়া হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। কিন্তু কোন পদ্ধতিতে সীমানা নির্ধারণ করা হবে তা নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয়। সিএস, আরএস আবার কোথাও মহানগর জরিপ ধরে খালের সীমানা নির্ধারণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ অবস্থায় একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে ডিএনসিসি। টাস্কফোর্স কয়েকটি সভাও করেছে। এখনো সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু হয়নি।
ঢাকা ওয়াসা থেকে খাল বুঝে নেওয়া পর ওয়াসার আগের কিছু জনবল নিয়েছিল ডিএনসিসি। কিন্তু অন্তর্কোন্দল দেখা দেওয়ায় এসব জনবল ওয়াসায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। এরপর ড্রেনেজ সার্কেল গঠন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পদ সৃষ্টির প্রস্তাব দেয় ডিএনসিসি। সেই প্রস্তাব নিয়ে মন্ত্রণালয় কোনো ফিডব্যাক এখনো দেয়নি। এ ছাড়া ডিএনসিসি খালগুলোর আধুনিকায়নেও একটি প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। সেই প্রস্তাবও মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে।
ডিএসসিসির যত পরিকল্পনা
ডিএসসিসির ৩৯টি খালের মধ্যে ডিএনডি এলাকায় আছে ১৫টি। এগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এই খালগুলোও ডিএসসিসিকে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
ঢাকার বড় একটি অংশের বৃষ্টির পানি মান্ডা, জিরানী, শ্যামপুর ও কালুনগর খাল হয়ে নিষ্কাশন হয়। ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ খালগুলো আসলে বাস্তবে নেই। আছে কাগজে-কলমে। এসব খাল উদ্ধারে ৮৯৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে সরকার। প্রকল্পের কাজ কোথাও কোথাও শুরুও হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে ১৮টি খাল বুঝে নেওয়ার পর মাত্র চারটি খাল নিয়ে পরিকল্পনা করে এগিয়েছে সংস্থাটি। বাকি খালগুলোর সংস্কার ও উন্নয়ন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তবে রুটিন পরিচর্যা না হওয়ায় সেই খালগুলোও আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলে উদ্ধার ও খনন ডিএসসিসির ভালো একটি কাজ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যান্য খালের সীমানা নির্ধারণ, দখলমুক্তকরণ এবং অন্যান্য কাজ কবে শেষ হবে তা সংশ্লিষ্টরা বলতে পারছেন না।
ডিএসসিসি নর্দমা ও খালের সঙ্গে নদীর সংযোগ স্থাপনের পাশাপাশি প্রয়োজনের আলোকে মাস্টার ড্রেন তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যেটা পানি নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। প্রাথমিকভাবে নিউ মার্কেট থেকে পিলখানায় বিজিবির সদর দপ্তর প্রাঙ্গণের ভেতর দিয়ে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল, বংশাল এলাকা দিয়ে বুড়িগঙ্গা, জুরাইন ও শ্যামপুর এলাকায় মাস্টার ড্রেন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ডিএনসিসির মতো ডিএসসিসিও দায়িত্ব নেওয়ার চার বছরেও ড্রেনেজ সার্কেল তৈরি করতে পারেনি। এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে।